যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন : মানবপ্রেমে উৎসারিত

ড. মিল্টন বিশ্বাস
ড. মিল্টন বিশ্বাস ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ২৫ ডিসেম্বর ২০২২

আজ ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মহাআনন্দের দিন। আজ যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সংকটের মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০০ কোটি খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর মাঝে এসেছে মানবপ্রেমের দিশারি মহামানবের আবির্ভাব তিথি। কিন্তু দুটি দেশের যুদ্ধ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এবং সেই সংকট মানুষকে মানুষে মানুষে একত্রিত হতে নিষেধ করলেও খ্রিস্টের বাণী আজ জয়যুক্ত হচ্ছে সর্বত্র।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবন নাভিশ্বাসে চড়লেও বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র এগিয়ে এসেছে, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের মানুষ বিপন্ন হলেই তাদের খোঁজ নিচ্ছে, সহায়তা দিতে সাহসী ভূমিকা রাখছে- পরোপকারী একদল মানুষ দিনরাত যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের সেবা দিয়ে নির্ভীকভাবে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ফ্রন্টলাইনের সেসব মানুষ- তথা ডাক্তার-নার্স এবং অন্যান্য যোদ্ধারা প্রকৃতপক্ষে মহামানবের দেখানো পথে হাঁটছেন।

প্রভু যিশু খ্রিস্টঠিক ২০২১ বছর আগে ঈশ্বরে বিশ্বাস রেখে কুষ্ঠরুগীকে স্পর্শ করেছিলেন; অন্ধ এবং মৃত মানুষকে সুস্থ ও জীবন দান করে মানবসেবার মহিমা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। দেশ-বিদেশে মানুষের জন্য অপর মানুষের যে কান্না শোনা যাচ্ছে, দানের ইতিহাস রচিত হচ্ছে, তা পবিত্র আলোয় স্নাত করে দিয়েছে সভ্যতাকে। আর সেখানেই আছে মানবপ্রেমের নেতা যিশুর বাণী।

যিশু পাপের শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ঘৃণা নয়, ভালোবাসো। ভালোবাসো সবাইকে, ভালোবাসো তোমার প্রতিবেশীকে, এমনকি তোমার শত্রুকেও। মানুষকে ক্ষমা করো, তাহলে তুমিও ক্ষমা পাবে। কেউ তোমার এক গালে চড় মারলে তার দিকে অপর গালটিও পেতে দাও।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করো। গরিব-দুঃখীদের সাধ্য মতো সাহায্য করো, ঈশ্বরকে ভয় করো।’

সারাবিশ্বে সাংস্কৃতিক ও জাতীয় ঐতিহ্যগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বড়দিন উৎসব উদযাপনের রূপটিও ভিন্ন হয়ে থাকে। উপহার প্রদান, সংগীত, খ্রিস্টমাস কার্ড বিনিময়, গির্জায় ধর্মোপাসনা, ভোজ এবং খ্রিস্টমাস ট্রি, আলোকসজ্জা, যিশুর জন্মদৃশ্য অঙ্কন এবং ‘হলি’ সমন্বিত এক বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার প্রদর্শনী আধুনিককালে বড়দিন উৎসব উদযাপনের অঙ্গ।

২০২০ ও ২০২১ সালের করোনা কবলিত সময়ের বড়দিনের উৎসব থেকে এবার সবকিছুই ভিন্ন। ২০২২ সালে এই দিনটি উপলক্ষে আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক-বড়দিন উৎসব করলাম। সেখানে মাত্র ৪ জন শিক্ষকসহ ৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইমদাদুল হক ও ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীন আহমদের উৎসাহে আমরা সেই অনুষ্ঠান সুন্দর করে উদযাপন করেছি।

এরপর ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভেচ্ছা বিনিময়। আর বড়দিনের দিনটি আন্দনঘন হচ্ছে মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতের সময়। আসলে শান্তি ও কল্যাণের বাণী নিয়ে প্রভু যিশুর এই আগমনী দিনটিকে উদযাপন করতে নানা আয়োজন করা হয়। সারাবিশ্বের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মতো বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও দিনটি পালন করে আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে।

বড়দিনের বেশ কিছুদিন আগ থেকেই শুরু হয়ে যায় যিশুকে বরণ করে নেওয়ার প্রস্তুতি। প্রস্তুতি দুই ধরনের আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক। আধ্যাত্মিক প্রস্তুতি হলো ঈশ্বরের কাছে পাপের ক্ষমা চেয়ে পাপের জন্য অনুতাপ করা এবং কারও সঙ্গে বিরোধ থাকলে তা মিটিয়ে ফেলে নিজেকে প্রস্তুত করা। আর বাহ্যিক প্রস্তুতি মানে তো আলোকসজ্জা ও সাজ সাজ রব। সকাল থেকেই গির্জায় সমবেত হন ভক্তরা। যিশুর আশীর্বাদ ও বিশ্বের কল্যাণের জন্য প্রার্থনায় অংশ নেন তারা।

বড়দিনের অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় ঘরবাড়ি পরিষ্কার করা, বিভিন্ন ধরনের পিঠা বানানো, কেক বানানো আর নতুন জামাকাপড় বানানোর ধুম। এছাড়া আছে বড়দিনের কীর্তনের রিহার্সেল, নাটকের রিহার্সেল আর বড়দিনের বিশেষ ম্যাগাজিন স্বর্গমর্ত ও প্রতিবেশি ছাপার কাজ। বড়দিনের আগের রাতে এবং বড়দিনের সকালে গির্জায় বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠান (খ্রিস্টযোগ) হয়। এদিন সব বাড়িতেই থাকে কেক, পিঠা, কমলালেবু, পোলাও-বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু ও উন্নতমানের খাবারদাবারের আয়োজন।

২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে গির্জায় গির্জায় বেড়ানো, অতিথি আপ্যায়ন আর আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়েই কেটে যায় খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে আনন্দের দিন, বড়দিন। সবাই একে অপরের সাথে বড়দিনের প্রীতিপূর্ণ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের আয়োজন নিয়ে চলে মিডিয়ার সম্প্রচার।

রাজধানীর বিভিন্ন গির্জার প্রার্থনা, আর রাজধানীর তারকা হোটেলগুলোর বিশেষ আয়োজনের ব্যবস্থা সত্যিই নান্দনিক হয়ে ওঠে। তবে হোটেলগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে শিশু-কিশোর। সেখানে সান্তাক্লজ ও ক্রিসমাস ট্রি আলোকমালায় বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। ২০২২ সালের বড়দিনে এসব আয়োজন আলো ছড়াবে, যিশুর জন্মদিন বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে মানুষকে আলোড়িত করবে। কারণ খ্রিষ্টের জন্ম ও জীবন আলোর সঙ্গে জড়িত।

দুর্যোগ ও সংকট মোকাবেলা করে আমরা স্মরণ করছি যিশু খ্রিস্টের জীবনকে। জেরুজালেমের বেথলেহেম শহরের এক গোয়ালঘরে জন্ম হয়েছিল একটি শিশুর। শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল ‘‘ইম্মানুয়েল’’ অর্থাৎ আমাদের সঙ্গে ঈশ্বর। আমাদের ত্রাণকর্তা এই শিশুটি কিন্তু মোটেও সাধারণ শিশু ছিলেন না। শিশুটির জন্ম হয়েছিল ঈশ্বরের প্রভাবে মারিয়ার গর্ভে।

মারিয়ার স্বামী কাঠমিস্ত্রী যোসেফ ছিলেন যিশুর পালক পিতা মাত্র। এই শিশুটি আসলে ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র। পৃথিবী যখন পাপে পরিপূর্ণ, ঈশ্বর তখন তাঁর একমাত্র পুত্রকে মানুষরূপে পৃথিবীতে পাঠালেন মানব জাতিকে পাপের পথ থেকে উদ্ধার করতে, শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করতে। রাতের বেলা বেথলেহেমের মাঠে ভেড়া চড়াচ্ছিল একদল রাখাল।

যিশুর জন্মের পরপরই স্বর্গদূতেরা এসে তাদের বললেন, ওই গোয়ালঘরে তোমাদের উদ্ধারকর্তা জন্মেছেন, যাও তাঁকে শ্রদ্ধা জানাও এবং ঈশ্বরের প্রশংসা করো। রাখালেরা তা-ই করলেন। যিশুর জন্মের পরপরই আকাশের বুকে ফুটে উঠেছিল একটি বিশেষ তারা।

পূর্বদেশের পণ্ডিতেরা সেই তারা দেখে বুঝতে পারলেন, পৃথিবীতে সেই মহান রাজার জন্ম হয়েছে, ঈশ্বর যাঁকে পাঠানোর কথা বলেছিলেন মানবজাতির মুক্তির জন্য। পূর্বদেশের তিন পণ্ডিত বহু দূরদেশ থেকে বেথলেহেমে রওনা হলেন তাঁদের রাজাধিরাজকে শ্রদ্ধা জানাতে।

যিশু নামের সেই শিশুটি বড় হয়ে উঠলেন মানুষের মনের রাজা হয়ে। পাপ থেকে মুক্তির আলো হয়ে। স্রষ্টার প্রেরিত পুরুষ হিসেবে মুসলমানরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমান সরকার এই সম্প্রীতি রক্ষায় সচেষ্ট, যদিও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা জঙ্গিবাদের তৎপরতাকে নিশ্চিত করছে। তবে খ্রিষ্টানসহ প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় স্বাধীনতা ও অধিকার যাতে ভোগ করতে পারে বর্তমান সরকার সে ব্যবস্থাই করবে- এটাই এবারের বড়দিনে সকলের প্রত্যাশা।

লেখক : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
[email protected]

এইচআর/এমএস

সারাবিশ্বে সাংস্কৃতিক ও জাতীয় ঐতিহ্যগত পার্থক্যের পরিপ্রেক্ষিতে বড়দিন উৎসব উদযাপনের রূপটিও ভিন্ন হয়ে থাকে। উপহার প্রদান, সংগীত, খ্রিস্টমাস কার্ড বিনিময়, গির্জায় ধর্মোপাসনা, ভোজ এবং খ্রিস্টমাস ট্রি, আলোকসজ্জা, যিশুর জন্মদৃশ্য অঙ্কন এবং ‘হলি’ সমন্বিত এক বিশেষ ধরনের সাজসজ্জার প্রদর্শনী আধুনিককালে বড়দিন উৎসব উদযাপনের অঙ্গ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।