ঢাকার বিষবায়ু কতদিন টানতে হবে?
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার দূষিত বাতাসের শহরের তালিকা প্রকাশ করে। দিন কয়েক পর পরই এই তালিকায় আমাদের প্রিয় মহানগরী ঢাকার নাম শীর্ষে চলে আসে। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই স্কোর একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের কোনো ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে কি না, তা জানায়।
দীর্ঘমেয়াদি বায়ুদূষণের ফলে নানা রোগে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। এমনকি দূষিত বায়ুর কারণে বাংলাদেশীদের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে প্রায় এক বছর তিন মাস। বিশ্বজুড়ে একযোগে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন এ তথ্যই দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) যৌথ উদ্যোগে গবেষণাটি করা হয়েছিল। গেল তিন বছরে সে পরিস্থিতি তো আরও খারাপের দিকে গেছে। বায়ুদূষণে মৃত্যুর হারের দিক থেকে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, বছরে এ দূষণের কারণে বাংলাদেশে মৃত্যু হয় প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার লোকের।
বায়ুর মান পরীক্ষায় নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (সিএএসই) প্রকল্পের আওতায় ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও বরিশাল শহরে মোট ১১টি কন্টিনিউয়াস এয়ার মনিটরিং স্টেশন (সিএএমএস) স্থাপন করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এর ভিত্তিতে ২০১৭ ও ২০১৮ সালের শেষ কয়েক মাসের উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়। তাতে দেখা যায়, সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে; বিশেষ করে বছরের শেষদিকে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ে। আর বাতাসে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, এর মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২ দশমিক ৫। তার চেয়ে কম ব্যাসের অতিক্ষুদ্র এসব বস্তুকণার সহনীয় মাত্রা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম, যদিও ঢাকার বাতাসে পাওয়া গেছে এর চেয়ে বেশি মাত্রায়।
এসব সূক্ষ্ম বন্তুকণা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণের ফলে সাময়িকভাবে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট, শ্বাসযন্ত্রে প্রদাহ, চোখ জ্বলা ও ফুসফুসের রোগ। তবে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবই বেশি। দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ ছাড়াও ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্নায়ুতন্ত্র, কিডনি, লিভার ও মস্তিষ্কে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে, এমনকি অকাল মৃত্যুও।
বাতাসে কয়েকটি রঙ ও ভাসমান ক্ষতিকর বস্তুকণার (ওজোন গ্যাস, হাইড্রোজেন সালফাইড, সিসা, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড) উপস্থিতির পরিমাণ দিয়ে বায়ুমান জানা যায়। মান ভালো হলে সবুজ, মোটামুটি ভালো হলে হলুদ, কারো কারো ক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর হলে কমলা, সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর হলে লাল, খুবই অস্বাস্থ্যকরের ক্ষেত্রে বেগুনি আর বিপজ্জনক হলে খয়েরি রঙ দিয়ে সূচকে চিহ্নিত করা হয়।
কয়েক বছর ধরে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বসিয়ে মার্কিন দূতাবাস ঢাকার বাতাসে দূষণ ও বিপদের মাত্রা, সেই সঙ্গে তাৎক্ষণিক করণীয় জানান দিয়ে আসছে। যেটির নাম রিয়াল টাইম এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) বা সার্বক্ষণিক বায়ুমান সূচক। বিশ্বে নির্ভরযোগ্য এ যন্ত্রের সূচকে ঢাকার বাতাসে দূষণ বা বিষের অবস্থান মারাত্মক। ২৪ ঘণ্টায়ও সবুজ সূচকে আসছে না বায়ুমান।
এমনকি কমলাতেও না। বেশির ভাগ সময় বায়ুতে অতিবিপজ্জনক উপাদানের উপস্থিতি, যা কিনা চমকে ওঠার মতোই তথ্য। সবচেয়ে বেশি ভাবিয়েছে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারির রেটিং। ওইদিন ঢাকার বায়ুমান ছিল মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর। ওই তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাব অনুযায়ী, সাপ্তাহিক ছুটির ওইদিন সকাল ৮টার দিকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল এক নম্বরে। বায়ুমান সূচকে তখন স্কোর ছিল ৩১৭।
খারাপ বায়ুর শহরের তালিকায় ওই সময় দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ভারতের শহর কলকাতা। তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে ছিল ভারতের মুম্বাই। ওই সময়ে এ দুটি শহরের স্কোর ছিল ১৯৬ ও ১৮৯। তার মানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কলকাতার চেয়ে ঢাকার বাতাসে দূষণের পার্থক্যটা প্রায় দ্বিগুণ!
অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, তীব্র যানজট, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান ও শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ভারী ধাতু যোগ হচ্ছে ধুলার সঙ্গে। ফলে ঘরের বাইরে তো বটেই; বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণীকক্ষ ও খেলার মাঠেও ভেসে বেড়াচ্ছে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা।
রাজধানীকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য ইটভাটা। যেখান থেকে নানা ধরনের সূক্ষ্ম ধূলিকণা ছড়িয়ে যায় বাতাসের সাহায্যে। অবকাঠামো তৈরিতেও কোনো নিময় মানা হয় না। দীর্ঘদিন যত্রতত্র ফেলে রাখা হয় নির্মাণকাজের মাটি, বালিসহ অন্যান্য সামগ্রী। সেই সঙ্গে রাস্তার পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা ময়লা-আবর্জনা থেকেও হচ্ছে বায়ুদূষণ।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য অনুসারে, রাজধানীর বায়ুদূষণের ৫০ ভাগ হয় ইটভাটা থেকে, ৩০ ভাগের উৎস উন্নয়নের নামে চলা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য। এছাড়া ১০ ভাগ আসে গাড়ির জ্বালানি এবং বাকি ১০ ভাগ হয় শিল্প-কারখানার বর্জ্য থেকে। ঢাকার আশপাশে যেসব ভাটা রয়েছে সেগুলোয় ইট পোড়াতে যে মানের কয়লা পোড়ানো হয়, তাতে সালফারের পরিমাণ পাঁচ শতাংশ। অথচ সেটি কেবল ১ শতাংশ থাকার কথা। সেই দূষণ সরাসরি ঢাকার বাতাসে এসে মিশছে।
গাছ ও পানির মাধ্যমে ঢাকার বায়ুর মান বাড়ানোর কথা থাকলেও, পরিবেশ অধিদপ্তরের বিনিয়োগ এক্ষেত্রে খুবই সামান্য। উল্টো বায়ুদূষণের কারণগুলোকে জিইয়ে রেখেই নেয়া হচ্ছে উন্নয়ন পরিকল্পনা। পরিবেশ অধিদপ্তর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও দূষণকারীদের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। কল-কারখানা ও ইটভাটা বায়ুদূষণের প্রধান কারণ হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর দূষণ নিয়ন্ত্রণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা বলতে গেলে শূন্য। এমনকি উন্নয়নের দোহাই দিয়ে দূষণকারীদেরই ছাড় দেয়া হচ্ছে।
রাজধানীর সড়কগুলোয় ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন সকালে দুই সিটি করপোরেশনের কর্মীদের পানি ছিটানোর নিয়ম রয়েছে, কিন্তু সে দৃশ্য একেবারেই বিরল। তাছাড়া নির্মাণাধীন ভবনের ধুলা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের। তারাও সে দায়িত্বটা পালন না করে ঢাকার কলেবর বাড়ানোতেই মনোযোগী।
দূষণের জন্য আমাদের আরামপ্রিয়তারও দায় আছে। কারণে-অকারণে এসি চালাচ্ছি। আর সেই শীতলীকরণ যন্ত্র থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস বায়ুকে দূষিত করছে। আবার বিলাসিতা করে ভিনদেশী যেসব গাছ লাগানো হচ্ছে সেগুলো থেকে কতটুকু কার্বন ডাই অক্সাইড অবজার্ভ হচ্ছে, কতটুকু অক্সিজেন নিঃসরণ হচ্ছে সেটা নিয়েও কোনো গবেষণা নেই। তাহলে কি আমাদের এ বিষবায়ু থেকেই অক্সিজেন টানতে হবে?
লেখক : সাংবাদিক।
এইচআর/এএসএম