রুচি, অরুচির প্রশ্ন

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ০৯:৫৯ এএম, ০১ এপ্রিল ২০২৩

শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি হলো আত্মার দারিদ্র্যমোচনকারী। কিন্তু শিল্প, সাহিত্য তো সমাজকেও পরিচালিত করে। সেই জায়গা থেকে দারিদ্র্য ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে, সামাজিক বৈষম্য ও অসংযমকে বাড়তে দিয়ে আড়ম্বরপ্রধান সমাজ ব্যবস্থাকে মেনে নিলে সমাজ থেকে সত্যই হারিয়ে যায়। মানুষের উৎকর্ষ প্রকাশ পায় শিল্পে। তাকে ধ্বংস করা মানে অশিক্ষায় প্রত্যাগমন। সচেতন মানুষের কর্তব্য ধ্বংসের প্রতিবাদ জানানো। এর জন্য চাই সচেতনতা, শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা।

কথাগুলো এলো একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। ‘আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থান। এই উত্থান কীভাবে রোধ করা যাবে, এটা যেমন রাজনৈতিক সমস্যা, তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক সমস্যাও।’ সম্প্রতি এই কথাগুলো বলে দেশের খ্যাতিমান নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ বেকায়দায়ই পড়েছেন বলতে হবে।

১৯৭৪ সালে যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে চলছে দুর্ভিক্ষ। সে বছরের ১০ মার্চ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সাক্ষাৎকার নেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের। সেই সাক্ষাৎকারে জয়নুল বলেন, ‘আমি বারবার বলি, আমাদের বর্তমান দুর্ভিক্ষ ততটা নয়, যতটা রুচির দুর্ভিক্ষ। একে দূর করতেই হবে।’ নাট্যজন মামুনুর রশীদ হয়তো সেখান থেকেই কথাটি নিয়েছেন।

বাংলাদেশের মানুষের যে স্বাভাবিক প্রবণতা, সেই মনোজগৎ থেকে সর্বহারার প্রতীক হিসেবে হিরো আলমকে বিবেচনায় নিয়ে সাংঘাতিক আক্রমণাত্মক ভাষায় মামুনুর রশীদকে আক্রমণ করে চলেছে একটি বড় পক্ষ। অবশ্যই রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে এবং সেখানো হিরো আলমদের অবস্থান আছে। কিন্তু হিরো আলমরাই এজন্য দায়ী, বিষয়টি সেভাবে দেখলে বড় সরলীকরণ হয়ে দাঁড়ায়।

মানুষের মনে শুভবোধ এবং সুরুচি তৈরি করার দায়িত্ব আমাদের সমাজে অনেক দিন ধরেই অবহেলিত। এই দায়িত্বহীনতার মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের। সামাজিক মাধ্যমে অনেক রুচিকর কাজের বিপরীতে অরুচিকর কনটেন্টের ছড়াছড়ি চলছে। রুচি কথাটা একদিকে যেমন সুশীলতার সাথে সম্পর্কিত, তেমনি এর সাথে আছে রাজনীতির সম্পর্ক। নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির কারণে সেরকম রুচিই তৈরি হয় যে রুচির শাসনব্যবস্থায় মানুষ বাস করে।

একটা কথা পরিষ্কার করা প্রয়োজন যে, একজন মামুনুর রশীদ হতে যে পরিশ্রম, ধৈর্য, সাধনা, মেধা, গুণ ও ত্যাগের প্রয়োজন তার একটি যোগ্যতাও হিরো আলমের নেই। মামুনুর রশীদরা বাংলা নাটক, সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তবে হিরো আলমও তার মতো করে দারিদ্র্য অবস্থা মোকাবিলা করে নিজেকে সামাজিক মাধ্যমে মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু তবু হিরো আলম মামুনুর রশীদ নন। হিরো আলমরা সংস্কৃতির জগৎকে কলুষিত করেছেন বা করতে হয়তো বাধ্যই হয়েছেন টিকে থাকার জন্য।

সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা চাইলে সুস্থ রাজনীতির কথা ভাবতে হবে, ভাবতে হবে রাষ্ট্রীয় সুশাসনের কথা। মানুষের চিন্তা ও রুচিতে সৌন্দর্য আনতে সুন্দর সাংস্কৃতিক পরিবেশ দরকার। সমাজে প্রযুক্তিগত উন্নতি যত বেড়েছে, তত হারিয়ে গেছে সংস্কৃতির সৌন্দর্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন কদর্য যৌন আবেদনে পূর্ণ উপাদানের ছড়াছড়ি এবং এটা যারা করছেন তাদের মধ্যে হিরো আলমও আছেন। কিন্তু একথা তো সত্য যে, এমন অনেক নির্মাতা ও শিল্প জগতের বিখ্যাত মানুষ আছেন যারা এমন সব ওটিটি ও ইউটিউব কনটেন্ট তৈরি করছেন যেগুলোর মান নিয়ে, রুচি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।

প্রশ্ন হলো, সমাজ সংসারে রুচির দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির দায় কী একা হিরু আলমদের? আমরা যখন দুর্নীতি আর অনিয়মের বাড়বাড়ন্ত দেখি, সেটা কি রুচির আকাল নয়? এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বিদেশি মেহমানদের দেওয়া ক্রেস্টের স্বর্ণ চুরি হয়, সেটা কী রুচির দুর্ভিক্ষ নয়?

এই লেখা যখন লিখছি তখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন সংস্কৃতি জগতের লোকজনই। অথচ একযুগ ধরে থাকার পরেও তাকেই আবার একাডেমির মহাপরিচালক করা হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে এটিও কী রুচির দুর্ভিক্ষ নয়? বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যদের অতি নিম্নমানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের যে দৃষ্টান্ত আছে সেগুলো কী রুচির দুর্ভিক্ষ নয়? নির্বাচন ব্যবস্থা যখন ধ্বংস হয়ে যায়, তখন কী রুচির দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় না?

এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আসবে প্রসঙ্গ তুলতে থাকলে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমস্যা থাকায় বাংলাদেশ যে, মানুষের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারলো না সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অরুচিকর কাজ। তাই বলতেই হবে যে, রুচির কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। স্থান কাল ভেদে রুচির ভিন্নতা আছে, থাকতে পারে। এবং রুচি নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ও নয়। তবে কী রুচির নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই? সম্ভবত বিতর্কটি সেখানেই।

সামাজিক মাধ্যমের প্রবল প্রতাপে জ্ঞানচর্চার প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। এবং সেটা একদিকে যেমন হালকা বিনোদনের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করেছে, তেমনি অন্ধচিন্তা আর স্থুল বুদ্ধির বিস্তারও ঘটিয়েছে।

মামুনুর রশীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে হচ্ছে, আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের লোকজনকে নিজেদের দিকেও দেখতে হবে। নিজের লাভের লোভে অন্যকে বঞ্চিত, অসম্মানিত বা উপেক্ষা করে কি করে বহুজন পৃথুলা হয়ে উঠছেন। এবং সেটা অবশ্যই অপরাধ। এই অপরাধে জন্ম নেয় দারিদ্র্য। এই দারিদ্র্যতা শুধু আর্থিক অসচ্ছলতা বা পরাধীনতা নয়; একই সাথে মনুষ্যত্বের মর্যাদার সঙ্গে মানবিকতা, সামাজিকতা, নৈতিকতা ও সংস্কৃতির দৈন্য।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

সামাজিক মাধ্যমের প্রবল প্রতাপে জ্ঞানচর্চার প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। এবং সেটা একদিকে যেমন হালকা বিনোদনের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করেছে, তেমনি অন্ধচিন্তা আর স্থুল বুদ্ধির বিস্তারও ঘটিয়েছে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।