রমজানে দ্রব্যমূল্য

কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে গেছে

প্রণব মজুমদার
প্রণব মজুমদার প্রণব মজুমদার
প্রকাশিত: ০৯:১১ এএম, ২৯ মার্চ ২০২৩

মাহে রমজান ইসলাম ধর্মের পবিত্র মাস। এ সময় ধর্মপ্রাণ মানুষ সংযম ও ত্যাগের কথা ভাবলেও ব্যবসায়ীরা ভাবে না। ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কৌশল খাটিয়ে মুনাফা লুটে এ সময়। অসাধু হয়ে অনৈতিক কাজ করে।

প্রতি বছর রমজানের সময় তারা অতি মন্দ কাজটি যে করে তা আর নতুন কি! ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য লাভ করা। ব্যবসায়ীরা মুনাফা করবেন তাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবারে মনে হয় তারা মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা করেছেন। অতি মুনাফা লুটে তারা দেশবাসীকে বেশ অসংযমের পরিচয় দিয়েছেন।

রমজান শুরু হওয়ার দেড় মাস আগেই নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। ক’দিন আগে খবরের কাগজে পড়লাম অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের অত্যন্ত অমানবিক এক খবর! রীতিমতো গা শিউরে ওঠার মতো সংবাদ।

পোলট্রি খাতে দাম বাড়িয়ে দেশের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত মুনাফা করেছে বলে অভিযোগ। এ অভিযোগ বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়শনের (বিপিএ)। সংগঠনটির দাবি, এ খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গত ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত ৫২ দিনে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করেছে ৯৩৬ কোটি টাকা। বিজ্ঞপ্তিতে খবরটি সংবাদপত্রকে জানায় বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়শন।

খবরে বলা হয়, দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা তিন হাজার ৫০০ টন। এর মধ্যে প্রান্তিক খামারিদের ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ এখন কেজিপ্রতি ১৬০-১৬৫ টাকা। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় ১৩০-১৪০ টাকা। তবে পাইকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত এসব মুরগি বিক্রি হয়। তাতে কেজিপ্রতি ৬০ টাকা বেশি মুনাফা করেছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো।

রমজান মাসে বড় অনৈতিক কাজ! মধ্যবিত্ত থেকে সাধারণ ভোক্তা খাদ্য গ্রহণে আমিষের শেষ আশ্রয়ের জায়গাটিও বোধ করি সরে গেলো! এরা দেশের সংঘবদ্ধ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এদের রুখবার কার আছে অধিকার? এ পর্যন্ত অতি মুনাফালোভি কোন অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেশের জনগণ দেখতে পেয়েছে?

সরকারের নীতিনির্ধারকদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে এরা দিব্যি আছেন! //////জনগণের করে পরিচালিত সরকারের কাছ থেকে এরা প্রণোদনা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নেন। দেশের বাইরে সেকেন্ড হোম বানান। বাণিজ্যে ‘ওভারইনভয়েজ’ ও ‘আন্ডার ইনভয়েজ’ ব্যাংক প্রক্রিয়ায় দেশের বাইরে টাকা পাচার করেন। সুইস ব্যাংকে নিরাপদে অর্থ ও সম্পদ আমানত রাখেন। মুখে ও বক্তৃতায় এদের শুধু দেশপ্রেম!

যে দেশে ব্যবসায়ী হন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সভার সদস্য ও মন্ত্রী এবং রাজনীতিবিদ হন ব্যবসায়ী, সে দেশে কে কার বিচার করবেন? বিচার আর যাই হোক বড় হতে পারে না। সে বিচার যেন গুরু পাপে লঘু দণ্ড! বাজার তদারকির ক্ষেত্রে তাই সর্বদা আইওয়াশই দেখে আসছি আমরা। আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রী বড় একজন ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি তার সম্প্রদায়গত স্বার্থকে বড় করে দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। সাধারণ ভোক্তার কথা কে ভাবে? ঊর্ধ্বমুখী পণ্য বাজার সম্পর্কে মন্ত্রীর বক্তব্য বা মন্তব্য কখনই দায়িত্বশীল নয়। একবার ভোক্তাদের বললেন, কম খান।

জাতীয় একটি দৈনিকের সাক্ষাৎকারে বললেন, তার সরকার ব্যবসাবান্ধব। পাঁচদিনের ভারত ও ভুটান সফর শেষে দেশের মাটিতে পা রেখেই ২৬ মার্চ বললেন, দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট নেই। পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে। রমজানকে সামনে রেখে অধিকাংশ ক্রেতা বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র কিনে নিচ্ছে। এই সুযোগ নিয়ে কিছু মুনাফাখোর ব্যবসায়ী হয়তো বেশি দাম নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় কোনো পণ্যের দাম নতুন করে বাড়েনি। মন্ত্রীর এ বক্তব্য দায়সারা গোছের। তার মন্তব্যে সবিরোধিতাও আছে।

তিনি অনুমান করছেন মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি দাম নিয়েছে। যদি তা স্বীকার করে নেন, তাহলে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণে তার অসুবিধা কোথায়? সরবরাহ যদি পর্যাপ্তই থাকে, তাহলে দাম বাড়বে কেন? আর চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি হলে মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনীতির সূত্র খাটবে না কেন?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ ছিল। ফেব্রুয়ারিতে ছিল সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮.৭৮ শতাংশ। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে তা বেশিই থাকে। বাজারে প্রতি কেজি ৬০ টাকার কাঁচামরিচ যদি ১২০ টাকা কিনতে হয়, তাহলে বর্তমানে প্রায় দ্বিগুণ খাদ্যপণ্যে মূল্যম্ফীতি কত শতাংশ হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

বিবিএসের সর্বশেষ ‘ওয়েলফেয়ার মনিটরিং জরিপের’ অনুসন্ধান অনুযায়ী, মাত্র ৪ দশমিক ২ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের সম্পদের সবচেয়ে বড় অংশ এখন কুক্ষিগত। কোনোভাবে দিন পার করছেন দেশের প্রায় ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। আর দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী এমন মানুষের সংখ্যা দেশে প্রায় ৫ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার। অথচ বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শন ছিল এ দেশের গণমানুষের মুখে হাসি ফোটানো, তাদের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ছিল তাঁর এক গভীর মানবিক সংগ্রামী দর্শন। অথচ মাত্র ৪০ থেকে ৫০ হাজার লোকের কাছে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদ আজ কেন্দ্রীভূত হয়েছে, যা খুবই পরিতাপের বিষয়। এটাকেই দেশের নীতিনির্ধারকরা উন্নতির মূলধারা বলে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন।

সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির হিসাবটি বাস্তবতার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। হ্যাঁ, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এটা সত্যি; তবে তা কিছু লোকের যাদের সম্পদের নেই কোনো সঠিক পরিসংখ্যান। এ শ্রেণির লোকের ক্রয়ক্ষমতাকেই ভিত্তি বা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ হিসেবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে।

যে হারে দেশে ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে- সে হারে কি দরিদ্র লোকের সংখ্যা কমেছে? ধনী-গরিবের পার্থক্য কি কমেছে? দেশের সব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যদি বৃদ্ধিই পায়, তাহলে তরুণ সমাজ কেন এত বিদেশমুখী হচ্ছেন? এসব তরুণের বেশিরভাগই শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে, নয়তো ঋণ করে বিদেশে যায়। দেশ যখন নিম্ন আয় থেকে মধ্যম আয়ের দিকে যাচ্ছে তখন কীসের আশায়, কীসের নেশায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব তরুণ দেশ ছাড়ছেন?

দেশের জাতীয় ও মাথাপিছু আয় বাড়লেই যে সব মানুষের জীবনযাত্রার মান বা ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, অর্থনৈতিক সূত্র কিন্তু তা সমর্থন করে না। মাটি এক জায়গায় উঁচু করতে হলে, অন্য জায়গায় নিচু করতে হয়- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। দেশে একজন কোটিপতি তৈরি হলে, তার জন্য হাজার হাজার মানুষকে আধপেট খেয়ে থাকতে হয়; অনেককেই নিঃস্ব হতে হয়। এটাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম।

সামষ্টিক অর্থনীতির পরিসংখ্যান দিয়ে সত্যিকারের তৃণমূল মানুষের অবস্থা বোঝা যায় না। এক্ষেত্রে দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও, অন্যদিকে দেশে বাড়ে চরম বৈষম্য। শহরে বড় বড় শপিংমল গড়ে উঠেছে; গড়ে উঠছে বড় বড় অবকাঠামোও। সেই সঙ্গে বাড়ছে টিসিবির ট্রাকের পিছনে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যাও। স্থানীয় বাজারে চাল, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কোনো বাজারই সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই!

