আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি: চমক নেই, প্রত্যাশা আছে

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ১০:০১ এএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২

গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন অনেকটা জাঁকজমকহীনভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীন দলের সম্মেলনে যতটা জৌলুস থাকার কথা তা এবার ছিল না, দেশের অর্থনৈতিক সংকটের কথা বিবেচনা করে। তাছাড়া দুদিনের সম্মেলনও এবার একদিনেই শেষ হয়েছে। এই দুটি সিদ্ধান্তই ভালো ছিল। অর্থ ও সময়ের অপচয় রোধ করাও এক ধরনের স্মার্টনেসেরই পরিচয়বাহী। আওয়ামী লীগ ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। আওয়ামী লীগের এই সম্মেলন নিয়ে দলের ভেতরে যেমন আগ্রহ ছিল, বাইরেও রাজনীতি সচেতন মহলে তেমনি কৌতূহল ছিল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের পুরনো ও বড় রাজনৈতিক দল। এই দলের সম্মেলন নিয়ে আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক।

কেমন হয়েছে এই সম্মেলন? দলের নেতাকর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের আশা কি পূরণ হয়েছে? নতুন কমিটি কি আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হবে? সম্মেলন সফল হয়েছে সেটা অন্তত সম্মেলনের সুশৃঙ্খলা ও স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে বলা যায়। আমরা যখন ছাত্র আন্দোলনের কর্মী ছিলাম, তখন ছাত্র সংগঠনগুলোর সম্মেলন শেষে কমিটি ঘোষণা করা হলে স্লোগান দেওয়া হতো- নতুন কমিটি কেমন হলো? পাল্টা স্লোগান হতো- বেশ হলো, ভালো হলো। আওয়ামী লীগের এবারের সম্মেলনে মূলত পুরোনো কমিটিই বহাল আছে। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার সম্মতি ও অনুমোদনে যেহেতু নতুন কমিটি ঘোষিত হয়েছে, সেহেতু বলা যায়, কমিটি বেশ হয়েছে, ভালো হয়েছে। শেখ হাসিনা যাদের নিয়ে কাজ করবেন, তাদের তো তিনি নিজের পছন্দ অনুযায়ীই বেছে নেবেন। এটাই স্বাভাবিক এবং তাই হয়েছে। তবে নতুন করে যারা পদপ্রত্যাশী ছিলেন কিংবা যাদের পদোন্নতির আশা ছিল তারা যে কিছুটা হলেও হতাশ হয়েছেন, তা-ও ঠিক। তবে সবার আশা আসলে কেউ পূরণ করতে পারে না। তাই আশা ও হতাশা নিয়েই জীবন এগিয়ে যায়। আওয়ামী লীগও হয়তো এই নিয়মেই এগিয়ে যাবে।

২০২৪ সালের শুরুতেই দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের এই জাতীয় সম্মেলন নিয়ে নানা হিসাব-নিকাশ থাকাই ছিল স্বাভাবিক। দলের সভাপতি পদে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই, তার বিকল্পের কথা কেউ ভাবেনওনি। শেখ হাসিনাই যে আবারও দলের সভাপতি হবেন তা আগে থেকে সবাই জানতেন। তবে সাধারণ সম্পাদক পদে রদবদল হয় কি না তা নিয়ে কিছুটা কৌতূহল থাকলেও ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে সম্মেলেনের আগেই মোটামুটি হওয়া গিয়েছিল যে সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদের হ্যাটট্রিক করবেন। আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে দশম বারের মতো সভাপতি ও ওবায়দুল কাদেরকে তৃতীয় বারের মতো সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মোট পদের সংখ্যা ৮১। সম্মেলনে ৪৬ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের নতুন কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন না থাকলেও সভাপতিমণ্ডলী থেকে পুরোনো তিনজন সদস্য বাদ পড়েছেন, নতুন যোগ হয়েছেন একজন। বাদ পড়ারা হলেন মধ্যে নুরুল ইসলাম নাহিদ, আবদুল মান্নান খান ও রমেশ চন্দ্র সেন। অবশ্য নুরুল ইসলাম নাহিদ ও আব্দুল মান্নান খান উপদেষ্টামণ্ডলীতে ঠাঁই পেয়েছেন। ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনকে নতুন করে সভাপতিমণ্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সভাপতিমণ্ডলীর দুটি পদ খালি আছে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর পদের সংখ্যা ৩৪। এর মধ্যে শ্রমবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ এবং যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশীদ বাদ পড়েছেন। এই দুজনও উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য হয়েছেন। ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দীকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ হারিয়েছেন সাখাওয়াত হোসেন শফিক। অন্যদিকে সুজিত রায় নন্দীর পদে এবার জায়গা পেয়েছেন উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম। উপপ্রচার সম্পাদকের পদটি ফাঁকা আছে।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের চারটি পদে আগের চারজনই আছেন। তবে এক নম্বর পদে রদবদল হয়েছে। এক নম্বরের মাহবুবউল আলম হানিফ দুই নম্বরে গেছেন। দুই নম্বর থেকে এক নম্বরে উঠেছেন ড. হাছান মাহমুদ। কোনো পরিবর্তন নেই। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে শুধু একটিই পরিবর্তন। আর ২৮ সদস্যের নির্বাহী সদস্যের কারও নাম ঘোষণা করা হয়নি।

