মুক্তির লড়াইয়ে আসাদ সাহসী পথপ্রদর্শক

এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া , রাজনীতিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৪৮ এএম, ২০ জানুয়ারি ২০২৩

আমরা ভুলে যেতে বসেছি আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের মহানায়কদের! যাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়েই আজকের বাংলাদেশ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার এ পথ পরিক্রমায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান একটি মাইলফলক।

রাজধানী শেরেবাংলা নগর পেরিয়ে মোহাম্মদপুরের প্রবেশ দ্বারে রয়েছে একটি বিশাল তোরণ, যা ‘আসাদ গেট’ নামেই পরিচিত। ‘আসাদ গেট’ নামটি শোনেনি বর্তমান প্রজন্মের কাছে এমন মানুষ পাওয়া দুর্লভ। কিন্তু তাদের অনেকেই জানেন না শহীদ আসাদ কে? কেনই বা এ গেটটির নামকরণ? ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক শহীদ আসাদ স্মরণে নির্মিত আসাদ গেটও আজ মলিন হয়ে গেছে।

শহীদ আসাদ। একটি প্রেরণা, একটি সংগ্রাম আর একটি আদর্শের নাম। যার পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। শহীদ আসাদের নাম জনগণের স্বাধীনতা, জাতীয় মুক্তি, গণতন্ত্র, শোষণমুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের পতাকায় উজ্জ্বল হয়ে লিপিবদ্ধ। ষাটের দশকে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসন, জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন এবং শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার সংগ্রামে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদ শহীদ হওয়ার ঘটনা বাংলার সংগ্রামী মানুষের প্রাণে জাগিয়েছিল অমিত সাহস ও প্রচণ্ড শক্তি।

গণতন্ত্র আর স্বদেশ মুক্তির লড়াইয়ে আসাদ এক সাহসী পথপ্রদর্শক। অন্যদিকে আসাদ আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রেরণার উৎস। আমরা আজ যখন শহীদ আসাদের কথা স্মরণ করি, তখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গণঅভ্যুত্থানের কথা মনে পড়ে। আসাদ শহীদ না হলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হতো না, আসাদের পথ ধরেই মতিউর শহীদ হন।

আসাদের আত্মদানেই সেদিন স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পতন হয়েছিল। সেদিন শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট ছুঁয়ে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সেই চেতনা জনগণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র আর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে গেলে আসাদকে বাদ দেওয়া সম্ভব নয়। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে অনেককেই বাদ দেওয়া হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মকে স্বদেশ মুক্তি আর গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের কথা জানতে হলে আসাদের সম্পর্কে পড়তে হবে, জানতে হবে। কারণ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিপর্বে আসাদ একটি বিরল প্রতিবাদী আর সংগ্রামের নাম। তার স্বপ্ন ছিল জনগণতন্ত্র, যা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শহীদ আসাদ স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার স্বপ্ন দেখতেন। ‘৫২ থেকে ৬৯-এর মধ্যে রাজনীতির ধারা আরও স্পষ্ট হয়েছে, মানুষের চেতনা আরও তীব্র হয়েছে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা আরও পরিচ্ছন্ন হয়েছে।

আসাদ শহীদ হওয়ার কিছুদিন আগেও কৃষক আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে চরমভাবে মার খেয়েছিলেন। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন অসম্ভব সাহসী ও চরিত্রবান বিপ্লবী। শহীদ আসাদ ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) কর্মী ছিলেন। নেতৃস্থানীয় পদেও ছিলেন। আসাদ মনেপ্রাণে বিপ্লবকে ধারণ করতেন। মার্ক্সবাদে বিশ্বাস করতেন সৎ, নিষ্ঠাবান এ মানুষটি। একই সঙ্গে তিনি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন, আবার একই সঙ্গে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক সংগঠনও করতেন। আসাদের জন্ম ১৯৪২ সালের ১০ জুন নরসিংদী জেলার শিবপুর গ্রামে। আসাদের কর্মজীবনের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়।

সেই যে আসাদের আন্দোলনের ধারা, তারই পথ ধরে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ। আসাদের যে স্বপ্ন, জনগণের যে স্বপ্ন বুকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল তার সব কিছুর মধ্যেই গণতান্ত্রিক পূর্ববঙ্গের স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এত বছর পর যখন শহীদ আসাদকে আমরা স্মরণ করি তখন প্রশ্ন জাগে আসাদের স্বপ্ন কি সফল হয়েছে? আসাদের স্বপ্নের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তো আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আসাদের আত্মত্যাগ ছিল শোষণ মুক্তির প্রেরণা। যতদিন শোষণ থাকবে, বঞ্চনা থাকবে, নিপীড়ন থাকবে, ততদিন মৃত্যুঞ্জয়ী আসাদ থাকবে মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে এক সাহসী পথপ্রদর্শক হয়ে।

কারণ আমরা দেখেছি স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর অপশাসন আর ক্ষমতার লোভের কারণে বার বার বাধাগ্রস্ত হয়েছে গণতন্ত্র। শাসকগোষ্ঠীর অপরাজনীতির সুযোগে প্রতিক্রিয়াশীল আর দেশবিরোধীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। যে স্বপ্ন এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ দেখেছে, যার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেই স্বপ্ন লাঞ্ছিত হয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীলদের জয় হয়েছে। কাজেই মুক্তিকামী সমগ্র জাতি আসাদকে স্মরণ করে সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে।

শহীদ আসাদ তাই সব সময় জনগণতান্ত্রিক বাংলা প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে আসেন। ধ্রুবতারার মতোই তিনি বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে। তাই তো শহীদ আসাদ উত্তাল ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আমাদের জাতীয় জীবনে এক গৌরবময় অর্জন। তাই একুশের মতো ঊনসত্তর বাঙালি জাতীয়তা বোধের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। এক একটি শব্দের মধ্যে এসে পুঞ্জীভূত হয়েছে দেশ-জাতির চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষার যত অভিব্যক্তি।

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই সিমিত নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। ৬৯এর গণঅভ্যুত্থান প্রকৃত অর্থে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সোপান রচনা করেছিল। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে ঘরমুখো করেছিল, আর ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সেই বাঙালিকে তার ঘরের ঠিকানা খুঁজে দিয়েছিল। স্বাধিকারের ঢিমেতাল আন্দোলন ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি আসাদের মৃত্যুর পর সহসাই গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। তাই আসাদকে গণঅভ্যুত্থানের নায়ক বলা হয়। ৬৯-এর ধারাবাহিকতায় একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও শহীদ আসাদের চেতনা কখনও ফুরাবার নয়।

৬৯এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে পাকিস্তানের ‘লৌহমানব’ বলে কথিত আইয়ুব খানের একনায়কি শাসনের অবসান ঘটে, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ও পর্লামেন্টারি শাসনের পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিসহ অন্য রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। পূর্ববাংলার নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা, শ্রেণি শোষণমুক্ত ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের চেতনা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।

৬৯এর প্রচণ্ড গতিবেগই বস্তুত ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। এসব বিচারে এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে এদেশের মানুষের সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদবিরোধী সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ’৬৯ একটি বড় মাইলফলক। আসাদ মনে করতেন আমাদের দেশে প্রচলিত গণতন্ত্র হলো শাসক শ্রেণির গণতন্ত্র। তার বিপরীতে কায়েম করতে হবে জনগণতন্ত্র। জনগণের এই গণতন্ত্র বিদ্যমান মুষ্টিমেয় শাসক শোষক শ্রেণির একাধিপত্য অবসান করে সত্যিকার অর্থেই জনগণের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে।

প্রয়াত রাজনীতিক হায়দার আকবর খান রনোর স্মৃতিতে ২০ জানুয়ারি ধরা দিয়েছে এভাবে, ‘সেদিন ১৪৪ ধারা জারি করেছিল আইয়ুব খান সরকার। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যারা মিছিল নিয়ে বেরিয়েছিল, তাদের মধ্যে আসাদ ছিলেন। আমি সে মিছিলে ছিলাম না, কারণ তখন আমি তো আর ছাত্র নই। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, আমার ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনু আসাদের পাশেই সামনের সারিতে ছিল। অল্প কিছুদূর থেকে একটা জিপ থেকে মিছিল লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে পুলিশ, আসাদ শহীদ হন। আসাদ শহীদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটা একটা পুরো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠলো। সারাদেশ যেন নড়ে উঠলো, কেঁপে উঠলো, জেগে উঠলো। অর্জিত হলো বাঙালির নানা অর্জন।’

শহীদ আসাদ স্মরণে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন কালজয়ী কবিতা ‘আসাদের শার্ট’। তাতে কবি লিখেছিলেন—‘আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক;/ আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।’

২০ জানুয়ারি আসাদের জীবন দানের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল ঐতিহাসিক ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। আসাদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। সারাদেশের জনগণ ক্ষিপ্ত হয়েছিল। তারই ধারাবহিকতায় বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে অর্জিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ আর লাল সবুজের পতাকা। লাখ লাখ শহীদের মাঝে সে কারণেই আসাদ অনন্য। তাই প্রয়োজন আমাদের স্বাধীনতার মূল্যবোধ, শপথ নিতে হবে শহীদ আসাদসহ সব শহীদের স্বপ্ন ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার।

আসাদের স্মৃতি ধরে রাখতে আসাদ গেটের সংস্কার ও শ্রীবৃদ্ধি তথা শহীদ আসাদের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ, জীবন সংগ্রামের তথ্য, প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়ে উঠুক সর্বত্রই। আপামর জনসাধারণের এ দাবি সর্বজনীন। যাদের দীপ শিখা হয়ে সামনে চলার পথ দেখায়। তেমনই এক বীর সৈনিক ছিলেন শহীদ আসাদ। ছিলেন নির্ভীক ও স্বাধীনতাপ্রিয়। নিপীড়িত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত বাঙালি জাতির দীপ্ত আলোর মুক্ত আজাদী সংগ্রামের পথ প্রদর্শক ও স্বপ্ন দ্রষ্টা।

আসাদ তাই জনগণের মুক্তির প্রেরণা আর ঊনসত্তর মুক্তির দিশারী। তার শাহাদাত বার্ষিকীতে তাই গভীরতম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক, মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জিকেএস

আসাদের স্মৃতি ধরে রাখতে আসাদ গেটের সংস্কার ও শ্রীবৃদ্ধি তথা শহীদ আসাদের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ, জীবন সংগ্রামের তথ্য, প্রতিষ্ঠানের নামকরণ হয়ে উঠুক সর্বত্রই। আপামর জনসাধারণের এ দাবি সর্বজনীন। যাদের দীপ শিখা হয়ে সামনে চলার পথ দেখায়। তেমনই এক বীর সৈনিক ছিলেন শহীদ আসাদ। ছিলেন নির্ভীক ও স্বাধীনতাপ্রিয়। নিপীড়িত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত বাঙালি জাতির দীপ্ত আলোর মুক্ত আজাদী সংগ্রামের পথ প্রদর্শক ও স্বপ্ন দ্রষ্টা।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।