যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস
মুখ খুলতে হবে বাড়াতে হবে সচেতনতা
নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ৪ মার্চ বিশ্বব্যাপী যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবস পালন করা হয়। প্রতিদিন অসংখ্য নারী, কন্যাশিশু এবং কিশোর-কিশোরী আন্তর্জাতিক অপরাধী নেটওয়ার্কের ফাঁদে পড়ে। এইসব অপরাধীরা তাদের প্রতি যৌন নিপীড়ন করে, তাদের পাচার করে এবং দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ করে।
যৌন নিপীড়ন নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মতে, নারী, কন্যাশিশু বা কিশোর-কিশোরীদের শরীরের স্পর্শকাতর অংশে অযাচিত স্পর্শ এবং সেইসাথে অননুমোদিত যৌন কার্যকলাপের প্রচেষ্টাকে যৌন নিপীড়ন বলে। সহজভাবে বলতে গেলে, কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন কার্যকলাপ বা যৌন আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থের ইচ্ছাকেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন।
নারী, কন্যাশিশু ও কিশোর-কিশোরীরা দেশে ও বিদেশে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। শিশু থেকে বৃদ্ধ, কেউই রেহাই পাচ্ছে না এই রোগ থেকে। অনেক দেশে নারীরা অবাধে চলাচল করতে পারলেও তারা বিভিন্ন স্থানে যেমন বাড়ি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তা, যানবাহন, ফুটপাথ বা পাবলিক প্লেসে যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার হয়।
জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউএন উইমেন উল্লেখ করেছে যে প্রতিদিন প্রতি সেকেন্ডে গড়ে আটজন মানুষ যৌন নিপীড়ন, পাচার এবং দাসত্বের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক নেটওয়ার্কের ফাঁদে পড়ে। যৌন নিপীড়ন হল একজন মানুষের সাথে সবচেয়ে খারাপ আচরণের একটি। কারণ এটি তার মৌলিক মানবাধিকার - স্বাধীনতা, মর্যাদা এবং এমনকি নিজের শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার হরণ করে।
এই সমস্যা সর্বব্যাপী, তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলিতে যৌন নিপীড়নের ঘটনা অধিকমাত্রায় বিরাজমান। এসব দেশ থেকে পাচার করা নারী, কন্যাশিশু ও কিশোর-কিশোরীদের উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়া হয় পতিতাবৃত্তির জন্য।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল, বেশিরভাগক্ষেত্রে যৌন নির্যাতিতরা যৌন নির্যাতনের বিষয়টি গোপন রাখে। কারণ তারা মনে করে তাদের সাহায্যের জন্য কেউ নেই। এমনকি যখন তারা এই বিষয়ে বলে তখন তাদের কথা প্রায়শই বিশ্বাস করা হয় না এবং তারা মানসিক, সামাজিক এবং শারীরিক সমস্যার বেশি ঝুঁকিতে পড়ে। তাই তারা নীরব থাকার পন্থা বেছে নেয়- যা সমস্যাটিকে আরও স্থায়ী করে।
যৌন নিপীড়ন আসলে কি সে বিষয়ে অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই বলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বেশিরভাগ মানুষই এ সম্পর্কে অবগত নয়। ফলে অনেকেই এমন আচরণ করেন যা যৌন নিপীড়নের পর্যায়ে পড়ে। আবার অনেকক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর এ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকায়ে এড়িয়ে যান। ফলে যৌন নিপীড়ন সমাজ থেকে নির্মূল করা দুরূহ হয়ে পড়ে।
যৌন নিপীড়ন অনেক ধরনের হতে পারে। যেমন ভিজ্যুয়াল বা দৃশ্যমান বস্তু দ্বারা নিপীড়ন; যেমন, কেউ যদি কাউকে পোস্টার, কার্টুন, ড্রয়িং, ছবি এবং অ্যানিমেশন ইত্যাদির আকারে অযাচিত যৌন গ্রাফিক বা পর্নোগ্রাফিক সামগ্রী প্রদর্শন করে বা পাঠায় তা যৌন নিপীড়নের পর্যায়ে পড়ে।
যৌন নিপীড়ন বলতে শারীরিক নির্যাতন করাও বোঝায়। যেমন, কারো গোপনাঙ্গ স্পর্শ করা, যৌনতার জন্য ভয় দেখানো, অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা, কারো শরীর ঘেঁষে দাঁড়ানো, অযাচিত চুম্বন এবং আলিঙ্গন, ইত্যাদি। মৌখিকভাবেও কাউকে যৌন নিপীড়ন করা হয়, যেমন অনুপযুক্ত যৌন রসিকতা, অগ্রহণযোগ্য শব্দ করা যেমন শিস দেওয়া, চুমু খাওয়ার আওয়াজ বা ঠোঁট ভেজানো, জিহবা প্রর্দশন, অপমানজনক ভাষা ব্যবহার করা এবং আপত্তিকর নামে কাউকে ডাকা, ইত্যাদি।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) এর গবেষণা অনুসারে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক যৌন নিপীড়নের উদ্দেশ্যে পাচার হয় এবং এর ৯৮ শতাংশ হল অল্পবয়সী কন্যাশিশু ও কিশোর-কিশোরী। এসব যৌন অপরাধের হার দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ইউনিসেফ-এর তথ্য অনুসারে, প্রতি বছর প্রায় এক মিলিয়ন মানুষ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাদের মধ্যে শুধু নারী ও কন্যা শিশুই নয়, অল্পবয়সী ছেলে ও যুবকও রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ৩ মিলিয়নেরও বেশি শিশু পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়।
মানব পাচার এখন অনেক লাভজনক বহু বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ সেক্স ট্যুরিজমের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করে ছোট শিশুদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের জন্য। এই অর্থ উপার্জনের ব্যবসা সারা বিশ্বে শিশু পতিতাবৃত্তি বৃদ্ধিতে ইন্ধন যোগাচ্ছে।
নারী, শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা এখন অনলাইনেও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। গত বছর প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৬৪ শতাংশ নারী এবং ৫৬ শতাংশ কিশোর-কিশোরী অনলাইনে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
