সুস্বাগতম পবিত্র মাহে রমজান
মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজান শুরু হলো, আলহামদুলিল্লাহ। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমতে আমরা আরেকটি রমজান মাসে প্রবেশ করার সৌভাগ্য লাভ করেছি। এজন্য আল্লাহপাকের শুকরিয়া আদায় করছি।
রহমত, মাগফেরাত আর নাজাতের সওগাত নিয়ে শুরু হয় রমজান। নিজেকে পরিশুদ্ধি করে পবিত্র করার বিশেষ এক মাস রমজান। সিয়াম সাধনার এক কঠিন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে নিজেকে আবারও প্রস্তুত করার এ শুভ যাত্রায় বিশ্ব মুসিলম উম্মাহকে জানাই মাহে রমজানের শুভেচ্ছা।
বিশ্বময় মহামারি করোনার দিনগুলো অতিক্রম করে যারা এ পবিত্র রমজান লাভ করেছেন তারা আসলেই অনেক সৌভাগ্যবান। আল্লাহতায়ালা যাদেরকে সুস্থ রেখেছেন তাদের উচিত হবে আল্লাহর দরবারে বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করা এবং রমজানের দিনগুলো বিশেষ ইবদতে রত থেকে অতিবাহিত করা।
মুমিন বান্দারা পবিত্র এই মাসটির অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকে। তারা শুধু ভাবে কবে থেকে শুরু হচ্ছে রমজান মাস। রমজান মাসের জন্য শাবান মাস থেকেই তারা নিজেকে বিশেষভাবে প্রস্তুত করে তোলে। এছাড়া আল্লাহপাকের পবিত্র বান্দারা মাহে রমজান উপলক্ষ্যে একটি রুটিন তৈরি করে, যাতে পূর্বের রমজান থেকে এবারের রমজানে কি কি নেক আমল বেশি করবে তার ছক আঁকা থাকে।
রমজানের রোজা রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- ‘হে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হলো, যেভাবে তা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীগণের জন্য, যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৩)
পবিত্র কোরআনের উক্ত আয়াত থেকে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তাহলো ধমীর্য় অনুষ্ঠান হিসাবে রোজা অর্থাৎ উপবাসব্রত পালন করা কোনো না কোনো আকারে সকল ধর্মেই ছিল, আছে এবং দেখতে পাওয়া যায়। অধিকাংশ ধর্মগুলোতে এবং নিম্ন, মধ্য ও উচ্চ শ্রেণির কৃষ্টির মধ্যে, উপবাসব্রত একটি সাধারণভাবে নির্দেশিত ব্যাপার।
আর যেখানে এই ধরনের নির্দেশ নেই, সেখানেও প্রাকৃতিক প্রয়োজনের তাগিদে অনেকেই উপবাস করে থাকেন। সাধুপুরুষ ও দিব্যজ্ঞানীগণের অভিজ্ঞতা থেকে যে বিষয়টি জানা যায় তা হলো, আধ্যাত্মিক উন্নতি ও মনের পবিত্রতা সাধনের জন্য শারীরিক সম্পর্কসমূহ কিছুটা ছিন্ন করা এবং সাংসারিক বন্ধন থেকে কিছুটা মুক্তিলাভ করা একান্তই প্রয়োজন।
তবে ইসলাম এই উপবাস ব্রতের মধ্যে নবরূপ, নব অর্থ ও নবতম আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আরোপ করেছে। পবিত্র মাহে রমজানের এই রোজাকে অর্থাৎ উপবাস পালনকে ইসলাম পূর্ণমাত্রার আত্মোৎসর্গ মনে করে থাকে। যিনি রোজা পালন করেন, তিনি যে কেবল শরীর রক্ষাকারী খাদ্য পানীয় থেকেই বিরত থাকেন তা নয় বরং তিনি সন্তানাদি জন্মদান তথা বংশবৃদ্ধির ক্রিয়াকলাপ থেকেও দূরে থাকেন এবং সমস্ত পাপ কাজ থেকেও বিরক থাকেন।
তাই যিনি রোযা রাখেন, তিনি তার অসাধরাণ আত্মত্যাগের এবং তার প্রস্তুতির কথা আল্লাহপাককে জানিয়ে দেন আর তার হৃদয় এই ঘোষণাও দেয় যে, আমি কেবল মাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভের আশায় রোজা রাখছি।
এছাড়া তার হৃদয় এটাও বলে যে, যেহেতু আমি আল্লাহর জন্য রোজা রাখছি এবং সকল প্রকারের পাপ কাজ থেকে বিরত থাকার অঙ্গিকার করছি তাই প্রয়োজন বোধে আমি আমার প্রভু ও সৃষ্টিকর্তার খাতিরে আমার সবকিছু, এমনকি আমার জীবন পর্যন্ত কোরবানি করে দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হবো না।
পবিত্র মাহে রমজান আসে আমাদের জন্য অবারিত ইবাদত বন্দেগীর বাড়তি সুযোগ নিয়ে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর নেক বান্দারা অন্বেষণ করে কিভাবে আল্লাহপাকের নৈকট্য অর্জন করা যায়। ইসলামে রোজার মাহাত্ম্য অতি ব্যাপক।
এই মাহাত্ম্য ও মর্যাদাকে বুঝাতে গিয়ে আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ মস্তফা (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক জিনিসের জন্য নির্দিষ্ট দরজা থাকে আর ইবাদতের দরজা হচ্ছে রোজা’ (জামেউস সগীর)। তিনি (সা.) আরো বলেছেন, ‘রোজা ঢাল স্বরূপ এবং আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি নিরাপদ দূর্গ’ (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল)।
যদিও আমরা সবাই জানি যে, পবিত্র রমজান বড়ই কল্যাণমণ্ডিত মাস, দোয়ার মাস। তারপরেও আমরা অনেকেই এই মাসের ইবাদত বন্দেগি থেকে গাফেল থাকি। অন্যান্য মাসের মতই এই পবিত্র মাসটিকে হেলায় কাটিয়ে দেই। আমরা যারা পবিত্র এই মাসটিকে লাভ করার তৌফিক পেয়েছি, নিশ্চয় তারা সৌভাগ্যবান।
অনেকেই হয়তো আশায় ছিল কিন্তু লাভ করতে পারেননি, না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাই আমাদেরকে এ মাসের পুরো ফায়দা অর্জন করতে হবে। আমাদের প্রত্যেকের উচিত হবে, পবিত্র রমজানের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব বুঝে রমজান থেকে কল্যাণ মণ্ডিত হওয়া।
আমরা যদি হজরত রসূল করিম (সা.)এর জীবনে রমজানের দিনগুলোর দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই তিনি (সা.) রমজানে কত বেশি নফল ইবাদত আর দান খয়রাত করতেন। অন্য সময়ের তুলনায় রমজানে মহানবী (সা.)এর ইবাদত আর দান খয়রাতে আরো বেশি গতি লাভ করতো আর পবিত্র মাহে রমজানের রাতগুলো মহানবী (সা.) অনেক বেশি ইবাদত বন্দেগিতে কাটাতেন। মহানবী (সা.)এর নফল নামায আর দোয়ার আহাজারিতে জেগে থাকতো নিঝুম রাতগুলো। এছাড়া এ মাসে তিনি (সা.) কোরআন শিক্ষা, শিখানো ও শোনার প্রতি অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন।
তাই মন থেকে সব ধরণের দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে আল্লাহপাকের নির্দেশের ওপর আমল করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। এই নিয়ত করতে হবে যে, গত রমজানে যদি একবার পবিত্র কুরআন খতম দিয়ে থাকি তাহলে এবার ইচ্ছা রাখব দুইবার খতম দেয়ার। গত রমজানের যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ বাজামাত না পড়তে পারি এবার ইচ্ছা থাকবে নামাজগুলো বাজামাত আদায় করার।
হাদিসে পবিত্র মাহে রমজানের রোজা রাখার গুরুত্বের ওপর বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে। যেমন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিশ্বাস এবং আন্তরিকতা আর উত্তম ফল লাভের বাসনায় রমজান মাসে রোজা রাখে, তার পূর্বের সর্বপ্রকার পাপ ক্ষমা করা হবে’ (বুখারি, মুসলিম)।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সকলকে সুস্থতার সাথে এবং তার ইবাদতে রত থেকে পবিত্র মাহে রমজানের দিনগুলো কাটানোর তৌফিক দান করুন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
[email protected]
এইচআর/এমএস