‘স্বাধীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস দেখায় কারা?
একথা আমরা সবাই জানি যে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে মেনে নেয়নি পাকিস্তানপন্থিরা। সেই তারাই ২৫ মার্চের কালরাত্রি, ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার নকশা করেছিল। আটকাতে পেরেছিল কি? পারেনি। থেমেও গিয়েছিল কি? থামেনি। আর এর প্রমাণ পরিবারসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা আর জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর চার সৈনিকদের হত্যা।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা বাংলাদেশ থেকে লালসবুজের পতাকা মুছে দিয়ে পাকিস্তানি পতাকা কায়েম করতে চেয়েছিল। ৫২ বছরের স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগের ২০-২১ বছরের শাসনামল বাদ দিলে প্রায় পুরোটাই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় ছিল।
এই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যখনই দেখে রাজনৈতিক উপায়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল সম্ভব নয় তখনই তারা সাধারণ নাগরিকের মগজে ক্ষমতা নিতে চেষ্টা করে। এই কায়দাটা একদম পাকিস্তানের দেখানো পুরোনো কায়দা। পাকিস্তানিরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যাই করেছিল যেন একটি মগজহীন জাতি রেখে যাওয়া যায়। কেউ প্রশ্ন করবে না কেবল বিশ্বাস করবে।
যা কিছু প্রচার করা হবে মানুষ শুধু সেটাকেই ফলো করে যাবে। পাল্টা প্রশ্ন করবে না বা নিজের মেধাকে কাজে লাগানোর মতো শক্তি অর্জন করবে না। একই কায়দা এখনও চলছে। স্বাধীন বাংলাদেশে বসে একদল সঙ্ঘবদ্ধ মানুষ নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে মানুষের মননে এই কথাটি গেঁথে দিতে যে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধটাই ভুল ছিল।
বিএনপি’র মতো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দলের নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছিলেন যে পাকিস্তান আমলেই ভালো ছিল। পিতা-মাতার কাছে গল্পে শুনেছি যে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সুযোগ নিয়ে একপ্রকারের কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ব্যর্থ প্রশাসনিক ক্ষমতা।
আদতে সেগুলোর কারণই ছিল বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করা। যাতে সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিরাগভাজন হয় এবং তাঁর হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রতিক্রিয়া না করে। সেই উদ্দেশ্যে তারা কতটা সফল বা বিফল সেই বিবেচনা ইতিহাস করবে কিন্তু একই কায়দা আবারও মনে হচ্ছে দেখা যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা অস্বীকারের উপায় নেই কিন্তু আমাদের বাজার ব্যবস্থা যারা নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে যে দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষগুলো বসে আছে আমার বিশ্বাস তারাই ’৭২-’৭৫ সালের সেই মানুষগুলো। কৃত্রিম অস্থিরতা তৈরি করে মানুষের জীবনকে অনিয়ন্ত্রিত করে ফেলা। সরকারের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি করে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করে ঘটনাকে ’৭১ সালের ব্যর্থতা হিসেবে প্রচার করাটাও কৌশল।
অবশ্যই সরকারের সমালোচনা আছে এবং হবেই। সরকার বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। সরকার উন্নয়নের ফসল সবার ঘরে সমানভাবে পৌঁছে দেওয়ার যে কাঠামো সেটি নির্মাণে উদাসী আছে কিন্তু এই সমালোচনা মানেই কিন্তু ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ব্যর্থ’ এই কথা যথার্থতা দেয় না। শাসকের ব্যর্থতা মানেই দেশের জন্ম ভুল বলা যায় না। পিতা-মাতা খেতে দিতে না পারলে কি জন্মটাই ভুল বলা যায়?
