স্বামীদের অভিযোগ যদি সত্য হয়!
কখনো কখনো একত্রবাস দুঃসহবাসও হতে পারে। কিন্তু এই সত্যটি মানুষ ততক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বাস করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না থানায় গিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। কোন কোন অভিযোগ মামলা পর্যন্ত গড়ায়। যে মানুষটিকে নিরাপদ ও নিরাপত্তা মনে করে দিনের পর দিন একই ছাদের নিচে বসবাস করেছে; সেই দুটি মানুষই বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য প্রাণপণ মরিয়া হয়ে উঠে।
এই বিচ্ছিন্নতা কোন অন্যায় নয়, অপরাধ নয়, পাপ নয়- দুটো মানুষ যদি বিশ্বাস, ভালোবাসা, বোঝাপড়ায় না মেলে তবে একত্রবাস অর্থহীন। যদিও এই বিচ্ছিন্নতাকে ভালোভাবে দেখে না- সমাজ। সমাজের কথা হলো যাই হোক, যেমনই হোক- একসঙ্গে থাকো।
এই একসঙ্গে থাকলেই তোমরা সুখী, ভীষণ সুখী। আর মাঝে মাঝে ফেসবুকে পিক দিও। সোসাইটির মন রক্ষা করতে গিয়ে, খুশি করতে গিয়ে বহু নারী-পুরুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আমি বহু মানুষদের জানি, বহু দম্পত্তিদের চিনি, যাদের মধ্যে কোন দাম্পত্য সম্পর্ক নেই। যে দুজন মানুষ একত্রে এক বাড়িতে থাকছে অন্ততঃ তাদের দুজনের মধ্যে নেই।
তাহলে এ দুটো মানুষকে কেন একত্রে থাকতে হবে? শুধু তারা হাজব্যান্ড-ওয়াইফ নিজেদের বলতে হবে এই একটি কারণে? নাকি সোসাইটি এখনও সিঙ্গেল বা সিঙ্গেল মাদার, সিঙ্গেল ফাদার- এই টার্মগুলো মেনে নিতে অভ্যস্ত নয়, এই অজুহাতে? অভ্যস্ত না হওয়ার যে অজুহাত তা নিতান্ত অসভ্যতা। চাইলে কেউ একাও থাকতেও পারেন। এটি ব্যক্তির অধিকার। আবার কেউ চাইলে একাধিক বিয়েও করতে পারেন আইন মেনে। এটিও অধিকার, ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব।
লক্ষ্য করলে দেখবেন, আর কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাগজপত্র দরকার হয় না। এই একটিমাত্র সম্পর্কে দরকার সই , কাগজপত্র, সাক্ষী। তার মানে এখানে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবার বা বিচ্ছিন্ন হবার ঝুঁকিও থেকে যায়। এবং এই ঝুঁকিটি স্বাভাবিক ঝুঁকি। কেননা, বিয়ে একটি চুক্তি।
যেকোন সেলিব্রেটির সংসার ভাঙন বা ডিভোর্স নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড়, তির্যক মন্তব্য লক্ষণীয়। কিন্তু তারা সোস্যাল মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ শুধু এই কারণে? মোটেও তা নয়, তোলপাড় আমাদের ‘খাসলত’ এর কারণে। আমরা পরশ্রীকাতর, নিন্দুক, যারপরনাই অসভ্য। অন্যের ঘর ভেঙ্গে গেলে যার ঘর তার চেয়ে আমাদের নিজের মাথাব্যথা বেশি।
এই ব্যথার মাত্রার কারণে এন্টি ডিভোর্স সোসাইটি তৈরি হয়েছে। লোকে মনে করে থাক, ক্ষত নিয়ে থাকি, বাইরে থেকে কে বুঝবে? ফলে ডিভোর্স নেয় না লোকে। অথচ দুঃসহবাসের চেয়ে ডিভোর্স ১০০০ গুণ ভালো। এতে দুজন মানুষের কেবল সম্মানই বাঁচে না, জীবনও প্রাণ পায়, স্বস্তি মেলে জীবনে।
অনেকেই বলবেন, একজন সচেতন সেলিব্রেটি মানুষ কেন এতদিন কিছু বললেন না, মুখ খুললেন না? এতদিন পর এসে কেন ব্যক্তিগত জীবনের ঝাঁপি খুলছেন? সেলিব্রেটি হয়ত একজন মোটিভেটর, ইনফ্লুয়েন্সার, সেটা মানলাম তাই বলে তার ব্যক্তিগত জীবনে কোনো বিপর্যয় ঘটতে পারবে না এমনটি ভাবা অমূলক নিশ্চয়। যারা এই ধরনের কথাবার্তা বলছেন, আমার তো মনে হয় তাদের জন্য স্পষ্ঠভাবে বলা উচিত।
ভাই, যার যার যাপনের অধিকার তার। আর আপনারও যদি মনে হয়, আপনি বৈবাহিকতার দাম্পত্যে অসম্মানিত হচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন, আপনার পরিবার বাবা-মা ছোট হচ্ছে তাহলে সুন্দরভাবে, সম্মানজনকভাবে সরে আসা উচিত সেই সম্পর্ক থেকে। এটা শুধু সেলিব্রেটি কেন নারী-পুরুষ যে কারো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং প্রয়োজন বিচ্ছিন্ন হওয়া।
এই লেখাটি লিখতে লিখতে আমার শ্রদ্ধেয় প্রয়াত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কথা মনে পড়ছে। তিনি নিজে বলেছিলেন, নারী নির্যাতনের যে মামলাগুলো থানায় আসে তার ৬০ শতাংশ মিথ্যা মামলা। আবার পাশাপাশি এই চিত্রও সত্য বহু নারী এখনও গৃহ নির্যাতনের কথা বলেন না, থাকেন মুখ বুজে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, নারী ও শিশু নির্যাতনের যে আইন সেখানে অপচর্চারও সুযোগ রয়েছে।
কোনো মেয়ে থানায় অভিযোগ করলে পুরুষ যত সহসা গ্রেপ্তার হোন নারীদের ক্ষেত্রে তা শিথিল ও ব্যতিক্রম। কখনও কখনও পুরুষের ক্ষেত্রে জামিন দুঃসাধ্য। যেকোন মেয়ে আমাকে ‘করেছে’ বলবার সঙ্গে সঙ্গে একজন পুরুষ সামজিক সম্মানের পাশাপাশি আইনী ভোগান্তির শিকার হতে হয়। কিন্তু এই ‘করেছে’, ‘কি করেছেন’ এ সবের তত্ত্ব তালাস আদালতে প্রমাণ হতে হতে তার জীবনের প্রায় বারোটা বাজে। ঘটে বিপর্যয় জীবনের।
মনস্তত্ত্ব, নারী-পুরুষ সম্পর্ক, যৌনতা, প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের নিয়ে কাজ করেছি দীর্ঘদিন। কাজ করেছি আইন ও শালিশ কেন্দ্রে। যৌনতা ও যৌন সম্পর্কের কাউন্সেলিং করেছি এসএমসির হয়েও। সেই অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি এই অভিযোগগুলো পরস্পর বিরোধী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। যেকোনো স্ত্রী তার স্বামী সম্পর্কে যেকোন মন্তব্য করে বসতে পারেন শ্লীল-অশ্লীল। স্বামীরাও কম যান না।
আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীদের বা স্ত্রীদের অভিযোগগুলোকে আমলে আনি। কিন্তু স্বামীদের অভিযোগগুলো যদি সত্যিই সত্য হয় হবে, তবে সোসাইটির কদর্যতাকে এখনো আমরা এড্রেস করতে পারিনি। হয়ত করছি না পুরুষতান্ত্রিকতার স্বার্থে। মনে রাখতে হবে, নারীও কখনো কখনো পুরুষের অধিক মাত্রায় পুরুষতান্ত্রিক।
আমিতো সোসাইটির দিকে তাকালে, ঘরে ঘরে দেখি- মেয়েরা বিয়ের পরই আলাদা বাসা নেবার জন্য চাপ দেয়, শাশুড়িকে সহ্য করতে পারে না, সংসারের কাজ আয়া বুয়ার কাজ, কোন গ্রামের আত্মীয় এসে শহরের বাসায় থাকা নিষেধ, বয়স্ক শ্বশুর-শাশুড়ি হলে সোজা গ্রামে পাঠাও, প্রতিমাসে পার্লার করতেই হবে, টিট্র করতেই হবে রেস্টুরেন্টে- এসব তো কমন।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারেও তাই। মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তদের খতিয়ান না হয় না দিলাম। কিন্তু তাদের মানসিকতাও কম নিম্ন নয়। কেবল ব্যান্ড শপিং করলে, রেঞ্জ রোভার আর বিএমডব্লিউ চড়লে, আইফোন থারটিন ব্যবহার করলেই মানুষ, মানুষ হিসেবে উচ্চ হয় না। হতে হয় মানবিক গুণ সম্পন্ন।
মাত্র কদিন আগেই আমার এক অতি উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা বন্ধু যার বিলাশবহুল ফ্ল্যাট রেখেও তার মাকে চিকিৎসা করালেন আমার বাসায় রেখে। কারণ একটাই- স্ত্রী, অসুস্থ শাশুড়িকে বাসায় অনুমোদন করবেন না। অশান্তি, তার চেয়ে অন্যত্র রেখে চিকিৎসা সুবিধা ও সম্মানজনক।
সমাজের চিত্র দুঃখজনক। কিন্তু আগুনের মতো সত্য। যে সন্তানকে নিজ হাতে ধরে স্বার্থপর করছেন। প্রাইভেসির অজুহাতে যৌথ পরিবার বিরোধী করছেন। দাদা-দাদী বিরোধী করছেন। ইন্ডিপেনডেন্সির নামে একা একা চলা শিখাচ্ছেন তা আপনার কাছেই ফিরে আসবে। প্রকৃতি বড় ভয়ংকর। সব ফিরিয়ে দেয় সময়মতো। একদিন আপনিই উপেক্ষিত, অপ্রয়োজনীয় হবেন সন্তানদের কাছে।
এসব বলার কারণ, আমি বিশ্বাস করি সত্যিকারের সমতায়, মানুষের অধিকারে। পুরুষও নারী মানবিক বিবেচনায় আমার কাছে একই। পুরুষ বা নারীর মূল্য আমার কাছে উপার্জন আর অর্গানিজমের মেশিন হিসেবে নয়- মানবিকতায়, মনুষ্যত্বে, বন্ধুত্বে, বিশ্বাসে, ভালোবাসায়। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার চোখ থাকতে হবে।
আর ডিভোর্স? সেতো হতেই পারে। আজ সেলিব্রেটির কারও হলে হাসির কিছু নেই। কাল হয়তো হবে আমার বা পরশু আপনার। মনে রাখবেন, জীবন ও যাপন একান্তই যার যার।
লেখক: সম্পাদক, আজসারাবেলা। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র।
এইচআর/এমএস