রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর

ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং বাংলাদেশের স্বার্থ

মোস্তফা হোসেইন
মোস্তফা হোসেইন মোস্তফা হোসেইন
প্রকাশিত: ০৯:৪৫ এএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বছরপূর্তি হলো ২৪ ফেব্রুয়ারি। বিবদমান দেশ দুটির ভাবগতি দেখে বোঝা যাচ্ছে না, কবে নাগাদ যুদ্ধ শেষ হবে। আর কতদিনই বা দুই দেশের যুদ্ধ যন্ত্রণা গোটা বিশ্বকে সইতে হবে। পাটায়-পুতায় ঘষাঘষি মরিচের মরণ অবস্থায় থাকা গরিব দেশগুলোকেও কতদিন দুর্ভোগের সাগরে ভাসতে হবে। বাংলাদেশেও যে তাপ লেগেছে সেটাও কতদিনে হ্রাস পাবে সে খবরও কেউ দিতে পারছে না।

বাংলাদেশ থেকে ৬ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ইউক্রেন কিংবা ৪ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের দেশ রাশিয়ার দুর্যোগে বাংলাদেশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে-সে তো বাংলাদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশই নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়ার সব কটি দেশই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বছরকালের মধ্যে দুটি দেশের এই যুদ্ধের কারণে। যে কারণে বিশ্বযুদ্ধ না হলেও বিশ্বযুদ্ধের কুফলের প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি এবং বাংলাদেশের ভূমিকা-করণীয় নির্ধারণ একটু দুরূহ হয়ে পড়েছে। আজকের রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের জন্মকালীন বন্ধুরাষ্ট্র। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী দেশ পুনর্গঠনে রাশিয়ার ভূমিকা ঐতিহাসিক। সেদিক থেকে ইউক্রেনকেও দূরে ঠেলে দেওয়ার মতো নয়।

অন্যদিকে দুটি দেশের সঙ্গেই বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে রাশিয়া-বাংলাদেশ অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে ইতিবাচক। কারণ বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ রফতানি হয় সেই তুলনায় আমদানি পণ্যের পরিমাণ কম। যে কারণে রাশিয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহযোগী দেশ হিসেবে চিহ্নিত। সম্প্রতি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ সরাসরি জড়িত।

বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গম ও তুলা সরবরাহ করে রাশিয়া। শুধু একটি দেশের অস্থিতিশীলতায় তাই শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বই ভোগান্তির শিকার হয়েছে। তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ রাশিয়া। সূর্যমুখী তেল ও ভুট্টাও তারা রফতানি করে বিভিন্ন দেশে।

বাংলাদেশও তাদের সেই ক্রেতাদেরই একটি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সরঞ্জামাদি ক্রয় ছাড়াও রাশিয়া থেকে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে সার আমদানি করে। রাশিয়ার পাশাপাশি ইউক্রেন থেকেও বাংলাদেশে গম ইত্যাদি আসে। ফলে দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ হওয়ার কারণে বাংলাদেশকে কঠোর ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশকেও অনাকাঙ্ক্ষিত মুদ্রাস্ফীতির চাপে পড়তে হয়েছে। এই যুদ্ধ বিশ্বে কি পরিমাণ প্রভাব পড়েছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় মুদ্রাস্ফীতির একটি উদাহরণ থেকে।

সিএনবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মুদ্রাস্ফীতি এখন ভেনেজুয়েলায়। সেখানে মুদ্রাস্ফীতির হার ২২২ দশমিক ৩০ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সুদানে মুদ্রাস্ফীতি ২২০ দশমিক ৭০ শতাংশ। অপরদিকে লেবাননে ২০৬ দশমিক ২৪ শতাংশ, সিরিয়ায় ১৩৯ শতাংশ, জিম্বাবুয়েতে ১৩১ দশমিক ৭ শতাংশ, আর্জেন্টিনায় ৫৮ শতাংশ, ইরানে ৩৯ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ইথিওপিয়ায় ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশে পৌঁছেছে।

এগিয়ে যাওয়ার পথে এই যুদ্ধ যে কত বড় প্রতিবন্ধক তৈরি করে রেখেছে তা বোধ করি খুলে বলার প্রয়োজন হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পাকে পড়ে যেতে হয় কাউকে কাউকে। বিশ্ব মোড়লদের আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে এই সুযোগে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আমেরিকা সুযোগ নিতে পিছপা হয়নি। ইউরোপীয় দেশগুলো কখনো এগিয়ে যায় কখনো পিছিয়ে এমন একটা অবস্থানে রয়েছে। ক্ষমতাধর আমেরিকা রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে কসুর করছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই পথ অনুসরণ করলেও তলে তলে রাশিয়ার সঙ্গে শখ্য টিকিয়ে রেখেছে। ইউক্রেনকে অস্ত্র সাহায্য দেওয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট।

ফলে রাশিয়াবিরোধী যে আওয়াজ, তা কিন্তু ওইভাবে রাশিয়াবিরোধী আর থাকছে না। আর এখানেই সন্দেহটা দানা বাঁধে। ধমক অনুযায়ী রাশিয়াকে দুর্বল করার সম্ভাবনা খুব একটা নেই।

অন্যদিকে ইউক্রেনে কিন্তু অস্ত্র সহযোগিতা বন্ধ নেই। তাদের বিভিন্ন সহযোগিতাও অব্যাহত থাকছে। ফলে ধরেই নেওয়া যায়, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা সহজেই থামছে না।

কিন্তু এই যুদ্ধ যে শুধু বিশ্ব অর্থনীতিকেই আঘাত করেছে তাই নয়। ভূরাজনীতিতেও প্রভাব ফেলছে। দুই পরাশক্তির স্নায়ুযুদ্ধের কবলে পড়ে অনেক দেশকেই ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

অতি সম্প্রতি রাশিয়া থেকে আসা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ সামগ্রীর জাহাজ উরশা মেজরকে বন্দরে মালামাল খালাস করতে দেয়নি বাংলাদেশ। মূলত এই জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে। বাংলাদেশ যদি জাহাজটি থেকে বন্দরে মালামাল খালাসের সুযোগ দিতো তাহলে বাংলাদেশকে হয়তো বড় রকমের খেসারত দিতে হতো। সেই ঝুঁকি বাংলাদেশ নেয়নি। এই জাহাজটির পূর্ব নাম স্পার্টা-৩। রাশিয়া সেই জাহাজটিকেই নাম পাল্টে বাংলাদেশে পাঠানোয় এই বিপত্তি তৈরি হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশকে পড়তে হয়েছে বিপাকে।

এর রেশ ধরে ২১ ফেব্রুয়ারি মস্কোয় নিয়োজিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে রাশিয়া, যা নিয়ে পরীক্ষিত বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যে ছড়ি ঘুরানোর চেষ্টা করছে, এমনটা কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। রাশিয়ার মন্তব্যও তেমনই। প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, যে মুহূর্তে উরশা থেকে মালামাল খালাস নিয়ে বাংলাদেশ রাশিয়া কথাবার্তা চলছে, সমকালেই যুক্তরাষ্ট্রের সিনিয়র কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। সহজেই রাশিয়া অনুমান করতে পারে, এই চালটা যুক্তরাষ্ট্রই চেলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ রাশিয়ার দিকে যাতে বাংলাদেশ ঝুঁকে না পড়ে সেই কূটনৈতিক মিশন কি সফল হয়েছে এমন প্রশ্ন না করলেও বলা যায়, রাশিয়ার মতো বন্ধু দেশ যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে এই প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তখন যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই মুচকি হাসতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশকে দুটি পরাশক্তির চাপাচাপির মধ্যে পড়তে হয়েছে তাও বলতে হবে। অনেকটা পাটা-পুতার ঘষাঘষি আর মরিচের অবস্থার মতো এখন বাংলাদেশের।

আবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মৌলিক দিকে যদি নজর দেই তাহলে দেখতে পাবো, সম্প্রতি রাশিয়া যেভাবে মনোক্ষুণ্ণ হয়েছে সেটা অকল্পনীয় কিছু নয়। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এই নীতিমালা গ্রহণ করেছে। এই নীতিমালার ভিত্তিতে রাশিয়ার শত্রু আমেরিকা হওয়ায় যেমন আমেরিকার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়, একইভাবে আমেরিকার শত্রু রাশিয়া হওয়ায় রাশিয়ার বিপক্ষেও অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। এতে করে দুটি দেশই যেমন মনোক্ষুণ্ণ হওয়ার কারণ থাকতে পারে আবার দুটি দেশই সন্তোষ্টও থাকতে পারে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে সুবিধাজনক অবস্থান তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন কূটনৈতিক দক্ষতার বিষয়টি। দুটি পক্ষকেই নিজের অনুকূলে আনার ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে কীভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা হবে তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর করবে।

সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে জাতিসংঘে। এতে জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে সংগতি রেখে অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। তবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বৃহস্পতিবারের ভোটাভুটিতে বাংলাদেশ, চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ ৩২টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল।

এই মুহূর্তে বন্ধুরাষ্ট্র রাশিয়ার যে অবস্থান তাকে নেতিবাচক চিন্তা করতে নারাজ বাংলাদেশ। কিন্তু রাশিয়া তার বিপরীত চিন্তাই করছে। ফলে দুয়ের মধ্যে একটু ফারাক আছে তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ কূটনৈতিক দক্ষতা আগের তুলনায় বেড়েছে এটা যেমন আমরা স্বীকার করি তার ওপর ভিত্তি করেই বলতে পারি, বাংলাদেশ হয়তো বন্ধুরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ভাবনাকে প্রকৃতই ইতিবাচক দিকে চালানোর চেষ্টা করবে।

সেক্ষেত্রে দুটি পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা দেখেছি সম্প্রতি রীতি ভেঙে রাশিয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়ে মাথা ঘামিয়েছে, তাদেরও ভাবার দরকার আছে, কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনেই পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা সম্ভব। বিশেষ করে বন্ধুত্ব রক্ষায় বন্ধুত্বশুলভ আচরণ থাকার বিষয়টি উভয়কেই ভাবতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক সুবিধা টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধকে না বলবে না। কারণ তার অস্ত্র বিক্রি প্রয়োজন আছে। কিন্তু অন্যদের এ থেকে রক্ষার চিন্তাও করতে হবে। আর আমাদের চিন্তা করতে হবে আমাদের স্বার্থের কথা। সবদিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ নিজের প্রয়োজন ও স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এমনটা আশা করা যেতে পারে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, গবেষক।

এইচআর/ফারুক/এমএস

যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক সুবিধা টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধকে না বলবে না। কারণ তার অস্ত্র বিক্রি প্রয়োজন আছে। কিন্তু অন্যদের এ থেকে রক্ষার চিন্তাও করতে হবে। আর আমাদের চিন্তা করতে হবে আমাদের স্বার্থের কথা। সবদিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ নিজের প্রয়োজন ও স্বার্থ টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এমনটা আশা করা যেতে পারে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।