অথচ এবারের স্বাধীনতা দিবসের আগে ও পরে কিছু মহল ইনিয়ে বিনিয়ে এমনি একটা আবহাওয়া তৈরির পাঁয়তারা করে গেলো। আমাদের সংবাদমাধ্যম থেকে সাধারণ মানুষের অনেকেই বুঝে না বুঝে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে স্বাধীনতার সমতুল্য করে ফেলার অপচেষ্টা করে ফেলেছে। এটা কি খুব স্বাভাবিক ঘটনা?
মোটেও না। এটি আমার মতে সেই মহলেরই কাজ যারা কথায় কথায় বলে বাংলাদেশ ব্যর্থ। অথচ আজকের বাংলাদেশ সেদিনের প্রতাপশালী পাকিস্তানের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদরা এখন বাংলাদেশের সাথে মিলিয়ে অর্থনৈতিক পলিসি নির্ধারণ করতে চাইছে। তাদের প্রধানমন্ত্রীকে দুষছে কেন তারা শেখ হাসিনার ফর্মুলা ফলো করছে না। কিন্তু আমরা কী বলছি?
কয়বেলা মাংস খেতে পারলাম সেটি দিয়ে কি স্বাধীনতার মূল্য বোঝা যাবে? একটিবার ভেবে দেখেন তো যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। পরাধীন রাষ্ট্রে আপনাকে কোন চাকরি করবেন আর কোন ধরনের শিক্ষা পাবেন সেই সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে দিচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের কর্তারা।
আপনাকে বিবেচনা করা হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে। আপনার সন্তানের বেড়ে ওঠা নির্ভর করবে একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজের চরিত্র অনুযায়ী। এই যে আজকে আপনি এতো কথা বলতে পারছেন, স্বাধীনতার মূল্য নির্ধারণ করতে চাইছেন সেটি কি পারতেন যদি ১৯৭১ সালে এই দেশটি আত্মনির্ভরশীল না হতো?
আমরা খুব সহজেই ভুলে যাই সব। একটু পড়াশোনা করলেই সব জানা যায়। বা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে শুনে নিন তো পাকিস্তানি শাসকদের অধীনে কেমন ছিল তাদের জীবন? আপনি ভাবছেন সেদিনের যুদ্ধ করা মানুষগুলো আপনার চেয়ে বোকা ছিল? নাকি কম মেধাবী ছিল?
৩০ লাখ মানুষ কি শখের বসে জীবন দিয়ে দিলো? একবার তাকান তো আফগানিস্তানের মানুষগুলোর দিকে। ইউক্রেনের অবস্থাটা চিন্তা করেন। একটি আধুনিক দেশের নাগরিকরা এখন রিফিউজি পরিচয়েও ঠাঁই পাচ্ছে না কোথাও। পরাধীনতার জ্বালা কেবল নিয়ন্ত্রিতরাই বুঝবে।
যেমনটা বলেছিলাম, সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাধীনতাকে নিয়ে প্রশ্ন করার সাহস জন্মাতে সাহায্য করছে একটি কুচক্রী মহল। এই মহলে অন্তর্ভুক্ত আছে রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সংবাদ মাধ্যম, ব্যবসায়ীদের একটা অংশ। এই মহলটি থেমে থেমেই এই চেষ্টা করতে থাকে।
তারা কখনই সাধারণ মানুষের বন্ধু নয়। তারা হচ্ছে ’৭১ আর ’৭৫ সালের পরাজিত শক্তির বংশধরেরা। তারা চায় না এদেশের মানুষ শান্তিতে থাকুক, স্বাধীনতাকে উপভোগ করুক। অশান্তিতেই এদের আনন্দ। আমি আবারও বলছি, সরকারের সমালোচনার আড়ালে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যর্থ বলা মানুষগুলোর উদ্দেশ্য সুবিধার নয়।
স্বাধীনতা ধর্মগ্রন্থ নয় অবশ্যই। এর সমালোচনাও করা যাবে তবে স্বাধীনতার সফলতা নিয়ে নয়, সুফল কে কতটা পেল সেটা নিয়ে হতেই পারে।
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস