নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুত ও চলমান কৃত্রিম সংকট

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশিত: ০৯:৪৫ এএম, ০৭ এপ্রিল ২০২৩

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে ৪০ লাখ শিশু খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। তাদের অভিভাবকরা বিনামূল্যে শিশুদের স্কুলে খাবার সরবরাহের দাবি করেছেন। ২০২২ সালে দেশটিতে শিশুখাদ্য নিরাপত্তাহীনতার হার ছিল ১২ শতাংশ। সেটা ২০২৩ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে এসে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে।

খাদ্য নিরাপত্তার ক্রমাবনতির প্রবণতা দেখে দেশটির মানুষ শিশুদের নিয়ে খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্যের ফুড ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এ্যনা টেলর বলেছেন, ‘সরকার যে খাদ্য নিরাপত্তার দাবি করছে তাতে তথ্যগত ঘাটতি রয়েছে। শিশুদের জন্য বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ কার্যক্রমকে আরও সম্প্রসারিত করতে হবে।’

যুক্তরাজ্যের মানুষ শিশুদের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার গত দুই বছরের ক্রমাবনতির প্রবণতা তথ্যের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। সেটা জানতে পেরে সরকারের খাদ্য নিরাপত্তার তথ্য সম্পর্কে সেখানকার জনগণ কিছু বলার আগেই সরকারি ফুড ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী নিজেই খাদ্য মজুত নিয়ে সরকারের তথ্যগত ঘাটতির ব্যাপারে সরব হয়ে উঠছেন।

অর্থাৎ, সেখানকার কর্মকর্তারা জনকল্যাণে সরকারের মুখরোচক বক্তৃতার অসারতার ব্যাপারে কোনো তোয়াক্কা করেন না। তারা জনগণের কল্যাণে সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে বা সত্য কথা বলতে সর্বদাই নিবেদিত। এসব বিষয়ে কথা বলার ব্যাপারে তাদের অধিকার ও সৎ সাহস দুটোই বিদ্যমান।

আমাদের সমাজে এর উল্টো দিকের প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির উচ্চগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যে এই গতি মূল্যসন্ত্রাসে রূপ নিয়ে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এটা থামানোর জন্য প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির পাগলা ঘোড়া থামানোর কোনো প্রচেষ্টাই কাজে আসছে না। তার ওপর প্রতিনিয়ত শুনতে হচ্ছে নানা অসার তথ্য।

মার্চ ১৬, ২০২৩ তারিখে সংবাদে জানা গেছে, ‘দেশে যথেষ্ট পরিমাণ পণ্য মজুত আছে।’ কথাটি অতি সত্য বলে ধরে নিতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যাটি ভিন্ন জায়গায়। পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে- একথা গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে শিরোনাম হয়ে আসে। ভোক্তারা সেটি শুনে একসময় কিছুটা হলেও আশ্বস্ত হতেন। ভুক্তভোগী ভোক্তারা ভাবতেন, এই বুঝি সামনে দু-একদিন পরেই বাজারদর নেমে আসবে। কিন্তু যতই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে ততই নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ে সাধারণ মানুষের হতাশা বেড়ে যাচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘দেশে পণ্যের যথেষ্ট পরিমাণে মজুত আছে।’ পাশাপাশি জানানো হচ্ছে, ‘নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে।’ তবে নিম্ন আয়ের মানুষেরা প্রতিনিয়ত এসব কথা শুনতে শুনতে হয়রান। এসব ভোক্তা জানে না কৃত্রিম সংকট কে সৃষ্টি করছে। তারা ভাবছে, মজুত যদি পর্যাপ্ত থাকে তাহলে বাজারে পণ্যসংকট কেন?

ছয়টি শিল্প গ্রুপের কাছে তিন লাখ দুই হাজার মেট্রিক টন ভোজ্যতেল, পাঁচটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে দুই লাখ ২৫ হাজার ৫৬৫ মেট্রিক টন চিনি এবং পাইপলাইনে আরও বিপুল পরিমাণ আমদারি করা খাদ্যপণ্য দেশে আসার পথে। এগুলো ব্যবসায়ীদের পণ্য, সরকারের নিজস্ব নয়। মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে শুধু তাদের মজুতের ওপর নির্ভর করে হিসাব কষলে দ্রব্যমূল্য কমানো দুরূহ ব্যাপার। এই মুহূর্তে সরকারের নিজস্ব যথেষ্ট মজুত থাকলে সেগুলো এই ভয়াবহ সংকটের সময় ভান্ডার খুলে দিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারকে স্থিতিশীল করা হচ্ছে না কেন? তাহলে কি সরকারের কাছে নিজস্ব পর্যাপ্ত মজুত নেই?

