একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিন
বাংলাদেশের ইতিহাসে মার্চের গুরুত্ব অপরিসীম কারণ ১৯৭১ সালের এই মাসে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসকের চক্রান্তের মুখে কূটনৈতিক ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একনায়ক ভীত হয়ে পড়েছিল কারণ এই ভাষণটির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদেরকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত হবার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ব্যাপকতা যাচাই করার পরে পাকিস্তানের শাসক উপলব্ধি করেছিল যে বাঙালির আন্দোলন দমন করা অসম্ভব।
বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনায় অংশ নেওয়ার নামে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে একটি নোংরা রাজনৈতিক খেলা খেলে। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের পথ খোঁজার জন্য বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করলেও তিনি জানতেন এই আলোচনা থেকে কোন সমাধান বের হবে না। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অধিক সংখ্যক সেনাবাহিনী নিয়ে আসার জন্য কালক্ষেপণের অংশ হিসেবে তিনি মূলত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াবহতম কালো রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী "অপারেশন সার্চলাইট" এর নামে ঢাকায় পুলিশ ও ছাত্র-শিক্ষকসহ হাজার হাজার ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে। এই হত্যাযজ্ঞের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ২৬ মার্চে প্রধান প্রধান শহরগুলো দখল করে জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহকে দমন করা। শিক্ষক, একাডেমিক এবং সংস্কৃতিকর্মীদের হত্যা করে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে বাংলার বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি শাসকের বিরুদ্ধে জনগণকে প্রভাবিত করার শক্তি রাখতেন।
এই হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার বর্বর নীতির অংশ হিসেবে তারা সকল বিদেশী সাংবাদিককে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। সাংবাদিকদের দেশত্যাগে বাধ্য করার মাধ্যমে তারা এই গণহত্যার সংবাদ বিদেশী মিডিয়ার মাধ্যমে যাতে বিশ্ববাসী না জানতে পারে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছিল। সেই কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা গণহত্যায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য হলেও এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায় যে কয়েক হাজার নিরীহ বাঙালি সেই রাতে হত্যার শিকার হয়েছিলে।
পাকিস্তানি হানাদারদের শত চেষ্টার পরেও নিউইয়র্ক টাইমসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এই হত্যাযজ্ঞের সংবাদ পরিবেশন করে। নিউইয়র্ক টাইমস ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল তারিখে এক প্রবন্ধে উল্লেখ করে যে ২৫মার্চ রাতে বাংলাদেশে প্রায় ৩৫ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। অন্যদিকে, সিডনি মর্নিং হেরাল্ড তাদের ২৯ মার্চ ১৯৭১ সালের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে ২৫ মার্চ রাতে সংঘটিত গণহত্যায় বাংলাদেশে ১০ হাজার থেকে ১ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
তবে, অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে বিদেশি গণমাধ্যমে হত্যার যে সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হবে। নিহতের সামগ্রিক সংখ্যা নিয়ে ঐতিহাসিক ও সরকারি বিভাগগুলোর মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও প্রত্যেকেই একটি বিষয় স্বীকার করেছেন যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের অন্ধকার রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর গণহত্যা চালিয়েছিল। অনেক ঐতিহাসিক ঢাকায় মার্চের বর্বরতাকে সোভিয়েতের পিওডাবলু, ইহুদি হলোকাস্ট এবং রোমানিয়ান গণহত্যার সাথে তুলনা করেছেন।
যদিও ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, আমরা আমাদের স্বাধীনতার ৫১ বছর পরেও গণহত্যা হিসাবে সেই সহিংসতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পারিনি। বাংলাদেশের পূর্ববর্তী অনেক সরকার এই দিনে শহীদদের শ্রদ্ধা পর্যন্ত জানায়নি। তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট থেকে গণহত্যার স্বীকৃতি অর্জনের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
শেষ পর্যন্ত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২৫ মার্চের কালো রাতের শহীদদের সম্মান জানাতে এই দিনটিকে গণহত্যা দিবস হিসাবে পালন করার জন্য ২০১৭ সালের ১১ মার্চ তারিখে জাতীয় সংসদে একটি যৌথ রেজোলিউশন গ্রহণ করে। তখন থেকে বাংলাদেশে দিবসটি অত্যন্ত সম্মানের সাথে পালিত হয়ে আসছে। সেই রাতে বর্বরভাবে হত্যা করা শহীদদের সম্মান জানানোর প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য আমাদের অবশ্যই বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে হবে।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে ২৫ মার্চের এই ঘটনার প্রাসঙ্গিকতা উপেক্ষা করা যাবে না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দেশের জন্য জীবন বাজি রাখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। অন্যদিকে, ২৫ মার্চের সহিংসতার কারণে বেসামরিক নাগরিকরা পাকিস্তানি অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং তাদেরকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল।
গত ৫১ বছরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে বিদেশী পরাশক্তিদের বিভিন্ন ধরণের নোংরা রাজনীতি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। আমরা বেশ কয়েকটি পরাশক্তিকে দেখেছি যারা ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ পাকিস্তানিদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অনীহা প্রকাশ করেছে। তবে, বর্তমান সরকারের উদ্যোগের কারণে সেই সময় বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এই বিষয়টি তারা এখন স্বীকার করতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছে ২০১৯ সালে যাতে বিশ্বসম্প্রদায়গুলো পাকিস্তানী শাসকের অত্যাচারের কথা স্মরণ রাখে এবং তাদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে। তবে, কয়েকটি দেশের বিরোধিতার কারণে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনো অর্জিত হয়নি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো গণহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ এবং বিদেশী সাংবাদিকদের ঐক্যমত থাকলেও আমরা এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয়নি।
তবে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে কারণ বাংলাদেশের বিভিন্ন অর্জনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তিনি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। যদিও গণহত্যার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি এখনো আমরা অর্জন করতে পারিনি, তবে আওয়ামী লীগের যোগ্য নেতৃত্বের কারণে ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের অন্যতম প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের স্বীকৃতি এই ভাষণকে দেশ এবং ভাষার সীমানার বাইরে বিখ্যাত করেছে।
বিভিন্ন সময়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ব্যক্তিবর্গ এই গণহত্যার সার্বজনীন স্বীকৃতি আদায়ে তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ব্যক্ত করেছেন। এছাড়াও, গণহত্যা প্রতিরোধ সম্পর্কিত জাতিসংঘের বিশেষ কাউন্সেলর-অ্যাডামা দেইং ২০১৯ সালের ২৪ মার্চ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকালে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের গণহত্যার বিষয়টিকে একটি উপযুক্ত ফোরামে যথাযথভাবে উত্থাপন করবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তবে বাস্তবতা হল কিছু মোড়ল রাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করা সম্ভব হয় নি। তবে আশার বিষয় হল কিছু দিন আগে জেনোসাইড ওয়াচ এবং লেমকিন ইন্সটিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন এই অপরাধযজ্ঞকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
অন্যান্য বিষয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের মতো ২৫ মার্চের গণহত্যার সার্বজনীন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরো কৌশলী হয়ে অগ্রসর হতে হবে। আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে এই স্বীকৃতি কেবল শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই অর্জিত হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষ যেমন বঙ্গবন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্বাধীনতা উপহার দেওয়ার জন্য, ঠিক তেমনি ভাবে তারা কৃতজ্ঞ থাকবে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে সফল হবার জন্য।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/এএসএম