পানি প্রাপ্তির মৌলিক অধিকার ও টেকসই উন্নয়ন

সিরাজুজ্জামান
সিরাজুজ্জামান সিরাজুজ্জামান , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ০৫ জানুয়ারি ২০২৩

প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে পানি অন্যতম, যা ছাড়া জীবের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না। সম্ভব নয় টেকসই উন্নয়ন। এই পানির সঙ্গে মানব জাতির সভ্যতা, উন্নয়ন, রাজনৈতিক মূল্যবোধ, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য এবং সংস্কৃতি জড়িত। অথচ বিভিন্নভাবে এই পানিকেই আমরা ‘মেরে’ ফেলছি। ফলে এরই মধ্যে বিশ্বে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। যেসব জনগোষ্ঠী বা দেশ আগে থেকেই পানির সংকটে ছিল তাদের সংকট আরও প্রকট হয়েছে।

বাংলাদেশ পানির কারণে বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখি। এখানে বর্ষাকালে অতি বৃষ্টির কারণে পানিতে ডুবে যায় অনেক জনপদ, অন্যদিকে গ্রীষ্মকালে অনাবৃষ্টির কারণে দেখা দেয় খরা। নদীদূষণ ও দখলের কারণে নদীর নাব্য কমে যাচ্ছে। ফলে নৌপথও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে পানিতে লবণাক্ততার কারণে সেখানকার মানুষজনের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে। পরিবেশ রয়েছে বিপর্যয়ে।

সুপেয় পানির অভাব বিশ্বব্যাপী। মূলত ভূগর্ভস্থ পানি থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু সেই পানির স্তরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এনিয়ে সরকারের কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা আমাদের চোখে পড়ে না। অপচয় হচ্ছে পানি। বাংলাদেশ ও ইউনাইটেড স্টেটস এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির তথ্যানুযায়ী, একটি ত্রুটিপূর্ণ ফসেট থেকে প্রতি সেকেন্ডে এক ফোটা হারে পানি পড়তে থাকলে তা থেকে বছরে প্রায় তিন হাজার গ্যালন পানির অপচয় হয়, যা দিয়ে একজন মানুষের প্রায় ১৮০ বার গোসল করা সম্ভব।

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যানুযায়ী, দেশে বোরো মৌসুমে সচল থাকে অন্তত ২৫ লাখ অগভীর নলকূপ। আগে ওই নলকূপগুলোতে ১৫ থেকে ২০ ফুট নিচেই পানি মিলতো। কিন্তু বর্তমানে ৪০-৪৫ ফুট নিচেও আগের মতো নিরবচ্ছিন্নভাবে পানি মিলছে না। তাই বাংলাদেশের মতো বৃষ্টিপ্রবণ দেশে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেও ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব।

আমরা সবাই জানি আদি যুগ থেকে মানুষ পানিপ্রাপ্তির নিশ্চয়তাকে ভিত্তি করে বসতি গড়ে তুলেছে। তাই প্রতিটি জনপদের পাশে নদীর অস্তিত্ব দেখা যায়। আজকে বিশ্বে ছোট-বড় নগরগুলো বহমান নদীর পাশে গড়ে উঠেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে নদী রক্ষা করতে পারছে না। তা দখল হয়ে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

অন্যদিকে দূষনের কবলে পরে বেশির ভাগ নদী এখন মৃত। সেখানে আর কোনো মাছ পাওয়া যায় না। শুধু মাছ কেন পানিতে বসবাসকারী সব ধরনের জীব বিলুপ্তির পথে। জীববৈচিত্র্যের ওপর পড়ছে ব্যাপক প্রভাব। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। পানির কারণে আজ জলবায়ুও দূষণের কবলে।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পানি আগ্রাসনের শিকার। আন্তর্জাতিক প্রতিটি নদী একতরফা পানি প্রত্যাহারে ধুঁকছে সবুজ শ্যামল বাংলা। এ কারণে উত্তাল পদ্মা এখন মরা খাল। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও জনজীবনকে বিপন্ন করে তুলেছে, তেমনি মারাত্মক পরিবেশগত বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য হাহাকার আর বর্ষা মৌসুমে বন্যায় ভেসে যাওয়া। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ কমতে থাকার প্রেক্ষাপটে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা চুক্তি হয়। কিন্তু সেই চুক্তির ফলাফল শূন্য। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিপাতের কারণে ফারাক্কা বাঁধের ১০৯টি লকগেটের বেশির ভাগই খুলে দেয় ভারত। এতে বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিমের কয়েকটি জেলায় বন্যা ও নদীভাঙনের সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার ঘরবাড়ি পানিতে ভেসে যায়। মানুষ হয় বাস্তুচ্যুত।

ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকারে পরিণত হয়েছে। হুগলী নদীর উজান স্রোতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের কারণে সুন্দরবন অঞ্চলের বিরাট অংশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, অন্যদিকে এ বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশের একমাত্র ‘ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল’ সুন্দরবন এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সেখানকার প্রধান অর্থকারী গাছ সুন্দরী ধ্বংসের মুখোমুখি।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, সুন্দরবনের ৬০ শতাংশ বনজ সম্পদের এ মূল্যবান বৃক্ষের সঙ্গে গেওয়া, কেওড়া ইত্যাদি গাছ উল্লেখযোগ্য হারে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই পানি ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলা খুবই জরুরি। আবার পানির অপচয় পানির অভাব ও বিশুদ্ধ পানির সংকট মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলছে।

দেশে মূলত বৃষ্টি ও বন্যার পানি খাড়াভাবে মাটির মধ্যদিয়ে (পারকোলেশন বা অনুস্রবণ) ভূগর্ভে প্রবেশ করে ও তার ফলে সেখানে রিচার্জ (পুনঃসঞ্চারণ) ঘটে থাকে। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলে এ রিচার্জ ঘটে প্রধানত বৃষ্টির মাধ্যমে; কিন্তু সেখানে বৃষ্টিপাত কম হওয়ার ফলে পানির স্তর আর পূরণ হচ্ছে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা, গলে যাচ্ছে হাজার বছরের হিমবাহ, বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রের পানির উচ্চতা এবং উপকূলীয় এলাকায় ভূগর্ভে ও ভূ-উপরে লবণ পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক জীববৈচিত্র্য ও স্বাদু পানির উৎস।

ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মেটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। তাই ভূগর্ভস্থ অধিক পানি উত্তোলনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ত পানির কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এ অঞ্চলের গর্ভবতী নারীদের স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। অনেক দিন লবণাক্ত পানি পান করার কারণে ওই এলাকার মানুষের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ যৌথভাবে এ গবেষণা করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৫ গ্রাম লবণ খাওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু উপকূলের মানুষ কিছু ক্ষেত্রে এর ২০০ গুণ বেশি লবণ খায়। বেশি লবণ খাওয়ার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যদি উপকূলের মানুষ কম লবণাক্ত পানি (যেমন বৃষ্টির পানি) পান করে, তাহলে তাদের রক্তচাপ কমিয়ে আনা সম্ভব।

কিন্তু রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং বা বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রাখার মতো বড় কোনো প্রকল্প এখনও কার্যকর করেনি। এসংক্রান্ত দুই হাজারের বেশি অবকাঠামো তৈরি হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এর প্রধান বাধাগুলো হলো উপকূলীয় দুর্গম এলাকায় শিক্ষার অভাব; স্কিম/স্থান নির্বাচনে স্থানীয় প্রভাবশালীদের আধিপত্য; ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, ভূমিহীনদের অবকাঠামো নির্মাণের জায়গার সংকট; দুর্গম এলাকা সঠিক সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ের সমস্যা; নির্মাণ পরবর্তী মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনায় অসচেতনতা; স্থানীয়ভাবে অথবা ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টমিডিয়া প্রচার-প্রচারণার অভাব।

কিন্তু এসব বাধার সবগুলো দূর করা সম্ভব। আর মানুষসহ প্রাণিকূলের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য, সবার জন্য নিরাপদ ও সুপেয় পানি সরবরাহ করার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে সচেতনতা। বিশ্ব আজ টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত। আর টেকসই উন্নয়নের প্রধান একটি নিয়ামক হলো পানির সুষ্ঠু ও সুন্দর ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বনেতাদের আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে উন্নত দেশগুলোকে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

সবার জন্য নিরাপদ ও সুপেয় পানি সরবরাহ করার জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে সচেতনতা। বিশ্ব আজ টেকসই উন্নয়নের দিকে ধাবিত। আর টেকসই উন্নয়নের প্রধান একটি নিয়ামক হলো পানির সুষ্ঠু ও সুন্দর ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বনেতাদের আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে উন্নত দেশগুলোকে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।