গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ভবিষ্যৎ ও আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গ
আন্তর্জাতিক বিশ্বে প্রভাবশালী এমন অনেক দেশই আছে যাদের শাসনরীতির নাম গণতন্ত্র হলেও তা সমুন্নত নয়। অথচ, তাঁরা অন্যান্য দুর্বল অর্থনীতির দেশ কিংবা সামরিকশক্তিহীন দেশগুলোর দিকে তাকিয়ে বলতে থাকবে, এই তোমাদের দেশে গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই, সুশাসন নেই।
হালে বাংলাদেশকে নিয়েও তেমন আলোচনা রয়েছে। সে প্রসঙ্গে দাঁতভাঙ্গা না হলেও যুক্তিযুক্ত বক্তব্য উপস্থাপনে উৎসাহী হচ্ছি। ক্ষমতাসীন দলটির ক্ষুদ্র একজন কর্মী হয়ে স্পষ্টতই বলতে চাই যে, ২০৩০ সাল নাগাদ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে রাজনৈতিক দল, সরকার ও জনগণের ভূমিকা নির্ধারণে আওয়ামী লীগ সেরাটা প্রদান করতে যাচ্ছে।
অধ্যাপক গেটেলের বলেছিলেন, " যে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার প্রয়োগে অংশ নেওয়ার অধিকারী তাই গণতন্ত্র।" মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফল রাষ্ট্রনায়ক আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন," গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য।"
সার্বিক বিচারের আদ্যপান্ত জানান দেয় যে, গণতন্ত্র বলতে কোনও জাতিরাষ্ট্রের এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে।
আমি অবশ্য একটু অন্যভাবেই দেখি গণতন্ত্র ও এর অনুশীলনকে। সেক্ষেত্রে দেশি দার্শনিক ঈশ্বরমিত্রের যুক্তিকে অগ্রাহ্য করা যায় না। তিনি বলছেন, "গণতন্ত্রকে শুধুমাত্র ভোটতন্ত্রের মধ্য দিয়ে যারা সংজ্ঞায়িত করার উদ্যোগে গেছেন, তাঁরা পৃথিবীর গণতন্ত্রমনা সকল রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠী, কৃষ্টির সাথে সমন্বয় না রেখে উক্তি ছুঁড়েছেন।" অর্থাৎ গণতন্ত্রের অনুশীলনে একটি দেশের সামাজিক ক্রমবিকাশ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও বুঝদার মানব সম্পদের উপস্থিতির ওপর এই ধরনের শাসনরীতির বিকাশ সাধিত হয়।
বাংলাদেশের প্রশ্নে বলা যায়, যে দেশটি তার শ্রেষ্ঠ মানবসন্তান বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালে হারিয়ে বসে এবং তা অনভিপ্রেত কিংবা জঘন্যতম উপায়ে- সেই বাংলাদেশ একাধিক প্রতিবিপ্লবের কর্কশ সুরকে ম্রিয়মাণ করে অবশেষে ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অংশ নিয়ে হতাশ করেনি। তবে যেহেতু রাজনৈতিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক শিক্ষায় জনমানুষকে ততটা শিক্ষিত করা যায় নি, আবার পরাক্রমশক্তির আশীর্বাদও একাত্তরের পরাজিত শক্তি পেয়েই গিয়েছে, তারা তাই একাধিকবার করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে পেরেছে। কিন্তু, এখন প্রেক্ষাপটটি ভিন্ন। দেশের সামগ্রিক সংস্কৃতির ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ চাইছে, গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি হয়ে আমাদেরকেও ভবিষ্যতে কোনও না কোনও রাজনৈতিক শক্তি চ্যালেঞ্জ করুক।
স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় পার হলেও দেশের মানুষ ভাল ও মন্দ বাছতে এখনো ভুল করছে। সাম্প্রতিক সময়ে কৃতি সাংস্কৃতিক সত্তা নির্দেশক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ যেমন বলেছেন যে, সাংস্কৃতিক দুর্ভিক্ষ দেখছেন তিনি। ঠিক একইভাবে আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবেও তেমন অভিজ্ঞতা নিতে হচ্ছে তো। কিভাবে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মত দুষ্টু দলের সমর্থন থাকে? হ্যাঁ, কোন সন্দেহই নেই যে, এই দেশের সবচাইতে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের নাম আওয়ামী লীগ।
এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, দেশের প্রায় ষাট ভাগ মানুষ এই রাজনৈতিক শক্তির ওপর আস্থা রাখে। একজন শেখ হাসিনার ওপর নব্বই ভাগ মানুষের আস্থা রয়েছে। তাহলে এত উন্নয়ন করে বাকি চল্লিশভাগ মানুষ কেন আমাদেরকে নিতে পারছে না? শেখ হাসিনার মত বিশ্বসেরা রাজনৈতিক ব্যক্তিকে কেন ১০০ ভাগ মানুষ গ্রহণ করছে না? এর কারণ হল, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধশক্তির প্রেতাত্মারা এখানে টিকে রয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে তারা নতুন প্রজন্মকেও দিকভ্রষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে, হচ্ছে।
গেল ৩৩ বছরে ৬টি জাতীয় নির্বাচন দেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, নিকট সময়ের মধ্যে আরো একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রণয়নের মাধ্যমে দেশের সকল নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক। আওয়ামী লীগ ব্যতিরকে আর কোনও রাজনৈতিক দল তেমন চূড়ায় যেয়ে কাঠামোগত সংস্কারের দাবি তুলবার পর্যায়ে ফলত যেতে পারেনি।
তেমন কিছু চাইতে হলে গা ধোয়া ব্যক্তি হতে হয়, গোষ্ঠী হতে হয়। সে কারণে গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশে যেতে দেশের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগকেই শ্রম দিতে হবে। এমন হতে পারে, তা করতে যেয়ে একদিন জনপছন্দে আওয়ামী লীগের চেয়েও উন্নত দর্শন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় পৌঁছে গেছে।
সেখানেই রাজনীতির সৌন্দর্য। আমরা তেমন রাজনৈতিক শক্তিকে প্রত্যাশাও করি। তবে বাস্তবতা হল, টানা ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় সেবায় রয়েছে জনস্বার্থ সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে। মানুষ অন্য কোনও দলকে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সরকার দল হিসেবে ভাবতে পারছে না। এককথায়, তারা প্রস্তুত নয়। এখানেই আওয়ামী লীগের দায়িত্ব বেড়ে যায়।
দেশের সংবিধান, জাতীয়তা, শাসনরীতি, নির্বাচন, রাজনৈতিক দল- নানান ইস্যু নিয়ে জনশ্রেণিকে সচেতন করে বোঝাতে হবে যে, আপনার মত দেয়ার বিধান তথা ভোট টি কার্যকর ভূমিকায় সিক্ত হয়ে রাষ্ট্র বিনির্মাণে ভূমিকা রাখুক। এই কাজটি দেশের প্রাচীন দল হয়ে আওয়ামী লীগকে করতে হবে। সেজন্য আমি মনে করি, আরো সাত বছরের মত সময় দরকার। বলা প্রয়োজন, সত্যিই আমি আশাবাদীও।
লেখক: প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
এইচআর/এমএস