বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ৫১ বছর
আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে হবে
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন মাসের মাথায় ৫১ বছর আগে এই দিনে (৪ এপ্রিল, ১৯৭২) সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। নতুন সরকারের সঙ্গে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে চিঠি লিখেছিলেন ওই সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন।
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মুখ্য কর্মকর্তা হার্বার্ট স্পাইভ্যাক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের এই বার্তা হস্তান্তর করেন। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ৯ এপ্রিল একটি চিঠি পাঠান, যাতে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। এভাবেই শুরু হয় ঢাকা-ওয়াশিংটন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক।
এরপর থেকে ৫১ বছরের পথচলায় নানা ক্ষেত্রে বিস্তৃত হয়েছে দুই দেশের সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী বন্ধু রাষ্ট্র। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তৈরি পোশাকের শীর্ষ ক্রেতাও দেশটি।
বলা হয় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক তথা অংশীদারিত্ব এখন বিস্তৃত এবং গভীর। অর্ধ-শতাব্দীর বেশি দুই দেশের এমন বর্ণিল সম্পর্কের ভেতরেও সম্প্রতি র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা অস্বস্তি তৈরি করেছে। একই সাথে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, এবং সুশাসন নিয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের টানাপোড়েনও লক্ষণীয়। এমন পরিস্থিতিতে, অর্থনীতি ও কূটনীতির সঙ্গে মিল রেখে আগামীতে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের রূপরেখা ঠিক করা উচিত।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, গড় আয়ু ৪৭ বছর থেকে বেড়ে ৭৩ বছর হয়েছে এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশেরও বেশি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদন, দুর্যোগ মোকাবিলা, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি অর্জন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ও এর উল্লেখযোগ্য আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির স্বীকৃতি ও প্রশংসা করে মার্কিন কংগ্রেস একটি রেজুলেশন উত্থাপন করেছে। বাংলাদেশের রূপান্তরকে ‘বিস্ময়কর’ উল্লেখ করে গত বছর ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াল দিনগুলো পেরিয়ে স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ভঙ্গুর অর্থনীতির কারণে অনেকেই ভেবেছিলেন বাংলাদেশ কখনোই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না! কিন্তু না, সেই অবস্থার বদল তো বটেই সফলতার গল্প হিসেবে বিশ্বব্যাপী আজ বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত।
গত ৫১ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তার উন্নয়ন, মাতৃত্ব ও শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনা, পল্লি বিদ্যুতায়ন, দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস, ক্ষুদ্রঋণ, মানবিক সহায়তাসহ বিভিন্ন খাতে সাত বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রদান করেছে। এসব খাতে অংশীদারত্ব একটি উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য সহায়ক।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি মডেল এবং যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী অংশীদারত্বের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা চিঠিতে ওয়াশিংটন-ঢাকা প্রতিরক্ষা সম্পর্ক এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাইডেন। চিঠিতে আগামী ৫০ বছরে ওয়াশিংটন ও ঢাকার মধ্যে অংশীদারত্ব আরও বাড়ানোর ব্যাপারে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে আমাদের অংশীদারত্ব আগামী ৫০ বছর এবং তারপরও বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যার পরিমাণ বছরে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। বাংলাদেশ থেকে এ দেশে রপ্তানির পরিমাণ প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েই চলছে। ২০২১ সালে যে কোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্য বেশি কিনেছে। যার মূল্যমান প্রায় ৮.৩ বিলিয়ন ডলার। মার্কিন অফিসিয়াল সোর্স ‘অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল (অটেক্সা) অনুযায়ী জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০২২ সময়ের মাঝে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক আমদানি ৫০.৯৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
একই সাথে ৮.৮৪ শতাংশ শেয়ার নিয়ে চীন ও ভিয়েতনামের পরে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পোশাক আমদানির ৩য় বৃহত্তম উৎস হিসেবে অবস্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৪ বিলিয়ন ডলারের অধিক যেসব পণ্য আসে, তার প্রায় ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক। এ খাতেই কর্মরত প্রায় ৪০ লাখ নারী শ্রমিক। এছাড়া লাখ লাখ বাংলাদেশি-আমেরিকান অভিবাসীর প্রেরিত রেমিট্যান্স বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে।
এ কথা ঠিক যে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কানেক্টিভিটি ও অবকাঠামো খাতে এখন পর্যন্ত অনুপস্থিত যুক্তরাষ্ট্র। তবে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের বড় অংশীদার হয়ে উঠেছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নানা খাতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তাও দিচ্ছে, বিশেষ করে ইউএসএআইডি, মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) ও দেশটির অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে।
কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় ওয়াশিংটন ঢাকাকে ৬১ মিলিয়নের বেশি ভ্যাকসিন ডোজ ও ১৪০ মিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যায় এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুকে এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত করা সংক্রান্ত এক প্রস্তাবে চীন, রাশিয়া ও ভারত বাংলাদেশের অবস্থানের বিপক্ষে ভোট দিলেও যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ অধিকাংশ রাষ্ট্র পক্ষে ভোট দেওয়ায় প্রস্তাবটি পাস হয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ ১.৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি মানবিক সহায়তা প্রদান করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদারতার প্রশংসা করেন এবং রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশকে অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন।
ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনীতির নানা কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বাংলাদেশকে এখন নিজেদের পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। উল্লেখ্য, মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে সেন্টারপিস বা কেন্দ্রবিন্দু বলে বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটন এতে বাংলাদেশের আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে।
সম্প্রতি ঢাকাকেন্দ্রিক কূটনৈতিক তৎপরতাও বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছরের শুরুতেই ঢাকা সফর করেছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বিশেষ উপদেষ্টা রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লউবেখার। এরপরই ঢাকা সফর করে গেছেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
যুক্তরাষ্ট্রের এই কূটনৈতিক তৎপরতা থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের আগ্রহ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই তৎপরতাকে সতর্কতার সঙ্গেই স্বাগত জানাচ্ছে বাংলাদেশ। যদিও এটি স্পষ্ট যে ইন্দো-প্যাসিফিকের সামরিক পার্টে বাংলাদেশ এখনই যুক্ত হতে চাইছে না, তবে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত সামরিক ক্রয় বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ দুটি চুক্তি আকসা ও জিসোমিয়ার বিভিন্ন দিক সমূহ ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করেছে ঢাকা।
আগামী দশকগুলোয় শক্তিশালী অংশীদারত্ব আরও গভীর করতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, উদ্বাস্তু, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা, সন্ত্রাস দমন ও সামুদ্রিকসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে উভয় দেশের একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জে রয়েছে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা এবং আইপিএসে বাংলাদেশের যুক্ততা।
সম্পর্কের ৫১ বছর পূর্তিতে উভয় দেশের উচিত, প্রাণবন্ত পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অস্বস্তিকর সব ইস্যু নিয়ে কথা বলা। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে র্যাবের কর্মকর্তাসহ প্রতিষ্ঠানটির ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও বাংলাদেশি পণ্যের আরও সুবিধা নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
বিশ্বপরিস্থিতি যেদিকেই মোড় নিক, আগামী দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশের সম্পর্ক নিঃসন্দেহে আরও দৃঢ় হবে। তাই দুই দেশের (বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র) সম্পর্ক আরও গভীর, আগামীর সুযোগ গ্রহণ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি, অবিশ্বাস ও অপপ্রচার দূর করতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম