আমার বইমেলা

এতো অনাবিল আনন্দস্রোত আর কোথায় পাওয়া যাবে?

মেহেরুন্নেছা
মেহেরুন্নেছা মেহেরুন্নেছা , কথাসাহিত্যিক ও কবি
প্রকাশিত: ০৯:৪৯ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

কবে থেকে জিজ্ঞাসু মন বইয়ের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিল তা আজ আর স্পষ্ট মনে পড়ছে না। শৈশবে একদিন তড়িঘড়ি করে আব্বা রঙিন মোড়কের একখানা বই হাতে ঘরে ফিরলেন। সেদিন সন্ধ্যায় শুরু হয়ে গেলো আম্মার কাছে আমার প্রথম পাঠগ্রহণ। অ- অজগরটি আসছে তেড়ে, আ- আমটি আমি খাবো পেড়ে; স্বরবর্ণের এমন প্রাথমিক পাঠ সুর করে বিছানার এককোণে বসে পড়তে থাকতাম।

অবশ্য কচি মাথায় কেবলই কিলবিল করতো পঠিতব্য বিষয়ে নানা কৌতূহল। তখনও অজগর দেখিনি, আম্মা বলতেন, অজগর থাকে দূর পাহাড়ের গহীন বনে। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বইয়ের পাতার এই অজগর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এ যেন অজগরের পিঠে চড়ে বাইরের দুনিয়ায় পরিভ্রমণের স্বাদ!

দ্রুত বইটি পড়ে ফেলতে চাইলাম। পরদিনই শুরু হলো ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যঞ্জনা। ক- কাক ডাকে বাঁশের বনে, খ- খোকা পড়ে ঘরের কোনে। আশ্চর্য! এই মধ্য বয়সে এসেও সেই বাঁশবন আর তার ডালে বসে থাকা কালো কাকের প্রতিচ্ছবিখানি যদি এতোটুকুও ঝাপসা হতো! ঘরের কোনে যে খোকা পড়ছিল, তার ছবিখানা হৃদয়মন্দিরে গেঁথে গেছে পোক্তরূপে। তার অবয়ব আজ অবধি এতোটুকুও ম্লান হয়নি।

এরপর শুরু হলো স্কুলজীবন। তখন আমরা হারিকেনের আলো-আঁধারিতে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কাচারিঘরে লজিং মাস্টারের কাছে পড়তে যেতাম। স্কুলের দেওয়া বাড়ির কাজ শেষ করার থাকতো মারাত্মক তাড়া। একের পর এক বাংলা, বিজ্ঞান, ইংরেজি, গণিত, সমাজ বই পাল্টাই আর পড়া তৈরি করি। এদিকে রাতের প্রহর গড়িয়ে চলে ঝিঁঝির কোলাহলে।

মাঝে মাঝে পাশের খাল দিয়ে অচেনা মাঝির নৌকা বাওয়ার মৃদুমন্দ ধ্বনি মনটাকে ব্যাকুল করে তুলতো। ভাবতাম, হয়তো পাশের গাঁয়ের বধূটি নাইয়র যাচ্ছে ঠিক এই নৌকাটিতেই চড়ে। নৌকার সঙ্গে লগির ঘর্ষণের আওয়াজে ধপাস করে লাফিয়ে পড়তো নিভৃতে ঘুমিয়ে থাকা বড় আকারের ব্যাঙ। আমাদের ঢুলুঢুলু চোখেরও অদ্ভুত ছন্দপতন হতো তখন।

তারপর সেদিনের মতো সাঙ্গ হতো বইয়ের সাথের সখ্য। এবার ঘরে গিয়ে দেবো প্রশান্তির ঘুম। কিন্তু কি জানেন, এতোক্ষণ ধরে বিছানায় পিঠ ছোঁয়ানোর যে তীব্র আকাঙ্ক্ষা ভেতরে জমাট বেঁধে ছিল তা নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেছে। আকাশের তারা গুনতে গুনতে সবাই উঠোন পার হচ্ছি। প্রতিদিন উঠোন পার হওয়ার সময় আমার মাথায় ঘুরতো অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের সেই ‘কুটির’ কবিতাখানি। হাত-পা ছুঁড়ে নাচের ভঙ্গিতে আওড়াতে থাকতাম...

