নির্বাচনের বছরে স্বাগত

প্রভাষ আমিন
প্রভাষ আমিন প্রভাষ আমিন , হেড অব নিউজ, এটিএননিউজ
প্রকাশিত: ০১:৫৩ পিএম, ০২ জানুয়ারি ২০২৩

নিয়ম অনুযায়ী এ বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যদিও নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তবে এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছেন নির্বাচন হবে আগামী বছরের জানুয়ারির শুরুতে।

জোড় সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভালো করে, এমন একটি প্রচলিত ধারণা থেকেই হয়তো ২০২৪ সালে নির্বাচনের আয়োজন। তবে সময়ের হিসাবে ২০২৩ সালই বাংলাদেশের নির্বাচনের বছর। অবশ্য বাংলাদেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একটু আগে ভাগে বিদায় নেয়া ২০২২ সাল থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য মাঠে বিএনপিকে মোকাবেলায় সংগঠন গোছানো। আর বিএনপির মূল লক্ষ্য আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের চাঙা করা এবং সরকারি দলকে চাপের মুখে রাখা। তবে দুই দলের জন্যই আগামী নির্বাচনটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এখন ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মরিয়া। ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে গিয়ে তারচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগামী নির্বাচন তাই তাদের জন্য অস্তিত্বের প্রশ্ন। এবার নির্বাচনে যাওয়াও তাদের জন্য কঠিন, বর্জন করা আরো বেশি কঠিন।

দীর্ঘদিন শীতনিদ্রায় থাকা বিএনপি বিদায়ী বছরের শেষ দিকে গা ঝাড়া দিয়ে মাঠে নেমেছে। যারা এতদিন বলছিলেন, বিএনপির আন্দোলন করার সক্ষমতা নেই, তাদের মুখে চুনকালি মেখে বিএনপি রাজপথে নিজেদের শক্তির প্রমাণ রেখেছে। দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়া এবং দণ্ড মাথায় নিয়ে লন্ডনে পালিয়ে থাকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনুপস্থিতি সত্বেও বিএনপি ১০ বিভাগীয় শহরে সফল সমাবেশ এবং দেশজুড়ে গণমিছিল কর্মসূটি পালন করেছে।

ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে আগামী ১১ জানুয়ারি গণঅবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ১০ ডিসেম্বর বিভাগীয় সমাবেশকে ঘিরে উত্তেজনায় কারাগারে যেতে হয়েছে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। বারবার জামিন বাতিল করে তাকে আটকে রেখে বিএনপিকে চাপে ফেলার চেষ্টা করছে সরকার। তবে শীর্ষ নেতারা না থাকলেও বিএনপি মাঠ ছাড়েনি।

এরই মধ্যে বিএনপি আন্দোলনের ১০ দফা, রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ২৭ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তবে তাদের দফা আসলে একটি- নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। ২০১৮ সালে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনে গেলেও বিএনপি আবার তাদের ২০১৪ সালের অবস্থানে ফিরে গেছে- বর্তমান সরকারের অধীনে তারা আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। তবে সরকারি দলও কোনোভাবেই সংবিধানের বাইরে কোনো কিছু না করার ব্যাপারে অনড়। তাই বিএনপিকে আন্দোলনের মাধ্যমেই দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে।

বিদায়ী বছরের শেষদিকে চাঙা হলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি আওয়ামী লীগকে দাবি মানতে বাধ্য করার মত আন্দোলন করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় এখনও যায়নি। বিএনপি অবশ্য সরকার বিরোধী সবার সাথে আলাপ আলোচনা করে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছে। ৩০ ডিসেম্বরের গণমিছিলেই ঢাকায় তাদের যুগপৎ আন্দোলনের যাত্রা শুরু করেছে। তবে আদর্শ নির্বিশেষে ডান-বাম সবাইকে নিয়ে এ যুগপৎ আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কা আছে। হয়তো শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতির কারণেই, আন্দোলন নিয়ে, জোট নিয়ে, আন্দোলনের সঙ্গী নিয়ে বিএনপির মধ্যে দ্বিধা-সংশয় রয়ে গেছে।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোট থাকা অবস্থাতেই তারা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে নির্বাচনে ভরাডুবির পর অঘোষিতভাবেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এখন শোনা যাচ্ছে, দীর্ঘদিনের ২০ দলীয় জোটও নাকি অঘোষিতভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

২০ দলের ১১টি খুচরা দল মিলে একটি জোট করেছে। জামায়াতে ইসলামীর সাথে বিএনপির সম্পর্কের সর্বশেষ স্ট্যাটাস নিয়েও ধোয়াশা রয়েছে। বামদের মন জোগাতে জামায়াতের সাথে একটি দৃশ্যমান দূরত্বের কথা বলা হলেও তলে তলে বিএনপি-জামায়াতের প্রেম রয়েছে। বিএনপি ঘোষিত গণমিছিলের সুবাদে অনেকদিন পর জামায়াত মাঠে নামার সাহস দেখিয়েছে। তবে আওয়ামী লীগকে দাবি মানতে বাধ্য করার মত আন্দোলন করতে হলে বিএনপিকে সকল দ্বিধা-সংশয় ঝেড়ে ফেলে সাহসের সাথে মাঠে নামতে হবে।