অতি কষ্টে ক্রান্তিকাল কাটিয়ে ওঠার পর সাধারণ মানুষ পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অতিমূল্যের রোষানলে! এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। সৎ রোজাদারের নির্দিষ্ট আয়ে যারা নিয়মিত বাজার করেন তারা বাড়তি অর্থ পাবেন কোথায়? যাপন কষ্টের নাভিশ্বাস থেকে বাঁচার উপায় কী?

অতিমারির সংকটের সময় মহানগরে কর্মহীন মানুষ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের আর্তনাদ আমরা বেশ ভালোভাবে অনুভব করেছি। রাজধানী ছেড়ে এ শ্রেণির অনেক ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে রাতের আঁধারে পালিয়ে গেছেন। সেসব মানুষের যাপিত জীবনের যন্ত্রণা এখনও কাটেনি। বহুল প্রচারিত জাতীয় একটি দৈনিক বলেছে ২০২১ সালে বসবাসকারী মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ রাজধানী ছেড়েছে। অধিকাংশই ভাড়াটিয়া।

করোনার কারণে ১০টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ শতাংশ। বাড়তি পণ্যমূল্যের দাম দিতে গিয়ে শেষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্তরা। সঞ্চিত অর্থ হারিয়ে করোনার পর নিম্ন আয়ের বহু মানুষ রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে।

অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কোপানল থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য দেশে খাদ্যপণ্যে রেশনিং প্রথা পুনরায় চালু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। অর্থশাস্ত্রের ছাত্র হিসেবে মনে করি বর্তমান সরকারের সে সক্ষমতা রয়েছে। ভোক্তার স্বার্থরক্ষা ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে খাদ্যে ভর্তুকি দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। সুলভ দামে খাদ্য পেতে মানুষের তা মৌলিক অধিকারও বটে।

সমাজে মধ্যবিত্ত এমন একটা শ্রেণি, যারা কষ্টের শেষ অবধি অপেক্ষা করে। কিন্তু প্রকট আত্মসম্মান বোধের কারণে মুখ ফুটে কিছু বলে না। না পারে ওপরে উঠতে, না পারে নিচে নামতে। সিদ্ধান্তহীনতার দোদুল্যমান অবস্থা! ফলে নীরবে ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যায় তারা! অথচ সমাজ ও রাষ্ট্রের সব কাজের শ্রমে মধ্যবিত্তের মানুষের অবদান সবটাইতে বেশি। মধ্যবিত্তের শ্রেণির লোকদের কষ্ট মোচন ও মানবিক উন্নয়নে কেউ এগিয়ে আসে না। না সমাজ, না রাষ্ট্র!

বৈশ্বিক বড় একটা ধাক্কা গেলো সম্প্রতি। সামনে হয়তো আরও আসবে! তাছাড়া আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো লেগেই থাকে। অতিমারি করোনা মহামারির মন্দ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদেরও। দীর্ঘমেয়াদের নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। সবচেয়ে বেশি লাভবান খাদ্যপণ্য, চিকিৎসা ও ওষুধ ব্যবসায়ীরা। সংকটেও তারা অসহায় মানুষের ওপর জুলুম করছে।

অতি মুনাফার লালসা তারা দমন করেনি। মুনাফার কাছে তাদের মানবিক বোধ ও মনুষ্যত্ব ভূলুণ্ঠিত! মধ্যবিত্তের মানুষ সাহায্যের জন্য হাত পাততে চায় না। রিলিফের লাইনে দাঁড়ায় না। দেশে ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত সমাজ বেশ নাজুক অবস্থায় রয়েছে। অনেকেই বলছেন মূল্যস্ফীতি না রোধ হলে এ শ্রেণির সংখ্যা কমে যাবে। তাহলে কোথায় এ মানুষের আশ্রয়?

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

দেশের জাতীয় ও মাথাপিছু আয় বাড়লেই যে সব মানুষের জীবনযাত্রার মান বা ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে, অর্থনৈতিক সূত্র কিন্তু তা সমর্থন করে না। মাটি এক জায়গায় উঁচু করতে হলে, অন্য জায়গায় নিচু করতে হয়- এটাই প্রকৃতির নিয়ম। দেশে একজন কোটিপতি তৈরি হলে, তার জন্য হাজার হাজার মানুষকে আধপেট খেয়ে থাকতে হয়; অনেককেই নিঃস্ব হতে হয়। এটাই পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ম।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।