ব্যবসায়ীদের ঘরে বা গুদামে খাদ্যপণ্য মজুত থাকাবস্থায় যদি বাজারে ভয়াবহ সংকট তৈরি হয় তাহলে সেই মজুত নিয়ে মন্ত্রী বা সরকারি কর্তৃপক্ষের অযথা আশ্বাস দেওয়ার প্রয়োজন কি? ক্রমাগত একই ধরনের বক্তৃতার ভাষা শুনে সাধারণ ক্রেতারা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। যেহেতু বাজারদরের অগ্নিমূল্যে থামার কোনো লক্ষণ নেই সেহেতু ধরে নেওয়া যায় যে সরকারের নিজস্ব মজুত নেই এবং যারা অতিমুনাফালোভী মজুতদার তাদের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

এতদিন ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা মহামারি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলেও সেগুলোর ক্ষতিকর প্রভাবের দিন শেষ হয়েছে। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য কমানো হলেও আমাদের দেশে উচ্চমূল্য পরিস্থিতি এখনো বিদ্যমান। এদেশে একবার কোনো কিছুর দাম বাড়ানো হলে সেটা কমানোর নজির নেই বললেই চলে।

বিশেষ করে আমাদের অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টায় বাম্পার খাদ্যশস্যের ফলন, মাছ, মাংস, ফলমূল, সবজি, ওষুধ ইত্যাদির ব্যাপক উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও এসব জিনিসের উচ্চমূল্য মানুষকে হতাশ করে তুলেছে। পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে খাদ্যপণ্যে বাজার মাত্রাতিরিক্ত গরম হয়ে উঠেছে।

গার্মেন্টস প্রোটিন বা গরিবের আমিষ বলে খ্যাত ব্রয়লার মুরগির দাম সর্বকালের রেকর্ড পেরিয়ে এখন নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সহজলভ্য তেলাপিয়া ও কৈ মাছের দামও দ্বিগুণ হয়েছে। সরকার ব্রয়লারের দাম নির্ধারণ করে দিয়ে তালিকা টাঙ্গাতে বলায় বহু বাজারে মুরগি ব্যবসায়ীরা দোকানে তালা ঝুলিয়ে বেচাকেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ পাইকাররা চাহিদা অনুযায়ী মুরগি সরবরাহ করছে না। অনেকের পছন্দের খাবার গরুর মাংসের দাম নিম্নআয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। তাদের অনেকেই গরুর মাংসের স্বাদ ভুলতেই বসেছেন। কম খেয়ে, অর্ধাহারে পুষ্টি বাকি হতে থাকলে তাদের কর্মক্ষমতাও দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অপরদিকে নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে টাকার মজুত নেই। সঞ্চয় ভেঙে খেতে খেতে সেটা শূন্যের কোটায় নেমে গেছে। তারা ধার-কর্জ করে চিন্তা করলেও কেউ সেটাতে সাড়া দেয় না বলে জানা যাচ্ছে। কারণ সমাজে তাদের লেভেলের মানুষেরা সবাই অভাবী হয়ে পড়েছেন। এখন তাদের দুশ্চিন্তা হলো হাতে নগদ কিছু টাকা না থাকলে অসুখ-বিসুখ বা জরুরি প্রয়োজনে খাদ্য, চিকিৎসা ইত্যাদির কি হাল হবে!

এটা বর্তমানে একটা জরুরি অবস্থা। এ অবস্থা মোকাবিলায় সরকারি সাহায্য নিতান্তই অপ্রতুল। টিসিবির পণ্য কিনতে গিয়ে ট্রাকের পিছনে লম্বা লাইন অথবা ভাসমান দরিদ্র মানুষের দৌড়ানোর চিত্র আমাদের বেশ ভাবিয়ে তুলছে। ট্রাকসেলের কাছে মধ্যবিত্ত ও ভদ্রঘরের মানুষ যেতে লজ্জাবোধ করছেন। অনেকে বলেছেন, ট্রাকসেলের কাছে পণ্য কিনতে গেলে নিজেকে অসহায় ও অসম্মানজনক মনে হচ্ছে। প্রতিবেশী ও পরিচিতজন আমাদের দরিদ্র ভেবে উপহাস করতে ছাড়ছে না। তাই ট্রাকসেলে না দিয়ে কোনো নির্দিষ্ট বাজারের মধ্যে সেলের কর্নার খোলা উচিত।

