তিন জোটের রূপরেখা ও বিভাজনের রাজনীতি

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ১০ ডিসেম্বর ২০২২

এ লেখা যখন পাঠক পড়তে শুরু করবেন, তখন বহুল আলোচিত ১০ ডিসেম্বরের ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয়ে গেছে। কী কী ঘটল, তা আমাদের রাজনীতির অঙ্গনে নতুন কী সংযোজিত করলো, তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে। তবে, আমাদের রাজনীতি যে সহিংসতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না তা আরেকবার দেখতে হচ্ছে আমাদের।

একটা সামান্য জনসভার জায়গা নিয়ে বিএনপি ও সরকারের অনঢ় অবস্থান আমরা দেখলাম। রাজনীত যদি জনগণকে বার্তা দেয়ার বিষয় তাহলে জনসভা রাস্তার চেয়ে উদ্যানেই করা ভালো জায়গা। এরপরও যেটা জরুরি বলা, তাহলো মহানগর পুলিশ যেহেতু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানই দিয়েছে, তাই সেই সুযোগটা নিয়ে বিএনপি তার কর্মী সমর্থকদের ডেকে সেখানেই জনসভা করে তার রাজনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেয়ার কাজটা করতে পারতো।

আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের হিংসাশ্রয়ী রাজনীতি যে আরও প্রবল হচ্ছে সে বার্তা আমরা পাচ্ছি। কিন্তু কেন এমন হয়? এই মাত্র কয়দিন আগে ৬ ডিসেম্বর চলে গেল। দিনটি ছিল স্বৈরাচার এরশাদের পতন দিবস। এমনভাবে গেল যেন কিছুই হয়নি সেদিন। অথচ দিনটি ছিল স্বৈরাচার পতন দিবস। গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের এই দিনে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এই দিনে তিনি অস্থায়ী সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর মাধ্যমে অবসান হয় ৯ বছরের স্বৈরশাসনের। মুক্তি পায় গণতন্ত্র।

গণতন্ত্রের এই মুক্তির সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলিল তিন জোটের রূপরেখা। সামরিক একনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের পতনের আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনরত আওয়ামী লীগের নেতৃতাধীন ৮ দল, বিএনপির নেতৃতাধীন ৭ দল ও বামপন্থিদের ৫ দল মিলে এরশাদ পরবর্তী সরকার ব্যবস্থা কীরূপ হবে তার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেছিল।

১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর ওই তিনটি জোট আলাদা আলাদা সমাবেশে রূপরেখা তুলে ধরে। এর ১৫ দিনের মাথায় এরশাদ ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। অনেক কিছুই ছিল রূপরেখায়। রূপরেখার প্রধান দিক ছিল মৌলবাদ ও স্বৈরাচার যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেই প্রত্যয়। ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পুনঃগণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কথা বলা ছিল।

কোন প্রতিজ্ঞাই রক্ষা করা হয়নি। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসেই একে এক সব পেছনে ফেলতে শুরু করে। যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে, তাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ১৯৯১ সালে জামায়াতের সহায়তায় সরকার গঠন করে বিএনপি। আমরা দেখেছি এরশাদের দল জাতীয় পার্টি কতটা কদর পেয়েছে আওয়ামী লীগের কাছে। তাকে নিয়ে চারদলীয় জোট করেছিল বিএনপিও। আর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাথে সবাই সখ্য গড়ে তুলেছে।

কেন এত সহিংসতা? রাজনৈতিক উন্মত্ততা? অসহিষ্ণু পুলিশ? এসব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে। গ্রেনেড হামলা করে একটি দলের পুরো নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার মতো পরিকল্পনা যখন করে ক্ষমতাসীন একটি দল করে তখন বিশ্বাসের জায়গাটা চিরস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে সেটিই ঘটেছে।

আমাদের দেশে সরকার বিরোধী কর্মসূচি মানেই সহিংস আন্দোলন। সহিংসতা হলো একটা বিষয় যার মোকাবিলা করতেও পাল্টা হিংসার আমদানি হয়। আধিপত্য কায়েমের এই ব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত আছে সহিংসতা। একটা সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে এবং তা হলো সরকারকে রাজপথের সহিংস লড়াইয়ের মাধ্যমেই হটাতে হবে। আর সে থেকেই আসে পাল্টা সহিংসতা।

আমাদের নেতাদের আত্মকেন্দ্রিকতা, রাজনৈতিক মোক্ষলাভের নীল নকশা ছাড়া রাজনীতিতে আর কোন রাজনীতি নেই। গণতন্ত্র নয়, দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাই সব দলের লক্ষ্য। জেলায় জেলায়, পাড়ায় পাড়ায় সঙ্কীর্ণ দলীয় আধিপত্য এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় যে তখন সরকারি প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে সমাজকে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণের জাল বিস্তার করতে পারে দলীয় ক্যাডাররা। আমাদের রাজনীতি আর আমরা-ওরার বিভাজন থেকে বের হতে পারছে না এ কারণেই।

করোনার দুই বছর, ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশর অর্থনীতিকেও প্রবলভাবে আঘাত করেছে। মানুষ রোজগার হারিয়ে, মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে পর্যুদস্ত। এ অবস্থায় এমন আতঙ্কজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের আরও ভাবিয়ে তুলেছে। নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকতেই এমন উত্তপ্ত রাজনীতি আর্থিক পরিস্থিতিকেও ঘোলাটে করে তুলেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অংকের অযাচিত ঋণ, টাকা পাচার ও নানাপ্রকার দুর্নীতির খবরের পাশাপাশি এসব মানুষকে শুনতে হচ্ছে অসহায়ভাবে।

আমরা জানিনা কবে এই সহিংসতা নির্ভর রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মসূচি থেকে রাজনীতি বেরিয়ে আসবে। কবে দলমত নির্বিশেষে সকলে গণতন্ত্রের আওয়াজ তুলবেন। দলগুলোর ভেতরকার নিজস্ব গণতান্ত্রিক চর্চাই পারে দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে যা আধিপত্য বিস্তারের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিদায় জানাতে পারবে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/জেআইএম

করোনার দুই বছর, ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছরে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশর অর্থনীতিকেও প্রবলভাবে আঘাত করেছে। মানুষ রোজগার হারিয়ে, মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে পর্যুদস্ত। এ অবস্থায় এমন আতঙ্কজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের আরও ভাবিয়ে তুলেছে। নির্বাচনের এক বছর বাকি থাকতেই এমন উত্তপ্ত রাজনীতি আর্থিক পরিস্থিতিকেও ঘোলাটে করে তুলেছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বড় অংকের অযাচিত ঋণ, টাকা পাচার ও নানাপ্রকার দুর্নীতির খবরের পাশাপাশি এসব মানুষকে শুনতে হচ্ছে অসহায়ভাবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।