শহুরে শিশুদের মধ্যে অনলাইনে যৌন নিপীড়নের ঘটনা গ্রামীণ অঞ্চলের কিশোর-কিশোরীদের তুলনায় দেড়গুণ বেশি। যেসব কিশোর-কিশোরী ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং ফেসবুক, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং চ্যাটরুমের মতো সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে তাদের অনলাইন যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৫০ শতাংশের বেশি কিশোর-কিশোরী প্রাসঙ্গিক আইন সম্পর্কে জানেনা।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত একটি জরিপ দেখায় যে ৭৬ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোনও না কোনওভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হন। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৭ শতাংশ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৬ শতাংশ এবং মেডিকেল কলেজে ৫৪ শতাংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। এছাড়া বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত নারীদের মধ্যে ১৯ শতাংশই যৌন নিপীড়নের শিকার হন।
লিঙ্গ সমতা একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং একটি শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ এবং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রয়োজনীয় ভিত্তি, যার অর্থ এমন একটি বিশ্ব যেখানে নারী এবং পুরুষ, মেয়ে এবং ছেলে সবাই সমান অধিকার, সম্পদ, সুযোগ এবং সুরক্ষা ভোগ করে। তবুও, লিঙ্গ পক্ষপাত এটিকে অসম্ভব করে তোলে। অনেক নারী তাদের কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্যের সম্মুখীন হয় এবং কিছু নারী গার্হস্থ্য সহিংসতা ও নির্যাতনের সম্মুখীন হয়।
নারী বা পুরুষ যে কেউই যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। তবে নারী, কন্যাশিশু এবং কিশোর-কিশোরীরা এর শিকার হয় বেশি। যৌন নিপীড়নের শিকার নারী ও কন্যাশিশুরা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিধান ও অনেক সমাজ কাঠামোয় পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাধাণ্যের কারণে এ বিষয়ে মুখ খুলতে সাহস করেনা। অনেকক্ষেত্রে, তারা প্রতিবাদও করতে পারেনা। কারণ, প্রতিবাদ করলে উল্টো তাদেরকেই দোষারোপ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা আরও মনে করেন, দেশে যৌন হয়রানি রোধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে স্কুল-কলেজে যৌন নিপীড়নের অনেক ঘটনা ঘটে তবে তা প্রকাশ করা হয় না। স্কুল-কলেজ পরিচালনাকারী কমিটি সেই ঘটনাগুলিকে ধামাচাপা দেয়। কেউ অভিযোগ করলে উল্টো তাকেই হয়রানির শিকার হতে হয়। ঢাকাসহ বাংলাদেশের কোনো স্কুল-কলেজে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে কোনো কমিটি নেই।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এ বিষয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও আশানুরূপ ফল আসছে না। এটি নির্মূলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচি বৃদ্ধি করা, সমাজের কাঠামোগত সংস্কার ও নারীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কাঠামোগত সংস্কারের মধ্যে রয়েছে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা, দারিদ্য দূরীকরণ, শিক্ষা, চিকিৎসা, চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অসমতা কমিয়ে নারী-পুরুষের সমান প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, ইত্যাদি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজ থেকে যৌন নিপীড়ন নির্মূল করার জন্য সচেতনতা অপরিহার্য। এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনসচেতনতা জরুরি। পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যত বেশি সচেতনতা তৈরি করা যাবে, যৌন হয়রানির মতো ঘটনা ততই দূর হবে। এজন্য সবাইকে তাদের নিজ নিজ অঙ্গন থেকে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যৌন নিপীড়ন বন্ধে ভিকটিমসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে তাদের ব্যবস্থাপনায় সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে। যৌন নিপীড়ন দূর করতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে কাজ করতে হবে। কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে চুপ না থেকে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রয়োজনে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে। যৌন নিপীড়নের সঙ্গে জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনলে সমাজ থেকে এ অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব হবে।
বিশ্ব যৌন নিপীড়ন বিরোধী দিবসের মূল উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান যৌন নিপীড়ন সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। সচেতনতা বাড়াতেই প্রতি বছর দিবসটি পালন করা হয়। যৌন নিপীড়ন একটি গুরুতর বিষয় যা অবশ্যই প্রকাশ্যে আনতে হবে। এ সম্পর্কে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। কারণ, এখনও পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রায়শই কথা বলা হয়না এবং যথাযথ পদক্ষেপে নেয়া হয় না। এই দিবসটি উদযাপন নিশ্চিত করে যে বিষয়টিকে সামনে আনতে হবে, এর বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে এবং যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।
এইচআর/জেআইএম