লিভারের মেট্রো জয়!
ঢাকার তরতরিয়ে বাড়তে থাকা অবকাঠামোর ভিড়ে সর্বশেষ সংযোজন মেট্রোরেল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেদিন মেট্রোর উদ্বোধন করলেন, তার অনেক আগে থেকেই মেট্রোকে ঘিরে বাঙালির উৎসাহ আর উদ্দীপনার পারদ ক্রমাগতই ছিল ঊর্ধ্বমুখি। আর যেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা মেট্রোয় চেপে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পৌঁছালেন, সেদিন মনে হলো যেন সেই উৎসাহের ভলকানিক ইরাপশান হলো, ঠিক যেমনটি আমরা দেখেছিলাম পদ্মায় সেতুটির দুয়ার খুলে যাওয়ার পরপরই।
পদ্মাসেতুর উদ্ধোধনের পরই আমরা লিভারের ডাক্তাররা দল বেঁধে সেতুটি ঘুরে এসেছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের ক্লাস রুমে বসে পদ্মাসেতুর উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানটি বড় স্ক্রিনে দেখতে দেখতেই আমরা ঠিক করেছিলাম যত তাড়াতাড়ি পারি এই সেতু আমরা পাড়ি দিব। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেতুটির উদ্ধোধন ঘোষণার পর ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র টিচাররা কেকটা কেটেই ঠিক করলাম একদমই দেরি নয়।
পদ্মায় প্রথম হবার যে রেস শুরু হলো তাতে আমরাও আমাদের মত করে ঠিক ঠিক ইতিহাসে নাম লিখিয়ে এসেছিলাম পদ্মা সেতু উদ্ধোধনের দু’দিনের মাথাতেই সেতুটি ঘুরে এসে। আমরাই প্রথম বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যারা প্রথম দল বেঁধে পদ্মা সেতু অতিক্রমের কৃতিত্বের জন্য গিনেজ বুকে নাম লিখানোর দাবিটুকু করতেই পারি।
এবার যখন আমাদের প্রিয় দুই আপা মেট্রোর যাত্রী হলেন তখনই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে মেট্রোতেও আমরা আমাদের পদ্মার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবো। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যে আমরা লিভার বিশেষজ্ঞরাই সবার আগে দল বেঁধে মেট্রো চড়ে-ঘুরে আসবো।
যা ভাবা এবারও কাজটাও ঠিক তেমনি। কুয়াশায় ঢাকা শীতের সকালে বাস ভরে দল বেঁধে সবাই হাজির হলাম আগারগাঁও মেট্রো স্টেশনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিশেষজ্ঞরা ছাড়াও সাথে আছেন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপতাল আর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের লিভার বিশেষজ্ঞরা আর আছে লিভারের একদল ছানাপোনা, অর্থাৎ আমাদের ছাত্র আগামী দিনের লিভার বিশেষজ্ঞরা।
সাত সকালেই লোক গিয়ে লাইন ধরে মেট্রোর পাস কেটে রেখেছিল। কাজেই ট্রেনে উঠতে ভিড়ের কারণে খুব বেশি একটা বেগ পেতে হয়নি। বেগ পেতে হচ্ছিল ছবি তোলার হুড়োহুড়িতে। পাসের ছবি তো আছেই, আমাদের দুই আপার মত করে হাতে পাসটা ধরে তার ছবি, সাথে স্বপ্নের মেট্রো রেল ভ্রমণের ব্যানার সামনে রেখে দল বেঁধে সেই ছবি আর বলাই বাহুল্য সেলফির পর সেলফি - যাাকে বলে হুলুস্থুল কাণ্ড। হুড়োহুড়িটা থামলো উত্তরার দিক থেকে মেট্রোরেলটি আগারগাঁও স্টেশনে এসে পৌঁছানোর পর। এরপর যাকে বলে দম বন্ধ অপেক্ষা। ট্রেনটা কখন ঘুরে এই প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাবে আর আমরা শুরু করবো আমাদের স্বপ্ন যাত্রা!
