ছোট ছোট দল নিয়ে বিএনপির বড় বড় কথা

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৯:৫০ এএম, ২৪ জানুয়ারি ২০২৩

বিএনপি ঘোষণা দিয়ে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়েছে। কেন? বিএনপি মনে করছিল ২০ দলীয় জোটের কারণে বৃহত্তর ঐক্য গঠন করে সরকার পতন ত্বরান্বিত করা হবে। ২০ দলীয় জোটের অস্তিত্ব আর নেই। এখন হয়েছে ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং সমমনা গণতান্ত্রিক জোট অর্থাৎ একজোট ভেঙে তিন জোটকে আন্দোলনের সঙ্গী হিসেবে নিয়েছে বিএনপি। এছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চ নামেও বিএনপির সঙ্গে একটি জোট আছে।

জামায়াতে ইসলামী নামের দলটি বিএনপির স্বাভাবিক মিত্র হলেও এবার জামায়াত বিএনপির সঙ্গে আছে আবার নেই। সব মিলিয়ে হৈ হৈ কাণ্ড রৈ রৈ ব্যাপার। বিএনপির সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে মোট দলের সংখ্যা কেউ বলছেন ৫৪, কেউ বলছেন ৬৬, আবার কেউ বলছেন সংখ্যা হয়তো শতাধিকও হয়ে যেতে পারে। তবে এই মিত্রদের সংখ্যা অনেক হলেও শক্তি কতটুকু আছে তা নিয়ে সংশয় আছে বিএনপির মধ্যেই। সবগুলো দল ও নেতার নাম মনে রাখাও কঠিন। আসলে মিত্র নিয়ে বিএনপি সমস্যায়ই পড়েছে। এত দলকে নিয়ে একমত হয়ে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সহজ কথা নয়। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে বিএনপিতে, গণতন্ত্র মঞ্চেও।

নুর মনে করছেন তার গণঅধিকার পরিষদ অনেক বড় দল হয়ে উঠেছে। বড় দলের সম্মান আদায়ের জন্য গণঅধিকার পরিষদে ভাঙন দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নুর নিজেকে একজন বড় জাতীয় নেতা মনে করলেও অন্যরা তাকে বালক বলেই মনে করছেন। এই অবস্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলন আদৌ গণসমর্থন পেয়ে বেসামাল হয়ে ওঠে কি না দেখার বিষয় সেটাও।

তবে বিএনপি নেতারা আন্দোলন নিয়ে বড় বড় কথা বললেও বাস্তবে দলটি খুব সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন না। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, কোনো স্বৈরাচার সরকার আপসে ক্ষমতা ছেড়ে যেতে চায় না। তাদের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর বিকল্প নেই। অতীতে যেমন ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়েছে। এই সরকারও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় নেবে-এটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র!

এই ধরনের মুখস্থ বক্তৃতা শুনে বিএনপির কর্মীরাও এখন খুশি হন কি না, সেটা আজ এক বিরাট প্রশ্ন। দেশের মানুষ কিছু কিছু ঘটনার জন্য সরকারের ওপর কিছুটা অসন্তুষ্ট থাকলেও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য মানুষ উসখুস করছে, বাস্তবে কি তার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে? ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের মধ্যে বিএনপি কৌতূহল তৈরি করতে পারলেও এখন আর তা নেই। বিএনপি যদি সরকারের নিষেধ অমান্য করে নয়াপল্টনে দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশ করতে পারতো, তাহলে এটা বোঝা যেত যে সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়ার সক্ষমতা বিএনপি অর্জন করেছে। কিন্তু উল্টো বিএনপি সরকারের শর্তেই সমাবেশের জায়গা বদলাতে বাধ্য হয়েছে। সরকারকে অনিবার্বাচিত বা অগণতান্ত্রিক যে হিসেবেই বিএনপি উল্লেখ করুক না কেন, সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার উপায় দলটির নেই।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করছে। সরকার বিএনপির এই দাবি মানবে না। আগেও এই দাবিতে বিএনপি আন্দোলন করে সফল হয়নি। এবারও হওয়ার কোনো কারণ নেই। বিএনপিকে আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে কীভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের পরাজিত করে জয় ছিনিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারেই চিন্তাভাবনা করতে হবে। ভোটাররা যাতে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পারে অর্থাৎ আগামী নির্বাচন যেন সুষ্ঠু ও বিতর্কমুক্ত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা ঠিক যে গত দুটি সংসদ নির্বাচন যেভাবে হয়েছে, আগামী নির্বাচন সেভাবে হবে না। তার মানে আবার এটাও নয় যে আগামী নির্বাচন বিএনপির মনমতো হবে।

আমেরিকাসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকদের দৌড়াদৌড়ি দেখে বিএনপি যদি ভোটের পরিকল্পনা সাজায় তাহলে ভুল করবে। মার্কিন একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা ডোনাল্ড লু ঢাকা সফরে এসে এটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন যে সরকারের সঙ্গে তাদের ভুল বোঝাবুঝি কমে এসেছে। আমেরিকা আবারও বাংলাদেশের কোনো সংস্থার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল তা ঠিক হয়নি। বরং প্রকাশ্যে র্যাবের প্রশংসাই করেছেন লু। আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে আমেরিকার দূরত্ব তৈরির যে গল্প রটানো হয়েছিল এবং যার ওপর নির্ভর করে বিএনপি খুশিতে আটখানা ছিল, তা যে মজবুত গল্প ছিল না তা এখন বোঝা যাচ্ছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলা আমেরিকার পুরনো অভ্যাস। আবার এটাও তো অসত্য নয় যে অতীতে পৃথিবীর অনেক দেশে সামরিক সরকার আমেরিকার সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পেরেছিল। নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে মানবাধিকারের বুলি ভুলতে আমেরিকার সময় লাগে না।

আমেরিকার ওপর বাংলাদেশের যেমন নির্ভরশীলতার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে, তেমনি ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের পাশে থাকা আমেরিকার জন্য স্বার্থসংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ যেন সব বিষয়ে ভারত, চীন ও রাশিয়ার ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে না ওঠে সেটা আমেরিকা নিশ্চিত করতে চায়। বাংলাদেশ একটু ভারসাম্যমূলক কূটনৈতিক অবস্থান বজায় রাখতে পারলে অনেক সংকটই এড়িয়ে চলতে পারবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই ভারসাম্যের কূটনীতিই অনুসরণ করছে।

গণমাধ্যমে এমন সংবাদ-বিশ্লেষণ বের হয়েছে যে ভৌগোলিক অবস্থান, উদীয়মান অর্থনীতি ও বিপুল জনশক্তির বড় বাজার বাংলাদেশকে কৌশলগত কারণে তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতেও পাশে রাখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। আর তাদের চিরশত্রু চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কও তারা অবগত। লুর সফরের আগে চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন গ্যাংয়ের মধ্যরাতে ঢাকায় এক ঘণ্টার যাত্রাবিরতিও আমলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ কোনো বলয়ে থাকবে না স্পষ্ট করলেও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ঐতিহাসিক সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় ভারতের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্ক বজায় রেখেই অগ্রসর হবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। ভারতের কাছেও বাংলাদেশ অগ্রাধিকারের স্থান ধরে রেখেছে।

এছাড়াও মহামারি করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কৌশলগতভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চাপে থাকা যুক্তরাষ্ট্র পরীক্ষিত বন্ধুদের পাশে চায়। আর এ অঞ্চলে এখন ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। তাই বাইডেন প্রশাসনের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ নীতির খুব একটা হেরফের এখনো হয়নি।

বিএনপি রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণের আগে এই সব বাস্তবতা বিবেচনায় না নিলে আগের নির্বাচনের মতোই ভুল করবে। অসংখ্য ছোট ছোট দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে নেমে বড় বড় কথা বলে অযথা উত্তেজনা ছড়ানোর ফল যে ভালো হয় না বিএনপি নেতৃত্ব ১০ ডিসেম্বরের ঘটনায় নিশ্চয়ই সেটা টের পেয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশগ্রহণ না করে তার পরিণতি কি হবে তার একটি ছোট রিহার্সাল সম্ভবত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে হচ্ছে। বিএনপি ছেড়ে আব্দুস সাত্তার ভুঁইয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত আব্দুস সাত্তার ভুঁইয়াকে জিতিয়ে আনার জন্য শুধু আওয়ামী লীগ নয়, স্থানীয় বিএনপি ও জাতীয় পার্টিও এক হয়েছে। বিএনপির জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি শিক্ষা হতে পারে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেও তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত অমান্য করার প্রস্তুতি নেই, সেটা কে বলতে পারে? বিএনপি যে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করলো সেটা তো তারেক রহমানের সিদ্ধান্ত অমান্য করেই। এবার নির্বাচনে অংশগ্রহণ সিদ্ধান্ত নিলে আওয়ামী লীগকে শক্ত চ্যালেঞ্জে ফেলতে পারবে। আর তা না হলে বিএনপিই সম্ভবত আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বিএনপির উচিত হবে বড় বড় কথা না বলে সংগঠন গুছিয়ে নির্বাচনকে আন্দোলন হিসেবে নিয়ে সরকারকেই চাপের মুখে ফেলা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।