বাতাসের মান এবং আমাদের জান

ড. মাহবুব হাসান
ড. মাহবুব হাসান ড. মাহবুব হাসান , কবি, সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ২৬ মার্চ ২০২৩

আমরা কোয়ালিটি নিয়ে কখনোই ভেবেছি, এমনটা কেউ কখনো বলেনি। রাজনীতির কোয়ালিটি নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজে। এমন কি মধ্যম শ্রেণির রাজনীতিকদের মধ্যেও নেই সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বক্তব্য, যা গণতান্ত্রিক সমাজের সামনে নতুন কিছু উপহার দিতে পারে। আমরা নামে গণতান্ত্রিক, চেতনায় রাজনৈতিক স্বৈরচারিতায় বিশ্বাসী। বোধ করি, সেই কারণেই রাজনীতির ভাষার কোয়ালিটি নিয়েও নেই কোনো মাথাব্যথা। বরং অস্বাস্থকর শব্দমালায় সাজানো রাজনৈতিক সভাগুলোতে কর্মীনেতাদের যে সোল্লাস সমর্থন দেখতে পাই আমরা, তাতে মনে হয়, এই ধারাই রাজনীতির জন্য যোগ্য ও স্বাস্থ্যকর পথ।

উস্কানিটা আসে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে থেকে। টিভির টকশোতে যারা সরকার দলীয় কথক হিসেবে যোগ দেন, তারা নানা কথার মধ্যে এটাই বলেন যে বিরোধীরা তো সরকারের পতনের মতো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। তাই সরকারও নিজেদের নিয়ে যেমন ভাবিত নন, তেমনি তাদের উন্নয়নের যে নৌপথ রচিত হচ্ছে তা প্রমাণ করে সরকার ঠিক পথেই আছে। অর্থাৎ তারা বিরোধীদের এই বলে উস্কায় যে আন্দেলনকে আরো নারকীয় করে তুললেই কেবল সরকার তা আমলে নেবে। মানে ভয় পাবে। বিরোধী দল মানে এখন, এখানে বিএনপিকেই বোঝানো হয়। বিএনপি যদি প্রতিবাদী আন্দোলনকে সহিংস ও ভাংচুরের মাধ্যমে, গান পাউডার দিয়ে যাত্রী সমেৎ গাড়ি পোড়াতে পারে ( তাদের মতো), তাহলেই কেবল সরকার বুঝবে মাঠের রাজনীতিতে প্রকৃত তাণ্ডব শুরু হয়েছে। আর ওই তাণ্ডবে সরকার নামক বটবৃক্ষটির শেকড়বাকড়সহ উপড়ে পড়তে বাধ্য হবে। ঠিক, একই সঙ্গে তারা এই দাবি করে যে বিএনপি সরকারে যাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করছে।

আমাদের রাজনৈতিক চেতনায় এটাই হচ্ছে রাজনীতির প্রকৃত কোয়ালিটি বা মান। যদিও এই মান নির্ণয়ের কোনো যান্ত্রিক উপায় নেই, কিন্তু যা আছে তা হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শেখা ও শিক্ষা দেবার রাজনৈতিক উপকরণাদি। এক্ষেত্রে রাজনীতির যে রাজনৈতিক উপকরণের একটি হচ্ছে দেহভাষা ও মুখের ভাষা ( বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও ওরাল ল্যাঙ্গুয়েজ) এই বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ও ওরাল ল্যাঙ্গুয়েজ- মিলে মিশে যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার মান সৃষ্টি হয়, সেটাই আমাদের গণমনে আঘাত হানে। কোনো প্রশান্তি দেয় না। বরং আমরা ভীত হই। এই রাজনৈতিক ভয় থেকে সামাজিক মানুষ বাঁচতে চায়।

বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকা মহানগরের বায়ুর মান নিয়ে রিপোর্ট হচ্ছে পত্রপত্রিকা ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায়। আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠানের বায়ুর মান নির্ণয় করে জানায় বিশ্বের দেশে দেশে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-এর ( একিউআই) রিপোর্ট দেখে আমরা চমকে উঠি। ঢাকার বায়ু এতোটাই অস্বাস্থ্যকর? প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই স্কোর একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে কি না, তা জানায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে দুই দশমিক পাঁচ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে (একিউআই) ‘ভালো’ বলা যায়। এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে ‘মধ্যম’ মানের ও ১০১-১৫০ হলে ‘বিপদসীমায়’ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে ‘অস্বাস্থ্যকর’, ২০১-৩০০ হলে ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ ও ৩০১-৫০০ হলে ‘বিপজ্জনক’ বলা হয়। (সমকাল ২৪ মার্চ, ২৩)

এই যে বায়ুর মান এর মাত্রা সম্পর্কে আমরা জানলাম, সেই তুলনা যদি করি ঢাকার বায়ু নিয়ে, তাহলেই বুঝতে পারবো আমরা কোথায় বাস করছি। ঢাকার একিউআই স্কোর হচ্ছে ১৫৫। দূষিত বাতাসের শহরের তালিকায় শুক্রবার ঢাকার অবস্থান সপ্তম। আজও ( ২৪ মার্চ,২৩) ঢাকার বায়ু অস্বাস্থ্যকর। সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই-বায়ুর মান সূচক) স্কোর ১৫৫। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বেশিসংখ্যক দিন অস্বাস্থ্যকর বায়ুর মধ্যে কাটিয়েছে নগরবাসী। এ ধারাবাহিকতা রয়েছে চলতি মার্চেও।

একিউআই স্কোরে শীর্ষে আছে ভারতের দিল্লি, স্কোর ২০৯। দ্বিতীয় স্থানে আছে ইরাকের রাজধানী বাগদাদ, স্কোর ১৮২। ১৭৫ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই। চতুর্থ স্থানে আছে ভিয়েতনামের হ্যানয়, স্কোর ১৫৯। পঞ্চমে পাকিস্তানের করাচি (স্কোর ১৫৬)। সমকাল মার্চ২৪, ২৩)

আর আমরা তো সপ্তমে আছি। গত মাসে যেমন প্রথম হতে পেরেছি বেশ কিছুদিন, সে রকম উন্নতি তো করতে পারছে না ঢাকা মহানগর। তবে বায়ুর কোয়ালিটি নিয়ে আমরা দুর্ভাবনা তাড়িত নই। কেন না, বায়ুতে যে রকম ধুলাবালি,কার্বনের কালো কণা বা বিভিন্ন রসায়নিক পদার্থের অতি ক্ষুদ্রকণা ( পার্টিকলস আছে) আছে উন্নয়নের ফলে কুয়াশার মতো অস্বাস্থ্যকর উপাদান- এতে এখানকার বসতিদের ফুসফুসে ঢুকে পড়ছে সেই সব কণা।

প্লাস্টিক ও পলিথিনের রাজত্ব চলছে ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি শহরে। এমন কি গ্রামাঞ্চলের মানুষও আজ পলিথিনের দূষণের শিকার। সব মিলিয়ে ওই বায়ুর মান নিয়ে আমরা শঙ্কিত। এই শঙ্কা রাজনীতিকদের মনে কোনো রকম শঙ্কার সৃষ্টি করে বলে মনে হয় না। সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের এ- নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, উন্নয়নের ধুলাবালি তো সহ্য করতে হবেই। অর্থাৎ তারা বাতাসের কোয়ালিটির প্রশ্নে উন্নয়নকে সমন্বিত করে একধরনের তৃপ্তি পায়। ঠিক এই কারণেই বলেছি যে রাজনীতিকরা ঢাকা মহানগরের উন্নয়নের কথা বলতে কষায় ফেনা তুলে চলেছেন, কিন্তু ঢাকার বায়ুর মান যে নরকের স্তরে নেমে গেছে, সে কথা বলেন না। বলার মতো রাজনৈতিক ফুরসত তাদের নেই। মন-মানসিকতাও নেই। প্রজ্ঞায় এই তথ্য দেবার মতো কোনো উৎসাহও নেই তাদের। এক্ষেত্রে তার অন্ধ।