তাই খাদ্য মজুত আছে- এমন বক্তব্য না দিয়ে সরকারি ভান্ডার খুলে মানুষের কাছে নিত্যপণ্য নিয়ে এগিয়ে আসুন। মানুষ পর্যাপ্ত মজুতের কথা শুনতে চায় না- বরং স্বল্পমূল্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কেনার নিশ্চয়তা পেতে চায়। তা না হলে যুক্তরাজ্যের ফুড ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এ্যনা টেলর যেমনটি বলেছেন, সরকার যে খাদ্য নিরাপত্তার দাবি করছে তাতে তথ্যগত ঘাটতি রয়েছে- আমাদের দেশের মানুষও খাদ্য মজুতের ব্যাপারে সরকারের তথ্য ঘাটতি বা অসার বক্তব্য নিয়ে প্রতিবাদ করতে ঘরের বাইরে বেড়িয়ে আসতে দ্বিধা করবে না।

আমাদের দেশের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা ভুলে কর্তৃপক্ষের ভয়ে তোষণ-তোয়াজ করে কপটতা দেখালেও সেটা হয়তো সাময়িক। তারা ব্রিটেনের নির্বাহী প্রধানদের মতো সৎ সাহস নিয়ে জনকল্যাণে এগিয়ে এসে ভূমিকা পালন শুরু করলে নিত্যপণ্য নিয়ে নয়- সব ধরনের তথ্যগত ঘাটতি জনসমক্ষে উন্মোচিত হতে পারে। দেশে যথেষ্ট পরিমাণ পণ্য আসলে কাদের কাছে মজুত রয়েছে তার সঠিক তথ্য জানা যেতে পারে।

তা-না হলে মজুত নিয়ে বক্তব্য ও প্রকৃত তথ্যের ঘাটতি জনগণকে অর্ধাহার-অনাহারে রেখে নির্মম প্রহসন ছাড়া আর ভালো কিছুই দিতে অপারগ বলে বিবেচিত হতে থাকবে। আর কৃত্রিম পণ্যসংকট সৃষ্টিকারীরা আড়ালে বসে মুচকি হেসে মানুষের কষ্ট দেখতে থাকবে। তারা মন্ত্রীদের মুখে প্রতিদিন একই ধরনের বক্তব্য শুনে নিজেদের মজুত রাখা পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে আরও বেশি উৎসাহ বোধ করে।

সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় যখন কোনো বাজারের নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়ানোর খবর চাউর হয় তখন দেশের অন্য জায়গায় পণ্য সরবরাহ বেশি বা কিছুটা সস্তা থাকে সেখানেও রাতারাতি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বিদ্যুৎ গতিতে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়। তাই কর্তৃপক্ষের মুখ থেকে শুধু পণ্য মজুত আছে সেকথা প্রচার না করে পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে এবং সেটা দুর্নীতিমুক্তভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ক্রেতা সাধারণের হাতে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে -মানুষ এমন দায়িত্বশীল বক্তব্য আশা করে।

প্রায় সাড়ে তিন কোটি অতি অভাবী মানুষের প্রেক্ষিতে টিসিবির পণ্য অপ্রতুল হওয়ায় সরবরাহের পরিমাণ বাড়াতে হবে। আপৎকালীন সময়ে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তের জন্য রেশন বা টিসিবির পণ্য আলাদা বিক্রির ব্যবস্থা করা উচিত। আর এভাবে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী অতিমুনাফালোভী, কালোবাজারি, চাঁদাবাজ, মজুতদার চক্রকে চিহ্নিত করে এবং ঘুস ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার সুবিধা প্রদান না করে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সহজেই বাজার স্থিতিশীল করা সম্ভব হতে পারে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস

প্রায় সাড়ে তিন কোটি অতি অভাবী মানুষের প্রেক্ষিতে টিসিবির পণ্য অপ্রতুল হওয়ায় সরবরাহের পরিমাণ বাড়াতে হবে। আপৎকালীন সময়ে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তের জন্য রেশন বা টিসিবির পণ্য আলাদা বিক্রির ব্যবস্থা করা উচিত। আর এভাবে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারী অতিমুনাফালোভী, কালোবাজারি, চাঁদাবাজ, মজুতদার চক্রকে চিহ্নিত করে এবং ঘুস ও রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার সুবিধা প্রদান না করে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সহজেই বাজার স্থিতিশীল করা সম্ভব হতে পারে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।