চীনের পতনোম্মুখ অর্থনীতি ও ঋণগ্রহিতা দেশগুলি

মহসীন হাবিব
মহসীন হাবিব মহসীন হাবিব
প্রকাশিত: ১০:০৯ এএম, ২০ ডিসেম্বর ২০২২

চীনের অর্থনীতি যেমন করে উপরের দিকে উঠেছিল, তারচেয়েও দ্রুত গতিতে নিচের দিকে নামতে শুরু করেছে। এটি অনেক দেশের জন্যই একটি অশনি সংকেত যারা চিনের কাছ থেকে অর্থঋণ গ্রহণ করেছে। বিষয়টি যদি এভাবে দেখা যায় যে আপনি একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ধার নিলেন, কিন্তু দেখা গেল সেই ব্যবসায়ী হঠাৎ নানা কারণে নগদ অর্থ সংকটে পড়েছে। সে ক্ষিপ্র হয়ে উঠবে আপনার কাছ থেকে সুদে আসলে,কড়ায় গণ্ডায় অর্থ আদায়ের জন্য। সে বাস্তবতার কথা পরে আসছি।

সংক্ষেপেই বলি। এখন থেকে চার দশক আগে চীন ছিল বিশাল জনসংখ্যার একটি দরিদ্র দেশ। কঠিন শাসন, অদক্ষ প্রশাসন নিয়ে চীন বিশালদেহি একটি অসুস্থ হাতির মতো ছিল। উপায়ন্তর না দেখে চীন অর্থনৈতিক সংস্কার করতে বাধ্য হয়। ১৯৭৮ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ইলেভেনথ সেন্ট্রাল কমিটি দেঙ জিয়াও পিঙের সংস্কার অনুমোদন করে এব! ১৯৭৯ সালে তা বাস্তবায়নে যায়। বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনীয়োগ উন্মুক্ত করে, মুক্তবাজার নীতি অবলম্বন করে। চীনের অর্থনীতি সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে।

চীনের ফরেইন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট শুরু হয় ৯০ দশকে। ২০০৭ সালে চীনের প্রবৃদ্ধির হার দাড়ায় ১৪.২ শতাংশে। ২০১০ সালেই চীনে ৪৪৫,২৪৪ এন্টাাপ্রাইজ তালিকাভুক্ত হয়, যাতে চিনের সাড়ে ৫ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এ সময়ের মধ্যে ৮০ কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমার নিচ থেকে টেনে তোলে। জাপানকে পেছনে ফেলে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়।

এ সময় তারা অধিক উচ্চাকাঙ্খি হয়ে ওঠে। ২০১৫ সালে চীন ‘মেইড ইন চায়না-২০২৫’ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এর অধীনে চীন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ বা উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পায়নের নীতি গ্রহণ করে। ইলেকট্রিক কার, নেক্সট জেনারেশন ইনফরমেশন টেকনোলজি, টেলিকমিউনিকেশন এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, কৃষি প্রযুক্তি, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরি, বায়ো-মেডিসিন, অত্যাধুনিক রেলওয়ে অবকাঠামো এবং উচ্চ প্রযুক্তির নৌ প্রকৌশলকে অন্তভর্‚ক্ত করে। এই দশ বছরের পরিকল্পনা করতে গিয়ে চীন রাক্ষুসে হাঙরের মতো হয়ে ওঠে।

কোনো রকম নীতি নৈতিকতা বা আন্তর্জাতিক আইন কানুনকে বহু ক্ষেত্রে পাশ কাটাতে থাকে। যেমন সাইবার এস্পিওনাজ বা সাইবার গোয়েন্দ্রবৃত্তি শুরু করে এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চুরি করতে শুরু করে। এসব কারণে অপরাপর শিল্পোন্নত দেশগুলি চীনের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে ওঠে। হৈচৈ শুরু হয় আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিতে চীনের চৌর্যবৃত্তি নিয়ে।

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প সেকশন ৩০১ তদন্ত শুরু করেন এবং দেখতে পান যে ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টিসহ চীনের উদ্ভাবিত পদ্ধতিগুলো শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, সারা বিশ্বের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ। এর ব্যবস্থা হিসাবে তিনি চীনের থেকে আমদানিকৃত বেশকিছু পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ ট্যারিফ ধার্য করেন।

পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে চীনও তার সুবিধা অনুযায়ী ৫ থেকে ২৫ শতাংশ ট্যারিফ ধার্য করে। এতে মূলত ধাক্কাটা লাগে চীনের অর্থনীতিতে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চীনের প্রবৃদ্ধি ছিল গড়ে ৯.৫%। কিন্তু এরপরের চিত্রটা পাল্টে গিয়েছে। আইএমএফ জানিয়েছে, বর্তমানে চীনের প্রবৃদ্ধি ৬.৬ শতাংশ, কিন্তু ২০২৪ সাল নাগাদ আরো নেমে ৫.৫ শতাংশে দাঁড়াবে।