সরকারের একজন পরিবেশমন্ত্রী আছেন, জানি বা জানতাম। শিল্প কারখানা গড়ে তুলতে গেলে তাদের পারমিশন লাগে। পারমিশন না পেলে শিল্প কারখানা গড়ে তোলা যায় না। তারা নিশ্চয় মহানগরের বায়ুর কোয়ালিটি সম্পর্কে তথ্য রাখেন। তিনি ও তার মন্ত্রণালয়ের কোনো রা আমরা শুনি না বা শুনতে পাই না। বরং তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিতে বেশি উৎসাহী। যেন বিএনপি ঢাকার বায়ুদূষণ করে চলেছে শ্লোগান ও মিছিল করে। এবং তিনি এবং তারা প্রত্যেকেই বক্তৃতার সূচনায় কিংবা মাঝখানে প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বের জন্য তার প্রতিভার তারিফ করতে থাকেন। একবারও বলেন না যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শাসনামলে বায়ুদূষণ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে চলেছে।

ক্ষমতাসীন রাজনীতিকরা এখন রাজনীতিকে একটি দূরদর্শি ব্যবসা বলে মনে করেন। রাজনীতি ব্যবসা বলেই যেমন ব্যবসায়ীদের অনেক মুখ আজ রাজনীতিক তেমনি নিজেদের গড়ে তোলা আইনজীবী ও বিভিন্ন পেশার ব্যবসায়ীরাও আজ রাজনৈতিক মঞ্চের হিরো হয়ে বসে আছেন। এই হিরোদের মনে বায়ুদূষণ, পানি দূষণ কোনো ব্যাপারই না। নদীগ্রাস, খাল গ্রাস, ভূমিখোর তো তাদেরই রাজনৈতিক স্বজন।

ঢাকার নালা-নর্দমা ও খাল-ঝিলগুলো,যারা গ্রাস করেছে এবং এখনো করছে, তাদের সবাই সরকারি দলের ছাতার নিচের মানুষ। এরাই তুরাগের অধিকাংশ জায়গা গ্রাস করেছে। শীতলক্ষ্যার পার গ্রাস তো আর আজকের ঘটনা নয়। সেই নদী থেকে বালু তোলার মহাল রাজ্য সৃষ্টি করে সম্পদ গড়ছে। বুড়িগঙ্গাকে গ্রাস করতে করতে তার প্রবাহ সরু করেছে ওই সব রাজনৈতিক মহাজনেরাই।

ঢাকার খালগুলো উদ্ধারের একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম। এখন সেই তৎপরতা আদৌ সচল আছে - এমনটা বিশ্বাস করি কিভাবে? আমরা বলেছিলাম, মেয়রও বলেন যে খালের প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে সেতুভবন বানানো হয়েছে। আর সেখানেই বসেন সেতুমন্ত্রী। তাঁর কি একবারও মনে হয় না যে তিনি অবৈধ জায়গায় বসে বৈধ কাজ করছেন? তার মনে পড়বে না। কারণ তার আরো হাজারটা কাজ আছে। কিন্তু খালগুলো উদ্ধারে তারও যে দায় আছে সেটা কি তিনি ভুলে বসে আছেন। তিনি না বহুদিন সাংবাদিকতা করেছেন বাংলার বাণী পত্রিকায়? একজন সাংবাদিক কি করে ভোলেন যে তার সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে? এসব কারণে আমি বলেছি রাজনীতিকদের মান নিয়ে কি কোনো ইনডেক্স প্রকাশ করা যায়?

লেখক: কবি, সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

ঢাকার নালা-নর্দমা ও খাল-ঝিলগুলো,যারা গ্রাস করেছে এবং এখনো করছে, তাদের সবাই সরকারি দলের ছাতার নিচের মানুষ। এরাই তুরাগের অধিকাংশ জায়গা গ্রাস করেছে। শীতলক্ষ্যার পার গ্রাস তো আর আজকের ঘটনা নয়। সেই নদী থেকে বালু তোলার মহাল রাজ্য সৃষ্টি করে সম্পদ গড়ছে। বুড়িগঙ্গাকে গ্রাস করতে করতে তার প্রবাহ সরু করেছে ওই সব রাজনৈতিক মহাজনেরাই।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।