‘ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালি নদীর
ওইখানে আমাদের পাতার কুটির।
এলোমেলো হাওয়া বয়,
সারাবেলা কথা কয়,
কুটিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,
নেচেনেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন।’

ঠিক যেন দু’বোনের একজন আমি। ওদের মতো এমন একটা কুটিরে বসবাসের তীব্র ইচ্ছে ভেতরে। আকাশের দ্বিতীয়বার চাঁদটিও আমার নিকট কুটুম।

হায় ফেলে আসা শৈশবের বইগুলো! তারা আজীবনের মৃগনাভি! সেই যে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠলো তা থেকে আজ অবধি বিচ্যুত হইনি, বরং বইয়ের প্রতি ভালোবাসাটা চরমে। বইয়ের সাথে বইমেলাও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে। গড়ে উঠেছে বইমেলার সাথে অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধন।

বই এবং বইমেলা, দুটোই অপার আনন্দের উৎস। সত্যি বলতে কি বইমেলায় সবচেয়ে আন্দোলিত করে যে দৃশ্যটি, সেটি হলো শিশুদের বই নিয়ে উচ্ছ্বাস। তারা বাবা-মায়ের হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে স্টল থেকে স্টলে পছন্দের বই খুঁজতে থাকে। পেয়ে গেলে প্রিয় বইটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারপর উত্তরোত্তর তাদের বইয়ের বায়না দীর্ঘায়িত হতে থাকে। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি! এই নিষ্পাপ শিশুদের আনাগোনাই যেন একুশে বইমেলাকে প্রাণের মেলায় পরিণত করেছে।

ব্যক্তিগতভাবে পড়ার আনন্দের পাশাপাশি লেখালেখির আনন্দটাও উপভোগ করছি। পুরোদমে ‘বইমেলা’ নামক অনবদ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে একাত্ম হয়ে উঠেছি। মানুষকে মানুষের সাথে, দেশকে দেশের সাথে মিলিয়ে দেয় বইমেলা। সমাজ-সংস্কৃতি ও শিল্পকে চেনাতে বইমেলার জুড়ি মেলা ভার। বইমেলার প্রচলন আগে না থাকলেও এখন বইমেলা নিয়ে মানুষের মাঝে প্রভূত উৎসাহ-উদ্দীপনার এক অপূর্ব ছন্দময় হিন্দোল প্রতিধ্বনিত হয়।

বিদ্যোৎসাহীদের সন্ধানী দৃষ্টি নিবন্ধ থাকে একুশের বইমেলা ঘিরে। কারণ বাংলাদেশে বেশ তোড়জোড় ও ঘটা করেই আয়োজন হয় বইমেলার। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে মুক্তধারা প্রথম বইমেলা চালু করে। অবশ্য এটি ছিল তাদের নিজস্ব উদ্যোগে। পরে ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রাতিষ্ঠানিক বইমেলার আয়োজন করে। ১৯৮৫ সাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত বইমেলার নাম দেওয়া হয় ‘একুশে বইমেলা’। বর্তমানে ‘একুশে বইমেলা’ অসাধারণ এক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

লেখক হিসেবে বইমেলার সাথে সেতুবন্ধ আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘বকুল’ দিয়ে। এ পর্যন্ত আমার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা পাঁচ। মূলত লেখক হিসেবে নয়, বরাবর একজন বোদ্ধা পাঠক হিসেবে বইমেলা আমাকে টানে। যদিও কুমিল্লা শহরে থাকার কারণে নিজের মর্জিমাফিক বইমেলায় যাওয়া হয় না। তবুও কিছু মাস্টারপিস অথবা সমকালীন লেখকদের গ্রন্থ তালিকাসহ, প্রতিবছর কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে, ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় পাড়ি দেই ঢাকার উদ্দেশ্যে, একুশে বইমেলার জনসমুদ্রে।

বর্তমানে বইমেলা সংস্কৃতির নানা উপকরণের মধ্যে অনন্য আধুনিক উপকরণ। আন্তর্জাতিক সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রেও এটি অন্যতম ক্ষেত্র। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের নানা দেশে বইমেলা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইতিহাসে বইমেলার গোড়াপত্তন হয় ১৮০২ সালে নিউইয়র্ক শহরে। ম্যাথু কেরির উদ্যোগে এই বইমেলার আসর বসে। আবার ১৮৭৫ সালে একশজন প্রকাশক মিলে নিউইয়র্কের ক্লিনটন শহরে আয়োজন করলেন বইমেলার। সেই বইমেলায় ত্রিশ হাজার গ্রন্থ প্রদর্শিত হয়। আর আধুনিক বইমেলার শুভযাত্রা হয় ১৯৪৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টের বৃহৎ বইমেলার হাত ধরে।

ভিজে মাটির সোঁদা গন্ধের মতো নতুন বইয়ের কচকচে পাতারও কেমন এক মাদকতা আছে। এই মাদকতা নিয়ে বই হয়ে উঠেছে মানব সভ্যতার প্রাণসত্তা। যদিও অনলাইন প্রণোদনা মানুষকে অনেকটাই বইবিমুখ করেছে। সেটা আংশিক সত্য হলেও পুরোপুরি নয়। এখনো মানুষ গ্রন্থ নিয়ে মাতামাতি করে।

উৎসুক মানুষ নতুন বইয়ের প্রচ্ছদে চোখ বুলায়, আকৃষ্ট হয়, পাতা উল্টিয়ে দেখে, তাকে আকর্ষণ করার মতো কিছু আছে কি না তা পরখ করতে থাকে। অতঃপর পছন্দের কাছাকাছি হলে হাতের বইটি কিনেও ফেলে। আমি মনে করি, এই পৃথিবী ধ্বংস হওয়া অবধি মানুষের শুভবুদ্ধি জাগরণের একমাত্র চাবিকাঠি হয়ে থাকবে বই। প্রতিটি গ্রন্থের পাতায় পাতায় মানুষ বর্তমানের সাথে অতীত-ভবিষ্যতের গল্পের নহর বইয়ে দেবে।

বইমেলা যে শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক তা নয়। জেলাশহর ও প্রান্তিক শহরগুলোতেও এখন ক্ষুদ্র পরিসরে বইমেলা হয়, লেখকদের আড্ডা হয়, পাঠকের আড্ডা হয়। লেখক-পাঠকের মধ্যে গড়ে ওঠে হৃদ্যতার আদান-প্রদান।

বইমেলায় যখন যাই তখন মাঝে মাঝে ভাবি, দলবেঁধে মানুষ কেন ছুটে যায় বইমেলায়? আসলে মানুষের গ্রন্থপাঠ এক দুর্নিবার নেশা। এই নেশার ঘোরেই মানুষ বইমেলায় পিঁপড়ের মতো ছুটতে থাকে। বইমেলার চেয়ে মহৎ অনুভবের প্রেরণাস্থল আর কি হতে পারে? এতো অনাবিল আনন্দস্রোত আর কোথায় পাওয়া যাবে? সংসারের সব মালিন্য ক্ষণিকের তরে হলেও মুছে দিতে পারে বইমেলা।

আমার কাছে বইমেলা প্রাণশক্তির অসাধারণ মহড়া। বই কেনা এবং লেখক হিসেবে প্রকাশনীর স্টলে বসার চেয়েও অচেনা এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে বিমোহিত হতে থাকি আমি।

একটা দেশের অগ্রগতির হাতিয়ার বইমেলা।

একটা জাতির কূপমণ্ডূক অন্ধ ধারণা থেকে মুক্তির নিশানা বইমেলা। তারপরেও একুশে বইমেলায় প্রতিক্রিয়াশীলদের সক্রিয়তা এক কঠিন অন্ধকার বৈ কিছু নয়! তারা নৃশংসতা ঘটিয়েছে অবলীলায়। মানুষের মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তায় কুঠারাঘাত করতে এতোটুকু দ্বিধা করেনি এই প্রতিক্রিয়াশীলরা। লেখক হুমায়ূন আজাদ ও ব্লগার অভিজিৎ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তাদের চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়। তাদের অপরাধ তারা স্বাধীন চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।

তবুও আমি প্রতিবারের মতো বইমেলার উচ্ছ্বাসে অবগাহন করতে ছুটে যাবো। স্টল থেকে স্টলে ঘুরে ঘুরে নতুন বই শুঁকতে থাকবো। বিচরণ করবো সভ্যতার জ্ঞানভান্ডারের কিঞ্চিত এই খণ্ডাংশে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কবি।

এইচআর/ফারুক/এমএস

ব্যক্তিগতভাবে পড়ার আনন্দের পাশাপাশি লেখালেখির আনন্দটাও উপভোগ করছি। পুরোদমে ‘বইমেলা’ নামক অনবদ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে একাত্ম হয়ে উঠেছি। মানুষকে মানুষের সাথে, দেশকে দেশের সাথে মিলিয়ে দেয় বইমেলা। সমাজ-সংস্কৃতি ও শিল্পকে চেনাতে বইমেলার জুড়ি মেলা ভার। সকাল দশটায় আপ হবে, লিংক শেয়ার ট্যাগ হবে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।