নির্বাচনী গণিত
বাংলাদেশের নাগরিকরা কী গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ উৎসব ভোট দানে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে? অনেকদিন ধরে সংসদের উপ-নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটের হারের চিত্র তো তা-ই বলছে। যদিও মানুষের জন্য ভোট দান কোন বাধ্যতামূলক বন্দোবস্ত নয়, তবুও গণতন্ত্রে একজন মানুষ কেন ভোটের উৎসাহ হারিয়ে ফেলে তার একটা রাজনৈতিক অনুসন্ধান রাজনৈতিক নেতৃত্বেরই করা প্রয়োজন, কারণ আমাদের দলগুলো নির্বাচন সর্বস্ব গণতন্ত্রের চর্চাই করে, সুশাসন নিয়ে তাদের তেমন ভাবনা থাকে না।
আজকাল সবখানেই আলোচনা কেমন হবে আগামী নির্বাচন। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে আসেনি এবং নির্বাচন প্রতিহত করতে চেয়েও পারেনি। সরকার তার পুরো সময় পার করে ২০১৮ সালে যথারীতি নির্বাচন দেয়। অনেক দেনদরবার করে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে বিএনপি ড. কামালের অধীনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচনে অংশ নেয়।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট প্রায় ৯৭ শতাংশ আসন লাভ করে। সেই নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট পায় মাত্র সাতটি আসন। এর মধ্যে বিএনপি পাঁচটি ও গণফোরাম দুটি। অংশগ্রগহণমূলক নির্বাচন হলেও সেই নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই।
নির্বাচকমন্ডলী অর্থাৎ মানুষের মধ্যে যে একটা অনীহা দেখা যাচ্ছে তার কারণ কী কী, এবং ভোট দেওয়ার হার বাড়ানোর জন্য কোন পদক্ষেপ করা যায়, তার উপায় বার করার চেয়ে নির্বাচন কমিশনের এবারের চ্যালেঞ্জ বিএনপি নির্বাচন আসবে কিনা তা নিয়ে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে অবশ্য ভোটের প্রতি জনআগ্রহ নিশ্চিতভাবেই বাড়বে বলে সবার প্রত্যাশা। কিন্তু কেমন হবে আগামী নির্বাচন সেটি এক বড় জিজ্ঞাসা।
সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্যসহ বিএনপির সংসদ সদস্যরা সম্প্রতি সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং সেই আসনগুলোতে নির্বিঘ্নে উপ-নির্বাচনও সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সরকারি দলের পূর্ণ সমর্থনে সংসদে ফিরে এসেছেন সাবেক বিএনপি এমপি উকিল আবদুস সাত্তার।
রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো এখন আন্দোলনে আছে নির্বাচন কালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। তারা বিভাগীয় পর্যায়ে বেশ কিছু বড় সমাবেশ করেছে, ঢাকায়ও করেছে এবং বেশকিছু অন্যধরনের কর্মসূচিও পালন করেছে। অন্যদিকে শাসক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, সংসদ বহাল রেখে শেখ হাসিনার বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে এবং কোনো অবস্থাতেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরা হবেনা।
একটা অনঢ় অবস্থার উভয় পক্ষে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামি তাদের সর্বোচ্চ শক্তি দেখিয়ে, আগুন সন্ত্রাসসহ সহিংসতার চূড়ান্ত প্রয়োগ করেও নির্বাচন প্রতিহত করতে পারেনি, পারেনি নির্বাচনের পরে সরকারকে হটাতে। এরপর র্দীঘ সময় বিএনপি আসলে কোন আন্দোলনই আর জমাতে সক্ষম হয়নি। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যেমন কটাক্ষ করেন, তেমনি একটা জন ধারণাও তৈরি হয়েছে যে, বিএনপি আন্দোলনের দল নয়।
গত প্রায় ১৫ বছর ধরে সরকার পরিচালনার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা তার শক্ত হাত আরও শক্তিশালী করেছেন। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বড় আকারে দৃশ্যমান হলেও প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা কাঠামো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দৃঢ়ভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করছে শেখ হাসিনার সরকার।
বর্তমান সরকারের টানা তিন মেয়াদের দীর্ঘ শাসনকালে দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপুল উন্নতি দৃশ্যমান হয়েছে। বড় বড় স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে এবং একটা বড় সময় ধরে প্রবৃদ্ধির উচ্চহার বিরাজমান রয়েছে যদিও সাম্প্রতিককালে অর্থনীতি একটি সঙ্গীন পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমনটাই কমেছে যে, আইএমএফ-এর কাছে সরকারকে যেতে হয়েছে।
দুর্নীতি ও বৈষম্য, ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি বড় আলোচনা হিসেবে রয়েছে বহুদিন। সরকার জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর মত জনগণের কষ্ট হয় এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের মতো। কিন্তু এগুলোর কোন ইস্যুকেই কাজে লাগিয়ে মাঠ গরম করতে পারেনি বিএনপি।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে বৃহত্তর আন্দোলন করছে বিএনপি। কিন্তু সেই আন্দোলনের প্রভাব নেই শাসক দলে। বিএনপিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। কিন্তু সে জন্য নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবিতে কোনো ছাড় দিতে আগ্রহী নয় দলটি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভাল করেই জানে যে, বিএনপিসহ বিরোধীরা ভোট বর্জন করলে তারা নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। তখন সংঘাত-সহিংসতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। এক তরফা নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে দেশে বিদেশে।
অর্থনৈতিক মন্দা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এমনিতেই মানুষ পর্যদুস্ত অবস্থায় আছে। তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা সংঘাতময় পরিস্থিতি কারো কাম্য নয়। এমন বাস্তবতায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি বলেছেন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে না পারলেও রাজনীতি করতে পারবেন। হঠাৎ কেন এমন বক্তব্য এলো এ নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। তবে কী বিএনপিতে তারেক রহমানের প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে এই বক্তব্য আসছে শাসক দল থেকে? খালেদা জিয়াকে দিয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার কৌশল এটি? সময়ই দিবে এসব প্রশ্নের জবাব।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/জেআইএম