বিএনপি ও জামায়াতের কৌশলের রাজনীতি

মোনায়েম সরকার
মোনায়েম সরকার মোনায়েম সরকার , রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:২৬ এএম, ১৪ মার্চ ২০২৩

বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে কোনো কোনো সংবাদমাধ্যমে খবর বের হলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধরনের খবরের আসল উদ্দেশ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করা। জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি বিএনপির কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নয়, এটা বরং একটি সাময়িক কৌশল। জামায়াত হচ্ছে বিএনপির বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত মিত্র। তবে জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কারণে দেশে-বিদেশে জামায়াত নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন আছে।

বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের মিলেমিশে চলাটা খোদ বিএনপিরও অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেন না। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির মৈত্রী কয়েকটি রাজনৈতিক দলেরও না-পছন্দ। এখন বিএনপি যেহেতু বৃহত্তর ঐক্য গড়ে সরকার পতনের আন্দোলনে আছে, সেহেতু জামায়াতকে একটু দূরে রেখে বিএনপি এটা প্রমাণ করতে চায় যে তারা জামায়াতনির্ভর দল নয়। কিন্তু নির্বাচনের সময় ভোটের হিসাব মাথায় রেখে আবার জামায়াতকে কাছে টানা হবে না, এমন কথা কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে না।

এটা আমরা জানি যে, ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার একপর্যায়ে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট গঠিত হয়, যা পরে ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। ২০০১ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে চারদলীয় জোট। সেই সরকারের মন্ত্রিসভায় জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করলে জামায়াতের আমির বা শীর্ষ কোনো নেতা তার পাশে বসতেন। এমনকি তিনি জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করতেন। বিএনপি এখন প্রকাশ্যে জামায়াতের সঙ্গে কোনো জোট বা যোগাযোগ না রাখলেও মনে মনে চায় জামায়াত তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকুক।

গত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের জোটবদ্ধ আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি। বরং ক্ষমতাসীনদের প্রচারণায় ‘বিএনপি-জামায়াত’ সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। তাই জামায়াতকে দূরে রেখে সমমনাদের নিয়ে আন্দোলনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে বিএনপি। তবে ভোটের সমীকরণে জামায়াতকে নিয়ে কৌশলী ও সতর্ক বিএনপি। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা সরকার জামায়াতের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় এসে বিএনপির বিরুদ্ধে তাদের ব্যবহারও করে কি না, তা নিয়েও বিএনপির দুশ্চিন্তা আছে।

বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি জামায়াতেরও কিছু ‘ক্ষোভ’ এবং ‘অভিমান’ রয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি অন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা করলেও জামায়াতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। এর পরও অনেকটা আগ বাড়িয়ে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে গত বছরের ২৪ ও ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলে অংশ নেয় জামায়াত।

এর আগে গত ১২ ডিসেম্বর রাতে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর যুগপতের গণমিছিল করতে গিয়ে মালিবাগে জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেফতার ও আহত হন। এ নিয়ে বিএনপির কোনো নেতা বক্তব্য বা বিবৃতি দেননি। এমনকি যুগপতের পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে কোনো আলোচনাও করেনি। কার্যত এর পরই জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছে যে দল, একাত্তরের ৯ মাস অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হয়ে ‘জেনোসাইডে’ সরাসরি অংশ নিয়েছে যে জামায়াতে ইসলামী, একাত্তরের ভূমিকার জন্য ভুল স্বীকার করে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চায়নি যে রাজনৈতিক দল, সেই জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে কীভাবে এখনো প্রাসঙ্গিক থাকাটা এক বিস্ময়ের ব্যাপার।

একাত্তরে মানবতাবিরোধী ভূমিকার কারণে জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে, কয়েকজনের বিচার এখনো চলছে, নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন বাতিল করেছে যে দলের সেই দলটি কি করে দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে পারে, সে প্রশ্ন করাই যায়। কিন্তু উত্তর যাদের দেওয়ার কথা তারা চুপচাপ আছেন।

জামায়াতকে নিয়ে আওয়ামী লীগ বা সরকারের ভাবনাও খুব পরিষ্কার বলে মনে হয় না। মাঝে মধ্যে জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের খবর থেকে এটুকু বোঝা যায় যে সরকারও জামায়াতের গতিবিধি নজরেই রেখেছে। জামায়াতকে চাপে রেখে চলার বর্তমান কৌশল সরকার কতদিন অনুসরণ করবে, সেটাই বা কে বলবে?

