মাহে রমজান

নাজাতের দশকে ইতেকাফ

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ এএম, ১২ এপ্রিল ২০২৩

আল্লাহতায়ালার কৃপায় আজ পবিত্র মাহে রমজানের বিশতম দিন অতিবাহিত করার সৌভাগ্য পাচ্ছি, আলহামদুলিল্লাহ। দেখতে দেখতে আমাদের মাঝ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের দিনগুলি অতিবাহিত হয়ে প্রবেশ করেছি নাজাতের দশকে আর এই দশক হলো পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর স্মরণের দশক। আল্লাহকে একান্তভাবে লাভ করার জন্য মহানবী (সা.)এর সুন্নত অনুযায়ী মুমিন-মুত্তাকীরা এই শেষ দশকে ইতেকাফ করে থাকেন।

রমজানকে বিদায় দিতে গিয়ে আমাদের প্রিয়নবী (সা.)এর এমনটি হয়ে থাকতো যে, আধ্যাত্মিক বসন্ত নিজের চমক দেখিয়ে যখন বিদায় নেয়ার ক্ষণে পৌঁছে যেত তখন তিনি (সা.) কোমর বেঁধে নিতেন আর রমজানের কল্যাণরাজিতে নিজ ডালি ভরে নিতে কোনো ত্রুটি করতেন না।

মহানবী (সা.)এর শেষ দশকের ইবাদত সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণিত একটি হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি রমজানের শেষ দশকে প্রবেশ করলে তিনি (সা.) কিভাবে রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে জীবিত করতেন এবং তাঁর (সা.) পরিবার পরিজনকেও জাগাতেন।

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, ‘হজরত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে এত বেশি ইবাদত করতেন, যা বছরের অন্য সময়ে করতেন না।’ (মুসলিম)। তিনি আরও বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আসত, মহানবী (সা.) ইবাদতের জোর প্রস্তুতি নিতেন। নিজে রাত্রি জাগরণ করতেন। পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে তুলতেন।’ (বুখারি)।

শেষ দশকে হুজুর (সা.) ইতেকাফে বসতেন এবং লাইলাতুল কদরের অন্বেষণে রাতগুলো ইবাদতের মাধ্যমে জাগিয়ে রাখতেন। ইতেকাফের আভিধানিক অর্থ হলো কোন স্থানে আবদ্ধ হয়ে যাওয়া বা অবস্থান করা। ইসলামী পরিভাষায় ‘ইবাদতের সংকল্প নিয়ে রোজা রেখে মসজিদে অবস্থান করার নাম ইতেকাফ’ (হিদায়া, বাবুল ইতেকাফ)।

রমজান মাসের শেষ দশকে ইতেকাফে বসা সুন্নতসম্মত। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিস থেকে জানা যায়, হুজুর (সা.)এর মৃত্যুর পর তার (সা.) পবিত্র স্ত্রীগণও এ সুন্নতের অনুসরণ করতেন (সহি মুসলিম, কিতাবুল ইতেকাফ)।

হুজুর (সা.) রমজান মাসে ১০ দিনই ইতেকাফে বসতেন। উল্লেখ্য, হজরত নবী করিম (সা.) জীবনের শেষ রমজানে ২০ দিন ইতেকাফ করেছিলেন।

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন- প্রতি বছর জিবরিল আলাইহিস সালাম নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে একবার কুরআন মাজিদ শোনাতেন ও শুনতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুবার শুনিয়েছেন। প্রতি বছর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানে দশ দিন ইতেকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর তিনি বিশ দিন ইতেকাফ করেন।’ (বুখারি)

২০শে রমজান ফজরের নামাযের পর ইতেকাফ আরম্ভ করা উচিত। এজন্যে ১৯শে রমজান বাদ মাগরিব ইতেকাফস্থলে এসে যাওয়াই অনেকে ভাল মনে করে থাকেন। ইতেকাফে বসে মুতাকিফরা একাগ্রচিত্তে ব্যক্তিগত দোয়া ছাড়াও সবার জন্য সময়োপযোগী দোয়া করেন। ইতেকাফের জন্য উপযুক্ত স্থান হলো জামে মসজিদ।

এ প্রসঙ্গে কুরআনে উল্লেখ রয়েছে- ‘তোমরা মসজিদে ইতেকাফ কর’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। হাদিসেও নির্দেশ এসেছে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘জামে মসজিদ ছাড়া ইতেকাফ নেই’ (আবুদাউদ, কিতাবুল ইতেকাফ)।

ইমামগণ এ বিষয়ে ঐকমত্য সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, তবে বিভিন্ন অসুবিধার কারণে ইতেকাফ যে কোনো মসজিদে বা একান্ত অপারগতার কারণে মসজিদের বাইরেও ইতেকাফ হতে পারে। মহিলারা ঘরে নামাজের জন্য একটি বিশেষ স্থান নির্ধারণ করে সেখানে ইতেকাফে বসা তাদের জন্য উত্তম (হিদায়া, বাবুল ইতেকাফ)।

ইতেকাফকারী দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে আল্লাহর দিকে ঝুঁকে পড়ে যেন তিনি তার অভীষ্ট মনোবাসনা পূর্ণ করেই ইতেকাফ থেকে উঠতে পারেন। এটা কঠিন সাধনার বিষয়। তাই মুতাকিফকে এমন কোনো কাজকর্ম বা আচার আচরণ করা উচিত নয় যাতে তার এ সাধনা ব্যাহত হয় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয় অথবা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায় বা তার মনোবাসনা অপূর্ণ থেকে যায়। একজন তাপস সাধনের ন্যায় একাগ্রতা ঐকান্তিকতা, শৃঙ্খলা ও পবিত্রতার লাগাম যেন হাত ছাড়া হতে না দেন।

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, ইতেকাফকারীর জন্য সুন্নত হলো, ‘সে কোনো রোগী দেখতে যাবে না, জানাজায় অংশগ্রহণ করবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না, তার সঙ্গে সহবাস করবে না এবং অধিক প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবে না, রোজা না রেখে ইতেকাফ করবে না এবং জামে মাসজিদে ইতেকাফ করবে।’ (আবু দাউদ)
ইতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে হাদিসে মহানবী (সা.) বলেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে এক দিন ইতেকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা (খন্দক) দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। অর্থাৎ আসমান ও জমিনের মাঝে যত দূরত্ব আছে তার চেয়েও বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন।’ সুবহানাল্লাহ! (বায়হাকি, কানযুল উম্মাল)

রমজানের এই শেষ দশকের একটি রাতে এসে থাকে লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল কদর বা সৌভাগ্য রজনী লাভ বোধ করি মুমিনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সারাজীবন কঠোর সাধনা, ত্যাগ ও তিতিক্ষার মাধ্যমে শয়তানী প্রবৃত্তিরূপে দৈত্যকে নিধন করার পর মুমিনের কাছে আসে সেই মুহূর্তটি-সেই পাওয়ার মুহূর্তটি যা আল কোরআনের সুরা কাদরে ‘লাইলাতুল কদর’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে।

হাজার মাসের চেয়েও উত্তম এ মুহূর্তটি। হাজার মাস অর্থাৎ প্রায় ৮০ বছর। একজন মুমিন সাধারণত ৮০ বছর বেঁচে থাকেন। সুতরাং তার সারাজীবনের সাধনার ফল লাভের মুহূর্তটি তার গোটা জীবনের চেয়েও কদরের তথা কল্যাণের ও মর্যাদার।

আল্লাহতায়ালার কাছে এ দোয়াই করি, তিনি যেন এই পবিত্র রমজানের এই শেষ দশকে আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে নাজাত দান করেন, আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।
[email protected]

এইচআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।