প্রতিবেশীর অধিকার ও আমাদের দায়
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে অসুস্থ নারী ও তার দুই যমজ মেয়েকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করার সংবাদ গণমাধ্যমের সুবাদে অবগত হই। সংবাদ বলা হয় ১৫ দিন বাসায় বাজার হয়নি। ছিল না বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনও। এদিনগুলোতে ফ্ল্যাট থেকে প্রায়ই নাকি শিশুদের চিৎকার আর কান্নার শব্দ পাওয়া যেত। তাদের ঘরে খাবার, পোশাক কিছুই ছিল না বলে জানিয়েছে পুলিশ। সংবাদটি পড়ে অনেক কষ্ট পেয়েছি। নিজ থেকেই কেন জানি দু,চোখ বেয়ে অশ্রু বেরিয়েছে।
যখনই এ ধরনের হৃদয়বিদারক খবরগুলো শুনতে হয় তখনই মনে হয় আমরা বোধ হয় সভ্য জগৎ থেকে আজও অনেক দূরে। আমাদের বিবেকগুলোর যেন মৃত্যু হয়েছে।
ইসলামের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, একজন নারী শুধুমাত্র একারণে নরকাগ্নিতে প্রবেশ করেছে, একটি বিড়ালকে সে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত রেখেছিল। অপরদিকে পিপাসার্ত একটি কুকুরকে পানি পান করানোর ফলে এক ব্যক্তি বেহেশত লাভ করেছিলেন। সৃষ্টির সেবা যে কত মহান কাজ, তা উল্লিখিত দু’টি ঘটনা দ্বারা সহজে অনুমেয়। ধর্ম, মানুষের সুখশান্তি ও পথ প্রদর্শন এবং আলোর সন্ধান দেয়। মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে ভালবাসে এবং জীবন ধারণের জন্য একে অপরের ওপর নির্ভর করে। একা কেউই তার নিজ প্রয়োজনিয়তা মেটাতে পারে না। একে অপরের সহায়তা করবে এবং করে থাকে এটাই স্বাভাবিক।
আজ আমরা এতটাই যান্ত্রিক ও আধুনিক হয়েছি যে আমাদের প্রতিবেশীর খোঁজ নেয়ার আমার সময়ই নেই। শিশু সন্তানদের কান্নার আওয়াজ আমার কানে আসছে কিন্তু আমার বিবেক একবারের জন্যও সায় দেয়না খোঁজ নেয়ার। আজ ইট পাথরের দেয়ালের ভীরে আমাদের হৃদয়গুলোও যেন পাথরের মত শক্ত হয়ে যাচ্ছে। যদিও অন্যান্য প্রতিবেশী ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে বাসাটি কোন বাজার করা হচ্ছেনা। কয়েকদিন থেকে কারো যাতায়াত নেই। কিন্তু কেউ একবারের জন্যও তাদের খোঁজ নিতে গেলেন না। আসলে আজ আমরা এতটাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত যে অন্যের সুখ-দু:খের চিন্তার সময়ই নেই।
সৃষ্টিকর্তা আমাদের দু’টো হক আদায় করার আদেশ দিয়েছেন, একটি হল আল্লাহর হক আর অপরটি হল বান্দার হক। ইসলামের শিক্ষা হল, তুমি যা নিজের জন্য পছন্দ কর তা অন্যের জন্যও পছন্দ কর। পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে অন্য কিছুকে শরীক করো না, পিতামাতার সাথে সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, এতিম, অভাবী, আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সহচর, পথচারী ও তোমাদের অধিকারভুক্তদের সাথেও (সদয় ব্যবহার কর)। নিশ্চয় অহংকারী ও দাম্ভিককে আল্লাহ পছন্দ করেন না’ (সূরা আন নেসা, আয়াত: ৩৬)।
এই আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, শুধু নিজের ভাই, আত্মিয়স্বজন, পরিচিতগণ এবং প্রতিবেশী ও অধিনস্তদের সাথে উত্তম ব্যবহার করো না, কেবল তাদের প্রতিই সহমর্মিতা প্রদর্শন করো না আর তাদের সাহায্যের প্রয়োজন হলে কেবল তাদেরই সাহায্য ও যথাসাধ্য উপকার সাধন করো না বরং যাদেরকে এবং যেসব প্রতিবেশীদের তোমরা চেন না, যাদের সাথে তোমাদের কোনো আত্মিয়তা বা উঠাবসার সম্পর্ক নেই, যাদের সাথে তোমাদের ক্ষণিকের পরিচয় হয়েছে মাত্র এদের ক্ষেত্রেও যদি তোমার সহমর্মিতা এবং তোমার সাহায্যের প্রয়োজন পরে, তোমার মাধ্যমে যদি তারা কিছুটা হলেও উপকৃত হতে পারে তবে তাদের সেই উপকার সাধন কর।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘জিবরাইল (আ.) এসে আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অবিরত উপদেশ দিতে থাকেন। আমার এমনটি মনে হল যে, হয়তো তিনি প্রতিবেশীকে সম্পদের ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকার বানিয়ে দেবেন।’ (মুসলিম)
হজরত রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, সে ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট ভরে খায় আর পাশেই তার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে (আদাবুল মুফরাদ)। আবু শুরাইহ থেকে আরেকটি হাদিসে প্রতিবেশীর অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে- রাসুল (সা.) বলেন, 'আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, সে ইমানদার নয়। আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, সে ইমানদার নয়। আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, সে ইমানদার নয়।' তখন হজরত মুহাম্মদকে (সা.) প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর হাবিব, কে সে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদবোধ করে না, সে ব্যক্তি ইমানদার নয় (বুখারি)।
ইসলামের শিক্ষা কতই না চমৎকার। এই শিক্ষার বাস্তবায়ন করলে নিসন্দেহে একটি সুন্দর ইসলামী সমাজ গড়ে উঠবে। আজ আমাদের মনমানসিকতা এমন হয়েছে যে, নিজেদের প্রতিবেশীর কথা তো দূরে নিজ রক্তের সম্পর্ককেও বজায় রাখতে চাই না। সবাই যেন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। অন্যের কোনো উপকারের বা খোঁজ খবর নেয়ার চিন্তা একেবারেই নেই। আমার পাশের ঘরের পরিবারটি যে কষ্টে দিনাতিপাত করছে তার খেয়াল রাখছি না। আমরা যাই করি না কেন আল্লাহতায়ালা কিন্তু সবই দেখছেন, তিনি ঠিকই আমাদের কাছ থেকে এর হিসাব নেবেন।
যদিও গ্রাম-গঞ্জে এখনও লক্ষ্য করা যায় কোন প্রতিবেশীর সমস্যা দেখা দিলে সবাই মিলে এগিয়ে তার পাশে দাঁড়ায়। একেঅপরের বাড়িতে যাতায়াত করে খোঁজ-খবর নেয়। একদিন দেখা না হলেই খোঁজ নিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু শহরে এর ভিন্নরূপ দেখা যায়। পাশের রুমে তার প্রতিবেশী কারা আছেন সেই খবরও হয়তো অধিকাংশ শহরের মানুষ জানে না আর জানার ইচ্ছাও রাখেনা।
একটি হাদিসে এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতায়ালা কিয়ামতের দিন বলবেন, হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম তুমি আমার সেবা শুশ্রূষা কর নি। বান্দা বলবে, হে আমার প্রভু, তুমি সারা বিশ্বের প্রতিপালক আমি তোমার সেবা শুশ্রূষা কীভাবে করতে পারি? আল্লাহতায়ালা বলবেন, আমার উমুক বান্দা অসুস্থ ছিল তুমি তা জানতে পেরেও তার সেবা শুশ্রূষা কর নি। তুমি তার শুশ্রূষা করলে তুমি আমাকে তার পাশে পেতে- এটি কি তুমি জানতে না? হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম তুমি দাও নি। এটি শুনে আদম সন্তান বলবে, হে আমার প্রভু! তুমি তো রাব্বুল আলামীন আমি কীভাবে তোমাকে খাওয়াতে পারি। আল্লাহতায়ালা বলবেন, তোমার কি মনে নেই আমার অমুক বান্দা খাবার চেয়েছিল, তুমি তাকে খাবার খাওয়াওনি। তুমি যদি খাবার খাওয়াতে তাহলে তুমি আমার কাছে এর প্রতিদান পেতে তুমি কি এটি জানতে না।
ছিলাম তুমি দাও নি। এটি শুনে আদম সন্তান বলবে, হে আমার প্রভু! তুমি তো রাব্বুল আলামীন আমি কীভাবে তোমাকে খাওয়াতে পারি। আল্লাহতায়ালা বলবেন, তোমার কি মনে নেই আমার অমুক বান্দা খাবার চেয়েছিল, তুমি তাকে খাবার খাওয়াওনি। তুমি যদি খাবার খাওয়াতে তাহলে তুমি আমার কাছে এর প্রতিদান পেতে তুমি কি এটি জানতে না। হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে পানি চেয়েছিলাম, তুমি আমাকে পানি পান করাও নি। আদম সন্তান বলবে, হে আমার প্রভু! তুমিই তো সারা বিশ্বের প্রতিপালক তোমাকে কীভাবে আমি পানি পান করাতে পারি। এতে আল্লাহতায়ালা বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল কিন্তু তুমি তাকে পানি পান করাও নি। তুমি তাকে পানি পান করালে এর প্রতিদান তুমি আমার কাছে পেতে’ (মুসলিম, কিতাবুল বিরের ওয়াস সিলা,)।
