বিজয়ের পাঁচ দশক ও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা
স্বাধীনতা লাভের পাঁচ দশক পর তলাবিহীন ঝুড়ি বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। নানা আন্তর্জাতিক ফোরাম থেকে বাংলাদেশের এই উন্নয়নের প্রশংসা করা হচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উত্তরণের সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ।
আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের মধ্য দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটলো বাংলাদেশের। ৭৫ বছর আগে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তানকে এরই মধ্যে উন্নয়নের সব সূচকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। অনেক সূচকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছি আমরা।
এই ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে অসম্ভব এক বন্ধুর ও কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে হয়েছে বাংলাদেশসহ দেশের মানুষকে। গত পাঁচ দশকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ সম্মানজনক একটি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এই অর্জনের পেছনে যে মানুষটি নিরলস শ্রম ও মেধা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিজয়ের পাঁচ দশক পথপরিক্রমায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত স্বাধীনতা অর্জনের ৭৪ বছরে যে সফলতা অর্জন করতে পারেনি, বাংলাদেশ তা করে দেখিয়েছে মাত্র ৫২ বছরে।
দরিদ্র দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের এক সময় একটি পরিচয় ছিল। বিশ্বের মোট দরিদ্র জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ মানুষ বাস করতো এই বাংলাদেশেই। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে দেশে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করতো সাড়ে ৮২ শতাংশ মানুষ। সেই হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এখন নেমে এসেছে ১১ শতাংশে। বিশ্বের খুব কম দেশই এ সাফল্য দেখাতে পেরেছে। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ দেশ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের কাছে অনুকরণীয় হতে পারে। উন্নয়নের মহাসড়কে ছুটে চলা বাংলাদেশ এখন সাহায্য গ্রহীতা নয়, সাহায্য দাতার কাতারে উঠে এসেছে।
১৯৯৬ সালে প্রথমবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ভিক্ষুকের জাতি হিসেবে দীর্ঘ ২১ বছর পরিচয় পাওয়া বাংলাদেশ অর্জন করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের ক্ষমতার এক যুগ ধরে দেশের মানুষসহ গোটা বিশ্ব দেখছে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে শেখ হাসিনার ম্যাজিক।
৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থাকা শেখ হাসিনা শত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এসময় অর্জন করেছেন বিশ্বের ইতিহাসে দীর্ঘতম সময়ে নারী প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশ পরিচালনার রেকর্ড। সব মিলিয়ে আজ বাংলাদেশ গোটা বিশ্বে এক মর্যাদার নাম।
স্বাধীনতা লাভের পাঁচ দশকে বাংলাদেশ যেসব খাতের ওপর ভর করে এগিয়ে চলছে তার মধ্যে অন্যতম দেশের অর্থনীতি। দেশের সামগ্রিক অগ্রগতির প্রধান সূচক বিবেচনা করা হয় অর্থনীতিকে। অর্থনীতির উন্নতি মানেই দেশের উন্নয়ন। গত এক দশকে বাংলাদেশের স্থিতিশীল জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন, এমনকি মহামারির সময়ও এদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা, মাথাপিছু আয় উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাবাহিকতাকে নির্দেশ করে। বর্তমানে জিডিপির আকার ৪৬০ বিলিয়ন ডলার, ২০২৫ সালে যার আকার হবে ৫০০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আমাদের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১৫.৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৭ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে এ হার প্রায় পাঁচগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশের রপ্তানি পণ্য বলতে ভরসা ছিল শুধু পাট আর চামড়া। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার।
২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ৩ হাজার ৮৭৫ কোটি ডলারের মোট রপ্তানির মধ্যে শুধু পোশাক শিল্প খাত থেকে আয় হয়েছে ৩ হাজার ১৪৬ কোটি ডলার। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে। পৃথিবীতে এখন এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক পাওয়া যায় না।
সারাদেশে ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, দুই ডজনের বেশি হাই-টেক পার্ক ও আইটি ভিলেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। কাজ চলছে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের। ফোর-জি প্রচলনের পর বাংলাদেশ এখন ফাইভ-জি’র যুগেও প্রবেশ করেছে।
১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৪ ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে আমাদের মাথা পিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৮২৪ মার্কিন ডলার, যা পাকিস্তানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ। অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এখন ভারতের চেয়ে এগিয়ে। মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পরপর দুই বছর আমাদের প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ঋণ দিয়েছে এবং সোমালিয়াকে দেওয়া ঋণ মওকুফ করেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ দিতে বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। দেশের সব উপজেলাকে এরই মধ্যে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়।
বর্তমান সরকারের সময়ে স্বাস্থ্য খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। করোনা মহামারির সময় দেশের স্বাস্থ্য খাতের চিত্র বিশ্বে ছিল অনুকরণীয়। শিশু সুরক্ষায় বাংলাদেশ অনেক এগিয়েছে। বাংলাদেশের শিশুরা জন্ম নেওয়ার পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত ৯৭ শতাংশ বেঁচে থাকে। শিশু জন্ম নিতে প্রতি এক লাখ মায়ের মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে ১৭৩ জনের।
ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু অনেক বেশি। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) ২০২২ সালের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ দশমিক ৬ বছর। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তানের গড় আয়ু যথাক্রমে ৬৭ দশমিক ৭ বছর ও ৬৭ দশমিক ৩ বছর।
স্বাধীনতার মাত্র পাঁচ দশকে কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় মাত্র ১ দশমিক ২০ কোটি টন। ২০২০ সালে এ উৎপাদন ৪ দশমিক ২৫ কোটি টনে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়।
সবজি উৎপাদনেও আমরা পৃথিবীর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছি। চীন, ভারতের পরই রয়েছে আমাদের অবস্থান। বর্তমানে আমরা নিজেদের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে সবজি রপ্তানি করছি। পাট উৎপাদনে এখন আমরা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছি। মিঠা পানির মাছের উৎপাদনে ভারত ও চীনের পর তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/ ফারুক/জেআইএম