বলা হচ্ছে আগামীতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ আছে সরকার ও দলের সামনে। একদিকে অর্থনৈতিক সংকট, তার ওপর বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ করার জন্য আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ– এসব কিছু বিবেচনা করে আওয়ামী লীগের এবারের নতুন কমিটি নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের মধ্যে পদ-পদবি নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হলে তার প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। দল গোছানোর বিষয়টি মাথায় রেখেই শেখ হাসিনা এবার তার পুরোনো টিমমেটদের ওপরই আস্থা রেখেছেন। সম্মেলনের পরদিন শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে যারা গণভবনে গিয়েছিলেন তাদের উদ্দেশ্য করে নিজের আবেগ ও উদ্বেগের কথা কিছু বলেছেন। তার যেহেতু বয়স হয়েছে সেহেতু নতুন নেতার কথা ভাবতে বলেছেন। আবার এটাও বলেছেন, সংগঠনটা যেন ঠিক থাকে, চলতে থাকে, সেই ব্যবস্থাটাও করতে হবে।

শেখ হাসিনা আর যে কথাটি বলেছেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশের তৎপরতার দিকে নজর রেখেই সম্ভবত বলেছেন, কেউ যদি খুব স্বাধীনচেতা হয়, তাহলে অনেকেই তাদের পছন্দ করে না। অনেক বড় বড় দেশ, আমাদের স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনো এটা পছন্দ করবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো নেতাদের নিয়েই আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি হয়েছে কি না? আওয়ামী লীগ সম্পর্কে, এই দলের নেতাকর্মীদের সম্পর্কে শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি ভালো আর কেউ জানেন না। কমিটিতে যারা আছেন, তারা সততার পরীক্ষায় সবাই উত্তীর্ণ, তা হয়তো নয়। অচেনা সাধুর চেয়ে চেনা দুর্বৃত্তের সঙ্গে চলাই হয়তো শেখ হাসিনা শ্রেয় মনে করেছেন। তবে একটি বিষয়ে শেখ হাসিনাকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে। সেটা হলো, যাদের মুখে শেখ ফরিদ ও বগলে ইট– তাদের ব্যাপারে নমনীয়তা দেখানো চলবে না। সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে একজন জেলা প্রতিনিধি তার বক্তৃতায় বলেছেন, দলের কেউ কেউ অন্তঃপ্রাণ হিসেবে নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছেন, আর কেউ দল বিক্রি করে খাচ্ছেন।

যারা দল বিক্রি করে খাচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করতে হবে। নির্বাচনের আগেই যদি তাদের আলাদা করা না যায়, তাহলে কিন্তু লড়াইয়ে জেতা কঠিন হবে। যারা নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে দুর্বল তারা বিপদ দেখলে সটকে পড়বে আগে। তাই যারা দল অন্তঃপ্রাণ তাদেরই কাছে টানতে হবে। কঠিনকেই ভালো বাসতে হয়, কারণ সে কখনো বঞ্চনা করে না।

গত ১৬ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, কত স্লোগান- বঙ্গবন্ধু তুমি আছো যেখানে, আমরা আছি সেখানে। অনেক স্লোগান তো হচ্ছিল। কোথায় ছিল সেই মানুষগুলো? একটি মানুষ ছিল না সাহস করে এগিয়ে আসার? একটি মানুষ ছিল না প্রতিবাদ করার? কেন করতে পারেনি? দলের নেতাকর্মীদের নীরব ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এত বড় সংগঠন, এত লোক, কেউ তো একটা কথা বলার সাহস পায়নি। ১৫ আগস্ট, ১৬ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর লাশ ওই ধানমন্ডিতে পড়ে ছিল।

সেই দিনের ভয়ংকর দিনগুলোর কথা ভুলে যাননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতা-গ্রহণযোগ্যতা আছে বলেই নেতাকর্মীদের এতো ভিড়-স্লোগান। তাই আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে যন ষড়যন্ত্র না হয় সেজন্য প্রায় একই কমিটি করেছেন তিনি। যাতে নির্বাচনের আগে অন্তত দলের মধ্যে কোনো বিবাদ সৃষ্টি না হয়। আর বাইরের কেউ এর ফায়দা লুটতে না পারে। পাশাপাশি পুরোনো নেতারাও আওয়ামী লীগে ফিরছেন। এরইমধ্যে বিভিন্ন কারণে যেসব নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। সামনে নির্বাচনে শেখ হাসিনার দুটি লক্ষ্য- আওয়ামী লীগের ঐক্য এবং জনগণের সমর্থন।

সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের জনসমর্থন আছে। তারা যেন ভোট দেয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের জন্য কাজ করবেন। তাদের পাশে দাঁড়াবেন। সেবা করবেন। এটা আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের আশা।

আওয়ামী লীগার হয়েও যারা দলীয় প্রধানের এসব পরামর্শ না শুনে মানুষের আশার খেলাপ করছেন বা করবেন তাদের কঠোর হাতে দমন করার বিকল্প নেই। শেখ হাসিনার প্রতি মানুষের যে আস্থা ও ভরসা সেটা কিন্তু আওয়ামী লীগের প্রতি নেই। আওয়ামী লীগের চেয়ে শেখ হাসিনা বেশি জনপ্রিয়, এটা স্তাবকতা নয়, বাস্তবতা। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার সমান জনপ্রিয়তা নিয়ে শেখ হাসিনার পেছনে নয়, পাশাপাশি চলুক – এটাই এই দলের শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রত্যাশা।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম

সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের জনসমর্থন আছে। তারা যেন ভোট দেয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের জন্য কাজ করবেন। তাদের পাশে দাঁড়াবেন। সেবা করবেন। এটা আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের আশা। আওয়ামী লীগার হয়েও যারা দলীয় প্রধানের এসব পরামর্শ না শুনে মানুষের আশার খেলাপ করছেন বা করবেন তাদের কঠোর হাতে দমন করার বিকল্প নেই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।