বাংলাদেশে ভোট কারচুপি-জালিয়াতির প্রবর্তন করেন জিয়া
বাংলাদেশের নির্বাচনে সন্ত্রাস, কারচুপি ও জালিয়াতির প্রবর্তন ঘটান জেনারেল জিয়াউর রহমান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ষড়যন্ত্রের পরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে যথার্থই বলেছেন, ‘১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটার কারা করেছিল? ভোট চুরির অপবাদ আওয়ামী লীগকে দেবেন না। ভোট চুরির মহারাজা বিএনপি।’
জন্মলগ্নে শুরু করা ভোট-সন্ত্রাসের ঐতিহ্য থেকে বিএনপি আজও বের হতে পারেনি। তাই তারা সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনেও অশান্তি সৃষ্টি করে। এ বিষয়ে বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ্য করে কাদের বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনে এক নেতা ব্যালট চুরি করতে গেছেন। ব্যালট চুরি করে নির্বাচনে জিতবে, এজন্য সকালে আদালতে হামলা করেছেন। ভোটগ্রহণ পণ্ড করতে বার বার আদালতে হামলা করছেন। ফখরুল সাহেব, আপনারা ধরা পড়ে গেছেন।’
আসলে জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের শত্রু। তারা অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বিশ্বাসী নয়। জিয়া নিজেই তার স্বৈরশাসনে বাংলাদেশের মানুষকে গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিলেন। ছিনিয়ে নিয়েছিলেন মানুষের ভোটদানের অধিকার। পাকিস্তানের সামরিকজান্তা আইয়ুব খানের হ্যাঁ/না ভোটের মডেল চুরি করে জিয়াউর রহমানও করেছিলেন হ্যাঁ/না ভোট।
পক্ষান্তরে জন্মলগ্ন থেকেই গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন (ইসি) সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়ায় আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। আমি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি।’
আওয়ামী লীগ প্রধানের পরিষ্কার বার্তা, ‘আমি কখনোই ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থেকে শুরু করে তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সবাই গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে লড়াই করেছেন। দেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ইতিহাসে একটু নজর দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
স্বাধীনতার পরবর্তীতে দেশে ১১ বার জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়েছে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সর্বাধিক পাঁচবার, বিএনপি চার বার এবং জাতীয় পার্টি দুবার সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। এর মধ্যে পাঁচবার নির্বাচিত দল পূর্ণ মেয়াদ সরকার চালাতে পারেনি। সর্বশেষ ২০০৮ সালে মানুষ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করায় আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় রয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গোটা দেশ এগিয়ে চলেছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলার লক্ষ্যে।
সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া বাংলাদেশ প্রথম গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করে। তবে জিয়াউর রহমানসহ অন্যদের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশে শুরু হয় অস্থিরতা। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান জাসদ, গণবাহিনী এবং পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র গোপন জোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন জিয়াউর রহমান। পরে অবশ্য রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে বসিয়ে নিজে উপ-প্রধান হন। এরপর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে শপথ নেন। প্রায় দেড় বছর স্বৈরশাসন কায়েমের পর ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল সামরিক শাসনকে বেসামরিক শাসনের চেহারা দিতে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন জিয়া। গণভোট বা আস্থা ভোটের নামে প্রহসন চলে দেশজুড়ে।
দেশবাসী সে আস্থাভোট প্রত্যাখ্যান করেন। মাত্র ২ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে হাজির হন। প্রায় সব বুথই ছিল জনশূন্য। কিন্তু দেখানো হয় ভোট পড়েছে ৮৮ শতাংশ! প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে জিয়া নিজেই পান ৯৮ শতাংশ! সেনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভোটকর্মীরাও ব্যাপক হারে ছাপ্পা ভোট মারেন। শুধু তাই নয়, সেনা আইন লঙ্ঘন করে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচনে অংশ নেন জিয়া। জনগণের মতামত উপেক্ষা করে নিজেই নিজেকে ভোটে কারচুপির মাধ্যমে জয়ী ঘোষণা করেন।
জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় একনায়কতন্ত্র। জিয়া একাই দখলে রাখেন রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব পদ। সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থেকেই ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেন তিনি। সরকারি প্রচার যন্ত্রের একচেটিয়া ব্যবহার করেন ভোটে। বিরোধীদের কোনো সুযোগই দেওয়া হয়নি ভোট প্রচারের। হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে সব সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে সেনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষপাতকে হাতিয়ার করে ভোটকে করে তোলেন প্রহসন।
এরপর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীর মুক্তি ঘোষণা করেন জিয়া। ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করার তিনি সুযোগ করে দেন। আইন সংশোধন করে দালালদের ভোটার হওয়ারও সুযোগ দেন। জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী জিয়ার অপরাধের কোনো সীমা নেই। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিকেও তিনি মদত জুগিয়েছেন। ঘাতক-দালালরা তার আমলে পেয়েছে সরকারি মর্যাদা।
স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতার কারণে নিষিদ্ধ মুসলিম লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামী, নিজাম-ই-ইসলামের মতো দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন জিয়া। শুধু তাই নয়, তার আমলে শুরু হয় আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন। গণতন্ত্রের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না তার। তাই জিয়া ১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর ফরমান জারি করে সব ক্ষমতা নিজের কুক্ষিগত করেন।
এরপর ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। সেই নির্বাচনে তিনি দালাল ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে তাদের জয় নিশ্চিত করেন। বিএনপির ক্যাডার বাহিনীর হামলার পাশাপাশি পথভ্রষ্ট সেনাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে লুণ্ঠিত হয় মানুষের ভোটাধিকার। এ সময়েই ভোট-সন্ত্রাসের জন্ম দিয়েছিলেন জিয়া। বিএনপি সেই ঐতিহ্যই বহন করে চলেছে।
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়া নিহত হওয়ার পর এইচএম এরশাদ সামরিক ক্ষমতা দখলের পর সেই ধারাই চালু রেখেছিলেন। ভোটের নামে জাতীয় পার্টিও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার লুণ্ঠন করেছিল। কিন্তু ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর গণতন্ত্র পুনরুত্থানের আন্দোলন বেগবান হয়। বাংলাদেশ ফিরে পায় গণতন্ত্র।
একইভাবে জিয়ার উত্তরসূরি তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমানও নির্বাচন প্রক্রিয়াকে নিজেদের কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তাদের সেই অপচেষ্টা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৯৫-৯৬ সালে জোর করে ক্ষমতা দখলের পর মাত্র ৩ মাস ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া।
২০০১ সালেও নির্বাচন কমিশন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির মাধ্যমে ভুয়া ভোটারদের কল্যাণে ক্ষমতায় আসে চারদলীয় ঐক্য জোট। যেখানে জোটে বিএনপির সঙ্গী জিয়াউর রহমানের মতোই যুদ্ধাপরাধীরা। ২০০৬-০৭ সালেও একই উপায়ে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে জিয়াউর রহমানের ছেলে এবং বাংলাদেশের আদালতে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত পলাতক আসামি তারেক রহমান। কিন্তু এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দিন শেষে বাংলাদেশের মানুষের ভোটে, বাংলাদেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে আবারও গণতন্ত্রের ধারা চালু করে আওয়ামী লীগ।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে আগলে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, আওয়ামী লীগের মূল চালিকা শক্তি এ দেশের জনগণ। এ দেশের মানুষকে বাদ দিয়ে বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম