আমার বইমেলা

বিয়ের আগেই সন্তানের জন্য বই কিনেছিলাম

ইয়াহিয়া নয়ন
ইয়াহিয়া নয়ন ইয়াহিয়া নয়ন , সাংবাদিক
প্রকাশিত: ১০:০৭ এএম, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

জমে উঠেছে বইমেলা। কিন্তু কিভাবে জমে উঠেছে? আমিতো বইমেলা ঘুরে ঘুরে জমে ওঠারমত কিছুই দেখলাম না। প্রকাশকদের মুখে হাসি নেই। স্টলগুলোতে ছবি তোলা, সেলফি তোলার উৎসব চলছে। অনেক দর্শকের ভিড়, চ্যানেলের ক্যামেরাগুলো সচল, চলছে লাইভ, সব মিলিয়ে চলছে উৎসব। তবে বইমেলা জমেছে মেলা প্রঙ্গণের বাইরে। প্রবেশ এবং প্রস্থানের সবগুলো পথে জমে উঠেছে দারুণ। ফুসকা, চটপটি, বাদাম ভাজা, বারগার, ঝালমুড়ি , পেয়ারা-আমড়া-বরই ইত্যাদি বিক্রেতাদের ঘিরে ক্রেতাদের ভিড়। বিপুল বিক্রি সেসব স্থানে।

১০ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় যে পরিমাণে দর্শকের আগমন ঘটেছিল, তা স্মরণ রাখার মত। সেই দর্শকদের চার ভাগের একভাগ যদি একটি করে বই কিনতেন তাহলে বইমেলার প্রায় সব বই বিক্রি হয়ে স্টলগুলোর র‌্যাকগুলো খালি হয়ে যেত। তা হয়নি। রেস্টুরেন্টগুলো তে চেয়ার খালি ছিলনা।

সেখানে কাচ্চি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, হাজির বিরিয়ানি, চাপ-পরেটা, চিকেন গ্রিল ইত্যদি বিক্রেতারা হিমশিম খেয়েছেন ক্রেতাদের সামলাতে। দেখে মনে হয়েছে সব ফ্রিতে পাওয়া যাচ্ছে। শুধু খাওয়ার জন্য আর ছবি তোলার জন্য কেন বইমেলায় যাব?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে শ্রেণিকক্ষে আমাদের শিক্ষকরা নতুন নতুন বই নিয়ে আলোচনা করতেন। জানাতেন, কোন লেখকের কোন বিষয়ের নতুন বই আসছে। কোন প্রকাশনা সংস্থা তা বের করছে। আমরা তখন নোট করে রাখতাম, অপেক্ষা করতাম একুশের বইমেলার। বিদেশী লেখকদের অনেক বই ঢাকায় আসতো শিক্ষকদের হাতে হাতে। আমরা তা একবার হাতে নেবার জন্যে মৌন প্রতিযোগিতা করতাম। আমাদের শিক্ষকরা তা বুঝতেন। ক্লাশে সেই ধরনের বই এনে আমাদের হাতে দিতেন, আবার নিয়ে যেতেন।

এরকম একটা বই পড়তে আমরা চার বন্ধু একবার গিয়েছিলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের বাসায়। তিনি আমাদের তিন ঘন্টা সময় দিয়েছিলেন বইখানা পড়তে। তার বাসায় আমরা আম কাঁঠাল মুড়ি খেয়েছিলাম। পরে স্যার আমাদের সঙ্গে বইখানা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। সেইসব দিন ভোলা যায় না। শুধু বইয়ের টানে কত ঘটনায় জড়িয়েছি।

১৯৮৭ সালের কথা, তখন বাংলা একাডেমির আঙিনায় হতো একুশের বইমেলা। সেই মেলা থেকে আমি দুটি বই কিনেছিলাম। ‘ছোটদের বেগম রোকেয়া ’এবং ‘ছোটদের বঙ্গবন্ধু’। বই দুটি আমি কিনেছিলাম আমার সন্তানদের জন্য। যদিও তখনও আমার বিয়েই হয়নি। আমার দুই মেয়ে স্কুল বয়সে বই দুটি দেখে যার পর নাই খুশি হয়েছে। বই দুটিতেই ক্রয়ের তারিখ এবং লিখে রেখেছিলাম ‘আমার সন্তানদের জন্য।’

মেয়েরা বড় হয়ে দেখেছে তাদের বাবা তাদের জন্মের অনেক আগে এমনকি বাবার বিয়েরও আগে তাদের জন্যে বই কিনে রেখেছে। তারপর দুই মেয়ে ঢাকাবাসী হবার পর থেকেই প্রতিটি বইমেলায় যাবে, পছন্দের বই কিনবে। এখন কি শিক্ষকরা ক্লাসে নতুন বই, আলোচিত বই নিয়ে আলোচনা করেন না? বাবা মায়েরা কি ছেলে মেয়েদের বই পড়তে কিনতে উৎসাহিত করেন না?

বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা প্রকাশকদের জন্য জমে ওঠেনি এখনও। নতুন বই নতুন লেখক - এসবই মেলার প্রাণ। কিন্তু এবার কাগজ কালি ছাপা - এসবের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। কাগজ আর কালি আমদানি করতে হয়। ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা যাচ্ছে না ইচ্ছেমত। ফলে দাম বেড়েছে এসবের।

বিদ্যুৎয়ের কারণে ছাপাখানার খরচ বেড়েছে। নিত্যপণ্যের উচ্চ হারের কারণে বেড়েছে শ্রমিকের মজুরি। সব মিলিয়ে একটা বই করতে খরচ বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। প্রকাশকরা নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে মেলায় স্টল নিয়েছেন। সেখানে নিত্যদিনের একটা খরচ আছে। যাদের জন্য পসরা সাজিয়েছেন, তারা মেলায় আসছেন ছবি তুলতে আর ফুসকা খেতে। এই হচ্ছে অবস্থা।

আমি একাডেমির কর্তৃপক্ষ হলে দর্শকের জন্য পাঁচ টাকার টিকিট করতাম। প্রবেশ মূল্য পাঁচ টাকা, মেলা শেষে এই টাকা স্টলগুলোকে আনুপাতিকহারে ভাগ করে দিতাম। স্টল নির্মাণ খরচটাও কমিয়ে দিতাম। কারণ, প্রকাশকরা করোনার সময় থেকে বিভিন্ন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। শুধু বই ছাপার জন্য আমদানিকরা কাগজের শুল্ক কমানো দরকার।

আরেকটি বিষয়ে বলতে হয়, আমরা যারা প্রযুক্তি ব্যবহার করি তাদের সচেতনতা আনতে হবে এবং নতুনদেরও সচেতন করতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশ ডিজিটাল দেশে রূপান্তর হয়ে স্মার্টের দিকে যাচ্ছে। তাই আমাদের ডিজিটাল ডিভাইস ও ডিজিটাল বইয়ের স্থানান্তরের দিকেও পাঠক, লেখক এবং বিশেষ করে প্রকাশকদের এগিয়ে আসতে হবে। দিন দিন কাগজের দাম যেভাবে বেড়ে চলেছে সামনে কাগজের বইয়ের ইন্ডাস্ট্রির জন্য টিকে থাকা বেশ কঠিন হয়ে যাবে।

বইয়ের আধুনিকায়নে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখনই কাজ শুরু করে দেয়া উচিত। উন্নত দেশগুলোয় যেমন ‘অ্যামাজন’ ই-বুক এবং ‘অডেবল’ অডিও বইভিত্তিক কোম্পানি তৈরি হয়েছে, সময়ের প্রয়োজনে আমাদের সে পথে এগোতে হবে। ই-কমার্সের এ সেক্টরেই এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো কাজ হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগ এলে এই ডিজিটাল বুক স্পেস ভালো অর্থনৈতিক একটি খাত তৈরি করতে পারবে বাংলাদেশে। সেজন্য আমাদের এখন থেকেই ভবিষ্যতের পাঠক নির্মাণে মনোযোগী হতে হবে। বইয়ের ক্ষেত্রে ডিজিটাল সিস্টেম আনতে পারলে নতুন পাঠক সংখ্যাও বাড়বে বলে আশা করা যায়। স্মার্ট বাংলাদেশ সেপথেই অগ্রসর হবে বলে আশা করি।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস

উন্নত দেশগুলোয় যেমন ‘অ্যামাজন’ ই-বুক এবং ‘অডেবল’ অডিও বইভিত্তিক কোম্পানি তৈরি হয়েছে, সময়ের প্রয়োজনে আমাদের সে পথে এগোতে হবে। ই-কমার্সের এ সেক্টরেই এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো কাজ হয়নি। সরকারি ও বেসরকারি যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগ এলে এই ডিজিটাল বুক স্পেস ভালো অর্থনৈতিক একটি খাত তৈরি করতে পারবে বাংলাদেশে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।