এক সময়, বলা ভালো মিনিট খানেক বাদেই, উপস্থিত হলো সেই মাহেন্দ্র্যক্ষণ। প্ল্যাটফর্মে ট্রেনটা এসে দাঁড়াতেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে গেল মেট্রোর দরজাগুলো। তারপর কি ভাবে কি হলো জানিনা, মুহূর্তেই আমরা নিজেদের আবিষ্কার করলাম মেট্রোর কম্পার্টমেন্টের ভেতরে। মোহাবিষ্টের মত আমরা কখন যেন মেট্রোয় চেপে বসেছি আর মেট্রোও চলতে শুরু করেছে।
কেউ দাঁড়িয়ে তো কেউ বসে সেলফি তোলায় ব্যস্ত। কলকল করছে বিশেষজ্ঞর দল। সবাই যেন সেই শিশুকালে ফিরে গেছে। এ এক অন্যরকম অনুভূতি, যাকে ভাষার গাঁথুনিতে গাথার শক্তি স্রষ্টা আমায় অন্তত দেননি। মেট্রোয় চড়ার অভিজ্ঞতা আমার জন্য নতুন নয়, যেমনটি নয় আমার দলের আরো অনেকেরই।
দেশে না হলে দেশের বাইরে মেট্রো চড়ার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই অনেকবারই হয়েছে। কিন্তু সে তো আর ঢাকাইয়া মেট্রো না- ঢাকার আকাশ চিড়ে শত কিলোমিটারে ছুটছে স্বপ্নের মেট্রোরেল, ভাবা যায়? আর দুপাশের যে ঢাকা শহর, সেও তো একেবারেই অচেনা। এই ঢাকাকে এইভাবে আমরা কেউতো কখনো দেখিনি আগে। আর দেখা তো দূরে থাক, এভাবে মেট্রোয় চেপে ঢাকায় ঘুরবো, দেখবো ঢাকাকে তা ভেবেছিই বা কে কবে?
কোন দিক দিয়ে যে মিনিট দশেক পেরিয়ে গেল বুঝতেও পারলাম না। বোঝার আগেই সুসমাপ্ত স্বপ্নযাত্রার প্রথম পর্ব। উত্তরা উত্তর স্টেশনে আগেভাগেই আয়োজন ছিল হালকা নাস্তার। নাকেমুখে সেই নাস্তা গুঁজে, দৌড়িয়ে কোন মতো মেট্রোয় উঠা ফিরতি যাত্রায়। সাড়ে এগারোটায় বন্ধ হবে স্বর্গের দুয়ার। একটু দেড়িতেই ঘটবে বিপদ। আজকের মত আর মেট্রোয় চেপে ফেরা হবে না আগারগাঁওয়ে। অমন ঝুঁকি নিতে নারাজ দলের প্রতিটি সদস্য। তাই মেট্রোর আজকের মত শেষ যাত্রা শুরুর মিনিট দুয়েক আগেই আবারো মেট্রোয় চেপে বসলাম আমরা সবাই।
লক্ষ্য করলাম যাবার মত ফিরতি পথেও মেট্রোর ঐ কোনার সিটটিতে বসেনি আমাদের দলের কোন সদস্যই। ঐ কোনার সিটটি, এই মেট্রোরই কোন একটি ট্রেনের, কোন একটি বগির, এমনি কোন যে কোনার সিটে চড়ে মেট্রোর প্রথম স্বপ্নযাত্রার যাত্রী হয়েছিলেন আমাদের শ্রদ্ধার দুই আপা।
এমনিতেই তারা আমাদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধেয় আর এমনকি এই দুর্দিনেও, এ জাতিকে একের পর এক উপহার আর উৎসবে মাতার সুযোগ করে দিয়ে তারা আমাদের হৃদয়ে তাদের সেই শ্রদ্ধার আসনটিকে নিয়ে গেছেন আরো অনেক বেশি উচ্চতায়। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই বোধহয় আগে থেকে কোন রকম কোন পরামর্শ ছাড়াই, কোনার ঐ বিশেষ সিটটি খালি রেখে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এদেশের আজকের আর আগামীর লিভার বিশেষজ্ঞদের।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এএসএম