আত্মহত্যা
জীবনকে ভালোবাসুন
সিফাত (ছদ্মনাম) অষ্টম শ্রেণির একজন ছাত্র। মাধ্যমিক স্তর না পেরুতেই একটি মোবাইল না পেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অথচ এই বয়সে একটা সময় মোবাইল কল্পনায় করা যেত না। শখের বসে প্রয়োজন হলেও সিফাতের মোবাইল ফোনটি কি খুব প্রয়োজন ছিল?
সিফাতের কি পরে কোন মোবাইল কিনে দিত না? সিফাত কি পরে আরও সমৃদ্ধ মোবাইল পেত না? আত্মহত্যা কি সিফাতকে মোবাইল কিনে দিয়েছে? সিফাতের আশা কি পূরণ হয়েছে? সিফাত কি পিতা-মাতার জন্য কিছু করতে পেরেছে? সিফাত সমাজের জন্য কি করল? সিফাতকে সমাজের মানুষ মনে রাখবে?
এই উত্তরগুলো আমরা অনেকেই জানি। সিফাত তার নিজের জন্য যেমন কোন কিছু করতে পারে নি, ঠিক তেমনি সমাজের জন্যও কিছু করেনি। সিফাতের আত্মহত্যাটি ছিল নিস্ফল আবেদন। সিফাতকে ঘৃণা ছাড়া প্রশংসার চোখে কেউ দেখবে না। অথচ সিফাতের জীবনে অনেক কিছু করার সময় বা সুযোগ ছিল। সিফাতের জীবনে শুধু মোবাইল নয় অনেক কিছু পাওয়া সম্ভব ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে সিফাতের মত অনেক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ঘটছে এমন দুর্ঘটনা। বিশেষ করে অল্পবয়সী শিক্ষার্থীদের মাঝে এই প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিণত বয়সের আগেই তাদের এই অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত শুধু পরিবারেই প্রভাব ফেলছে না, প্রভাব পড়ছে সমাজে। অথচ এটি কোনো সমস্যা সমাধানের পথ নয়। আত্মহত্যা জীবন বদলে দেওয়ার কোন গল্প নয়। বরং একটি স্বপ্নময় জীবনের অকাল মৃত্যু আত্মহত্যা।
বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তিত্বপূর্ণ জীবনী থেকে জানা যায় সাফল্যের পেছনে হতাশার গল্প। গভীর হতাশায় নিমজ্জিত থেকেও তাঁরা বিশ্বে আজ আলোকিত। তাদের আলোয় আলোকিত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম। তাঁদের জীবনী থেকেই জানা যায়, শৈশবে না পাওয়ার আক্ষেপের কাহিনী। কিন্তু পরিপূর্ণ বয়সে তারা জয় করেছে না পাওয়ার গল্প। তাঁদের এই সফলতার মূলমন্ত্র আমার কাছে ধৈর্য্য। এই সফলতার রহস্য আত্মসচেতনতা। অথচ এই আত্মসচেতনতার অভাবে অকালেই থেমে যাচ্ছে সফলতার গল্প।
যে সময়টা নিজেকে তৈরি করার সময় সেই শিক্ষাজীবনে আত্মহত্যার প্রতিবেদন দেখে আমার মত উদ্বিগ্ন সচেতন সমাজের অনেকেই। জীবনের অনেক অংশ বাকি। কি এমন ঘটনা ছিল যে কারণে এই বয়সে এই পরিণতি? প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে সারাদেশে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ৪৪৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে স্কুল ও সমমান পর্যায়ের ৩৪০ জন এবং কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী ১০৬ জন। এছাড়া বছরজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন।
শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতা; সমাধান কোন পথে?’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে।
জরিপে দেখা যায়, ২০২১ সালেই দেশে ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। যাদের মধ্যে ৬২ জন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ২৩ জন বেসরকারি, ১২ জন মেডিক্যাল কলেজ ও অনার্স পড়ুয়া ও ৪ জন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
এতে জানানো হয়, স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ঢাকা বিভাগে। আর আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ২৮৫ জন এবং ছাত্র ১৬১ জন। এরমধ্যে ৫৪ জন মাদরাসা শিক্ষার্থী।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশের মোট আট বিভাগে আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ ঢাকা বিভাগে এবং সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।
আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, ২৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ অভিমান করে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এদের বড় অংশেরই অভিমান ছিল পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার অন্য কারণগুলোর মধ্যে প্রেমঘটিত কারণও অন্যতম।
প্রেমঘটিত কারণে ২৩ দশমিক ৩২ শতাংশ, পারিবারিক কলহে ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ, হতাশাগ্রস্ত হয়ে ২ দশমিক ০১ শতাংশ, মানসিক সমস্যায় ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ, আর্থিক সমস্যায় ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং উত্ত্যক্ত, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যার পথে ধাবিত হয়েছেন ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।
কেন দিন দিন আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে আর কীভাবেই বা এ থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষা করা যায় সে প্রশ্ন সচেতন সমাজের। আত্মসচেতনতা এই প্রবণতা কমার বড় উপায় বলে মনে হয়। আর এই আত্মসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজন সচেতনতা সভা, প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। নানা কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটলেও জীবন বিসর্জনের এ প্রক্রিয়াকে সমর্থন দিচ্ছে না কোনো ধর্ম। প্রায় সব ধর্মই আত্মহত্যাকে মহাপাপ ও ক্ষমার অযোগ্য বলে ঘোষণা করেছে। সুতরাং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই পাপ কাজ থেকে বিরত থাকাই উত্তম। আসুন আত্মসচেতন হই, সমৃদ্ধ জীবন গড়ি।
লেখক: শিক্ষক।
এইচআর/এমএস