তবে আমার ধারণা, বিএনপি একটু আগেই আন্দোলনের ট্রেনে উঠে পড়েছে। এ ট্রেন গন্তব্য পর্যন্ত নিয়ে যাওয়াটাই কঠিন। প্রশ্নটা বিএনপির সক্ষমতার নয়। ১০টি বিভাগীয় সমাবেশ সফল হলেও এ সমাবেশকে ঘিরে বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নতুন নতুন সত্য, মিথ্যা, গায়েবী মামলার আসামী হয়েছে। নির্বাচন আরো কাছে এলে সরকার ধরপাকড় শুরু করলে বিএনপির পক্ষে আন্দোলনের মাঠে থাকা কঠিন হতে পারে।

বিএনপি যখন আন্দোলনে ব্যস্ত, আওয়ামী লীগ তখন পুরোপুরি নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গেছে। অনেকদিন পর সরাসরি মাঠে নেমে নৌকার পক্ষে ভোট চাইছেন শেখ হাসিনা। তিনি গত এক যুগে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরছেন। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্নফুলি টানেল অবশ্যই আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট চাইবে। তবে রাজনীতির মাঠে উন্নয়ন খুব বেশি প্রভাব ফেলে না।

আর পরপর দুটি নির্বাচন সহজেই পার পেয়ে যাওয়ায় মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা অনেকটা গা ছাড়া ভাব নিয়ে শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছেন। যদিও শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন, আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। শেখ হাসিনা জিতিয়ে দেবেন, এ আশায় যেন কেউ বসে না থাকে। বিরোধী দলকে মোকাবেলা এবং সংগঠন চাঙা করতে বিদায় বছরের শেষ দিকে আওয়ামী লীগ সংগঠন গোছানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কাউন্সিলের মাধ্যমে সে চেষ্টাই ছিল তাদের। তবে আওয়ামী লীগের প্রধান শত্রু বিএনপি নয়, দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি এখন অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত। সর্বশেষ রংপুর সিটি করপোরেশনে দলীয় প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার ঘটনা আওয়ামী লীগকে বিব্রত করেছে। বিএনপির পক্ষে যেমন আগামী নির্বাচনের বাইরে থাকা কঠিন, আবার আওয়ামী লীগের পক্ষেও আগের দুটির মানের নির্বাচন করে পার পাওয়া দুষ্কর।

একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি এখন দেশী-বিদেশী সব মহলের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানা ছাড়া বিএনপিকে নির্বাচনে আনার আর কোন সূত্র আওয়ামী লীগের হাতে আছে, সেটাই সবার কৌতূহল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানলেও নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে বিএনপিকে বড় রকমের ছাড় দিতে হবে। আওয়ামী লীগ কতটা ছাড় দেবে, কৌতূহল সেটা নিয়েই।

বিদায়ী বছরের শেষ দিকে দুই পক্ষই মাঠে ছিল। তাতে রাজনীতিতে বেশ উত্তাপ এসেছে। তবে আমি আশাবাদী মানুষ। এই উত্তাপের আড়ালে আমি সমঝোতার গোপন সুর বাজতে শুনি। পরিবহন ধর্মঘট, মামলাসহ নানা বাধা সত্বেও বিএনপি তাদের বিভাগীয় সমাবেশ ও গণমিছিল সফলভাবেই করতে পেরেছে। এক বছর আগেও বিএনপির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যে কঠোর মনোভাব ছিল, তা বহাল থাকলে বিএনপির এতদিন ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।

দেশী-বিদেশী চাপে হোক আর বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে উৎসাহী করতেই হোক, আওয়ামী লীগ এখন অনেকটাই নমনীয়। আবার বিএনপিও আওয়ামী লীগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নিজেদের গণমিছিলের পূর্ব নির্ধারিত তারিখ পিছিয়ে দিয়েছিল। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে একটা অলিখিত যোগাযোগের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

আমরা সবাই একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে বিএনপির অংশগ্রহণ লাগবেই। আওয়ামী লীড় কোন শর্তে, কোন সমঝোতায় বিএনপিকে নির্বাচনে আনবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে শুরু হওয়া বছরটি যে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা, উত্তাপ-উত্তেজনায় ঠাসা থাকবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম

আমরা সবাই একটি অংশগ্রহণমূলক, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাই। আর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে বিএনপির অংশগ্রহণ লাগবেই। আওয়ামী লীড় কোন শর্তে, কোন সমঝোতায় বিএনপিকে নির্বাচনে আনবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে শুরু হওয়া বছরটি যে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা, উত্তাপ-উত্তেজনায় ঠাসা থাকবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।