এই যে চীনের অর্থনীতি পতোনোম্মুখ, এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর প্রধান একটি কারণ হলো চীনের গৃহীত জিরো কোভিড পলিসি। চীনে ফের যখন কোভিড নেমে আসে তখন শেসজেঙ, গোয়াঙদং, শিয়ানজিনের মতো শিল্পশহরগুলিতে মানুষ অধিক আক্রান্ত হয়। বহু শিল্পকারখানার উৎপাদন বিঘ্নিত হয় এবং সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়।

একে তো জনগণের ঘর থেকে বের হওয়া বিপদজনক হয়ে পড়ে সরকারি নানা আদেশে এবং সংক্রমণের ভয়ে, দ্বিতীয়ত মানুষ অর্থব্যয় করা কমিয়ে দেয় সামনের বিপদের কথা চিন্তা করে। ডলারের বিপরিতে চাইনিজ মুদ্র ইউয়ানের দর পতন হয়। গত অক্টোবরে প্রচণ্ড তাপদাহ এবং খরা দেখা দেয় সিচুয়ান চংকিং অঞ্চলে।

এদিকে চীনের অর্থনীতি যে পতনোম্মুখ তা বুঝতে শুরু করে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলি। জাপানের সফটব্যাংক চীনের আলীবাবা থেকে বিশাল অংকের অর্থ তুলে নেয়, যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের ওয়ারেন বাফেটের বের্কশায়ার হ্যাথওয়ে ইলেকট্রিক কার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি করে দেয়। আমেরিকার স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে অনেকগুলি চীনা কম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।

চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি বড় দুর্বলতা হলো, ব্যাংকিং ব্যবস্থা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলো। দেশটির সবচেয়ে বড় ৫টি ব্যায়কই রাষ্ট্রায়ত্ব। আর এসব ব্যাংকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাবিত যা ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে একটি অন্তরায়। এসব কারণেই চীনের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বিদেশি অংশীদারিত্ব খুবই সীমিত।

চীনের আরো একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির রাঘব বোয়ালদের নিয়ন্ত্রনে সেদেশের অর্থনীতি। অথচ বাইরে থেকে মনে হয় কত বড় সাম্যের দেশ! মাঝে মাঝে দু-একটি দুর্নীতির মামলায় কঠিন শাস্তি দেখা যায়, কিন্তু আমরা জানি না যে সেটা আসলে দুর্নীতি নয়, অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ।

প্রেসিডেন্ট শি জিংপিঙ ২০১২ সালে যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছেন তা আসলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের চেয়ে নিজের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, চীনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাওয়ের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে আছে কমপক্ষে ২.৭ বিলিয়ন সমমানের অর্থ-সম্পদ। অবৈধ পুজির সবচেয়ে বড় দেশ চীন, যা ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

যা হোক, এই যে চীনের অর্থনীতিতে পতনোম্মুখ অবস্থা, এর প্রভাব কোথায় গিয়ে পড়বে? বিশেষজ্ঞরা বলেন, চীনের ঋণ গ্রহণকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর। বহুকাল ধরেই আন্তর্জাতিক মহলে অভিযোগ আছে, চীনের অর্থ ফেরত দিতে না পারলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ তাদের হাতে তুলে দিতে হয়। ঋণ চুক্তি সেভাবেই হয়ে থাকে। যেমন শ্রীলঙ্কাকে ২০১৭ সালে হাম্বানটোটা বন্দরের ৭০ শতাংশ ছেড়ে দিতে হয়েছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ব চায়না মার্চেন্ট ব্যাংকের কাছে ৯৯ বছরের মেয়াদে।

আরো বিপদজনক কথা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চীনের ঋণ হয়ে থাকে গোপনীয়, যা প্রকাশ করা হয় না। তবে চীন যে ঋণ দেয় তা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদা তহবিল, জার্মানি, ফ্যান্সের ঋণের তুলনায় চারগুণ চড়া সুদে, অর্থাৎ ৪ শতাংশ সুদে। চীন সাধারণত ঋণ গৃহিতা দেশকে ১০ বছর আর ওই প্রতিষ্ঠানগুলি এবং দেশগুলিকে সময় দিয়ে থাকে গড়পড়তা ৩০ বছর। সুতরাং সাবধান হতে হবে দেশগুলিকে। এখনো সাবধান হওয়ার সময় ফুরিয়ে যায়নি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/জেআইএম

বিপদজনক কথা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে চীনের ঋণ হয়ে থাকে গোপনীয়, যা প্রকাশ করা হয় না। তবে চীন যে ঋণ দেয় তা বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদা তহবিল, জার্মানি, ফ্যান্সের ঋণের তুলনায় চারগুণ চড়া সুদে, অর্থাৎ ৪ শতাংশ সুদে। চীন সাধারণত ঋণ গৃহিতা দেশকে ১০ বছর আর ওই প্রতিষ্ঠানগুলি এবং দেশগুলিকে সময় দিয়ে থাকে গড়পড়তা ৩০ বছর। সুতরাং সাবধান হতে হবে দেশগুলিকে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।