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করার কারণে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশে। স্বাধীনতার পরও জামায়াত নেতা গোলাম আযম পাকিস্তানে বসে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ও একটি বেতার ঘোষণার কারণে ‘মেজর জিয়া’ মানুষের কাছে যে পরিচিতি পেয়েছিলেন, তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করে জামায়াতে ইসলামীসহ সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে দেশে রাজনীতি করার সুযোগ দেন তিনি সমতায় বসে।

গোলাম আযমকে দেশে ফিরে আসার সুযোগও দেন জিয়া। সম্ভবত সেই কারণে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ভাই ভাইয়ের মতো। বিএনপিকে ছাড়া যেমন জামায়াত চলতে পারে না, তেমনি জামায়াতকে ছাড়া বিএনপিও যেন অচল। বিএনপি নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। যদিও দলটির জন্ম মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর পর।

মানুষের মধ্যে জামায়াতবিরোধী মনোভাব দেখা দিলে বিএনপি কৌশলের আশ্রয় নেয়। আবার পরিস্থিতি বদলালে জামায়াতকে কাছে টানে। এখন বিএনপি নতুন করে সরকার পতনের আন্দোলনের চুলা গরম করতে নেমেও জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরি শুরু করেছে। আওয়ামী লীগবিরোধী বাম দলগুলোকে কাছে পাওয়ার আশায় বিএনপি ২২ দলীয় ঐক্য ভেঙে নতুন একাধিক জোট গঠন করেছে বা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এখন বিএনপির কৌশল হলো যুগপৎ কর্মসূচি করে জামায়াতকে সঙ্গে রাখা। কেউ এ নিয়ে প্রশ্ন করলে সহজ উত্তর দেওয়া হচ্ছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে যে কোনো দলই তো কর্মসূচি দিতে পারে। আমরা তো কোনো দলকে না বলতে পারি না। বিএনপি-জামায়াতের দীর্ঘ প্রায় দুই যুগের গাঁটছড়া তাই কোনো না কোনো ফরমেটে থাকছেই।

শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় গদ্য লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার এক সাম্প্রতিক লেখায় উল্লেখ করেছেন, ‘আমি জানি যারা বিএনপি করেন জামায়াতের সঙ্গে তাদের এই আত্মিক বন্ধন নিয়ে সবসময়ই কিছু একটা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এটি শুধু নির্বাচনী জোট- আদর্শিকভাবে তারা আসলে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন এরকম কথাবার্তা শোনা যায় কিন্তু আমাকে এই ছেলেমানুষি কথাবার্তা বিশ্বাস করতে হবে কে বলেছে?

আমি এখনো শিউরে উঠে যখন চিন্তা করি এই দেশে বদর বাহিনীর কমান্ডাররা ক্ষমতায় চলে এসেছিল! বিষয়টি যে নৈতিকভাবে ঠিক আছে সেটা বোঝানোর জন্য ধানাই পানাই জাতীয় যুক্তি দেবেন কিন্তু আমার সেগুলো শোনার ধৈর্য নেই।

আমি পরিষ্কার জানি পাকিস্তানি মিলিটারি ১৯৭১ সালে এই দেশে যে গণহত্যা করেছিল, মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল সেই অবিশ্বাস্য নৃশংসতায় জামায়াতে ইসলামী নামক রাজনৈতিক দলটি তাদের সাথে ছিল। এই দেশের নাম যদি বাংলাদেশ হয়ে থাকে এবং দেশটি যদি আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে পেয়ে থাকি তাহলে এই দেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামী থাকার অধিকার নেই।’

জাফর ইকবাল লিখেছেন, ‘যারা রাজনীতি করেন তারা সবসময় বলেন রাজনীতিতে নাকি কোনো শেষ কথা নেই। আমি সেই কথাটি মানতে রাজি নই। অবশ্যই রাজনীতিতে শেষ কথা আছে, থাকতেই হবে। বাংলাদেশকে এমনি এমনি কেউ হাতে তুলে দেয়নি। ডেইলি টেলিগ্রাফের ভাষায়, রক্ত যদি স্বাধীনতার মূল্য হয় তাহলে পৃথিবী আর কোনো দেশ এত মূল্য দিয়ে স্বাধীনতা কিনে আনেনি। সেই বাংলাদেশের রাজনীতির শেষ কথা হচ্ছে, এই দেশে রাজাকাররা রাজনীতি করতে পারবে না। শুধু শেষ কথা নয়, প্রথম কথাটিও তাই।’

জাফর ইকবালের মতো এত স্পষ্ট ভাষায় জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো হিম্মত আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতারই নেই। তারপরও জামায়াত ইস্যুটি বিএনপির কাছে বরাবরই স্পর্শকাতর। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নে বিএনপির নেতারা বেশির ভাগ সময়েই চুপ থাকেন বা এড়িয়ে যান। যুগপৎ আন্দোলনেও জামায়াতের অংশ নেওয়া প্রশ্নে লুকোচুরি করছেন বিএনপির নেতারা।

জামায়াতকে নিয়ে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে কৌশলের খেলা খেলছে তা কিন্তু শুভ ফল বয়ে আনবে না। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির অবস্থা রমরমা হয়ে উঠছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে সমঝোতার নীতির কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রীতির পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বহাল রেখে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বুলি কপচানো বেমানান।

মোনায়েম সরকার: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

জামায়াতকে নিয়ে দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে কৌশলের খেলা খেলছে তা কিন্তু শুভ ফল বয়ে আনবে না। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির অবস্থা রমরমা হয়ে উঠছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে সমঝোতার নীতির কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে সম্প্রীতির পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। দেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল বহাল রেখে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বুলি কপচানো বেমানান।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।