আরেক বর্ণনায়, হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, ‘সকল সৃষ্টিজীব আল্লাহর পরিবার। অতএব আল্লাহতায়ালার কাছে তার সৃষ্টজীবের মাঝে সেই প্রিয়ভাজন যে তার সৃষ্টজীবের সাথে দয়ার্দ্র আচরণ করে এবং তাদের প্রয়োজনের প্রতি যত্নবান থাকে’ (মিশকাত, বাবুশ শাফকাতু ওয়ার রাহমাহ্ আলাল খালক)।
আল্লাহতায়ালার বিধি বিধানের মাঝে ইহসান বা অনুগ্রহ হচ্ছে বড় এক নির্দেশ। তিনি চান, তার বান্দারা যেন একে অপরের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে, সৎ হয়, পবিত্র জীবন যাপন করে, অন্যকে ভালবাসে। কে কোন জাতীর বা কোন ধর্মের তা যাচাই করে ব্যবহার করার কথা বলা হয় নি। সৎকর্মশীল আমরা তখনই হতে পারি যখন আমাদের হৃদয়ে মানবজাতির জন্য অফুরান ভালবাসা সৃষ্টি হবে। এক আল্লাহ প্রেমিকের একান্ত বাসনা এটাই যে, সে যেন আল্লাহতায়ালার প্রকৃত প্রেমিক হতে পারে।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত হুযায়ফা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল করিম (সা.) বলেন, ‘তোমরা অন্যের দেখাদেখি এ কথা বলো না যে, মানুষ আমাদের সাথে সদ্ব্যবহার করলে আমরাও সদ্ব্যবহার করবো। আর তারা আমাদের প্রতি অন্যায় করলে আমরাও তাদের সাথে অন্যায় করব। বরং তোমরা নিজেদের তরবিয়ত এভাবে কর যেন মানুষ তোমাদের সাথে সদ্ব্যবহার করলে তোমরা তাদের সাথে ইহসান করবে। আর তারা তোমাদের সাথে দু্র্ব্যবহার করলেও তোমরা অন্যায় আচরণ করবে না। (তিরমিজি, কিতাবুল বিররি ওয়াস সিলাতি ওয়াল আদাবি)।
কতই না সুন্দর এ শিক্ষা, যা থেকে বুঝা যায়, আমাদের সাথে যদি কেউ সাধারণ নেকীও করে, তাহলে আমিও যেন তার সাথে ইহসান সুলভ আচরণ করি। যে আমার সাথে সামান্য ভাল ব্যবহার করেছে তার সাথে এর কয়েক গুণ বেশি ভাল করতে হবে। আর এখানেই শেষ নয়, বরং বলা হয়েছে যদি আমাদের সাথে কোনো মন্দ আচরণও কেউ করে, তার পরও আমি যেন তার প্রতি কোনো অন্যায় না করি।
মানুষের প্রতি যারা অনুগ্রহশীল, তাদেরকে আল্লাহপাক অনেক ভালবাসেন। হজরত আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল করিম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কেবলমাত্র আল্লাহর খাতিরে কোনো অনাথ ছেলে বা মেয়ে শিশুর মাথায় স্নেহভরে হাত বুলায় তার বিনিময়ে সে সেই শিশুর প্রতিটি চুলের জন্য পুণ্য লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি তার অধীনস্থ অনাথ ছেলে বা মেয়ে শিশু সন্তানের প্রতি অনুগ্রহ করে সেই ব্যক্তি আর আমি জান্নাতে এভাবে থাকব (তারপর রাসূল করিম সা. নিজের দুটি আঙ্গুল এক সাথে মিলিয়ে দেখালেন) (মুসনাদ আহমদ বিন হাম্বল, ৫ম খণ্ড)। প্রতিবেশীর অধিকার আদায়ে ইসলাম অনেক বেশি গুরুত্বারোপ করেছে।
একে অপরের প্রতি দয়া-মায়া, মনুষ্যত্ব আর মানবিকতা আমাদের হৃদয় থেকে যেন ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যাচ্ছে। আসুন, নিজেদের বিবেককে জাগ্রত করি আর সাধ্য অনুযায়ী সৃষ্টির সেবায় রত হই। আমার প্রতিবেশী সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন একজন প্রতিবেশী হিসেবে তার অধিকার আদায় করি, খোঁজ খবর নেই আর তার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলি।
লেখক: কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস