মূসক
যুক্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনবান্ধব হোক মূসক
মূল্যের সঙ্গে যুক্ত যে কর তাকে বলে মূল্য সংযোজন কর। সংক্ষেপে মূসক। সরকারের রাজস্ব আহরণে কর সংগ্রহের একটি ব্যবস্থা। এর প্রচলন আমাদের দেশে শুরু হয় ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে। মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাবিত একটি আধুনিক কর ব্যবস্থা।
দেশীয় পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়, বিদেশি পণ্য আমদানি ও রফতানি, দেশ ভেতরে সেবা বা পরিসেবার উৎপাদন, বিপণন ও বিক্রয়- সব ক্ষেত্রে মূল্য সংযোজন কর আদায় করা হয়। তা উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রয় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে আরোপ ও আদায় করা হলেও এর দায়ভার চূড়ান্তভাবে কেবল পণ্য বা সেবার ভোক্তাকে বহন করতে হয়। মূসক খাত থেকেই সরকারের বেশি রাজস্ব আয় হয়।
১৯২০ সালে জার্মান ব্যবসায়ী ভন সিমেন্স মূল্য সংযোজন করের ধারণা দেন। ১৯২১ সালে এডামস রেয়াত পদ্ধতির বিবরণ দেন। জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মূসকের কার্যক্রম শুরু হয় প্রথম। বর্তমান বিশ্বে ১৪৭টি দেশে মূসক ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে।
আমাদের দেশে ১৯৭৯ সালের এপ্রিল প্রথম সে সময়কার করারোপ তদন্ত কমিশন সরকারিভাবে বিক্রয় করের বিকল্প হিসেবে মূসক চালুর কথা ভাবে। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বিক্রয় কর আদায় করা হতো বিক্রয় কর আইন ১৯৫১ অনুসারে। ১৯৮২ সালে বিক্রয় কর অধ্যাদেশ জারি করে ১ জুলাই থেকে আগের আইন বাতিল ও নতুন আইন প্রতিস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশে মূসক চালুর প্রক্রিয়া শুরুর ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে।
১৯৯০ সালের মধ্য জুনের কিছু আগে মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯০ (খসড়া) তৈরি করা হয়। ওই আইনের চূড়ান্ত রূপ সে সময়কার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ১৯৯১ সালের ৩১ মে একটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করেন। অধ্যাদেশের আটটি ধারা (যেগুলো মূসক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত হওয়া এবং মূসক কর্তৃপক্ষের নিয়োগ ও ক্ষমতা সংক্রান্ত ছিল) ২ জুন ১৯৯১ থেকে এবং বাকি ধারাগুলো ১ জুলাই ১৯৯১ থেকে কার্যকরী করা হয়। ১৯৯১ সালে ১ জুলাই জাতীয় সংসদে মূল্য সংযোজন কর বিল ১৯৯১ উত্থাপন করেন সে সময়কার অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান। তা সংসদে পাস হয় ৯ জুলাই। বিলটি পরদিন রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে।
মাঠ পর্যায়ে মূল সংযোজন করের বাস্তবায়ন এবং ভোক্তা পর্যায়ে এর বাস্তবতা এবং তথ্যভিত্তিক চিত্র তুলে ধরছি। ভোক্তা হিসেবে অধিকার বিষয়ে আমি বরাবরই সচেতন। পণ্য ক্রয় করতে গিয়ে বিক্রেতা বা দোকানির কাছে মূল্য প্রদানের বিপরীতে প্রামাণ্য কাগজ চাই। সেটা আমার দুটি সুর্নিদিষ্ট প্রয়োজনে; ১. যদি আয়কর রিটার্নে তা কাজে লাগে এবং ২. পণ্যে ব্যবহারে কোনো আপত্তি থাকলে তা সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া।
মহানগরের সিদ্ধেশ্বরী আনারকলি মার্কেট এবং চামেলীবাগ ইস্টার্ন প্লাসে ক’দিন আগে পরিবার নিয়ে কেনাকাটা করতে গিয়েছি। কিন্তু দোকানি কেউ কেনা পণ্য মূল্যের রশিদ দেননি। আনারকলির পর্দার কাপড় বিক্রেতাকে বললাম ‘ভাউচার’ দিন। বললেন, ‘ওটা আমরা দেই না।’
- কেন সরকারকে কর দেন না?
- মাসে মাসে সরকারের লোক এক থেকে ২ হাজার টাকা এসে নিয়ে যান!
- মাসের বিক্রয় কত তা দেখেন না তারা? উত্তর-‘খাতা দেখান লাগে না!’
একই ধরনের উত্তর ইস্টার্ন প্লাসের কাপড় বিক্রেতার। তিনি জানান, আমরা খাতায় হিসাব রাখি। মাসে মাসে করের লোক আসেন, টাকা নিয়ে যান। রশিদ দাবি করলে আমাকে বড় এ দোকান মালিক দোকানের ‘ভিজিটিং কার্ড’ ধরিয়ে দেন। দুটি বড় মার্কেট ৯৫ শতাংশ বিক্রেতা হাতে লিখেও ‘ভাউচার’ দেন না।
ভোক্তা যেহেতু মূসক মূল্য পরিশোধ করছেন তাই তার নামেই বিল হওয়া উচিত। কিন্তু ভোক্তার নামে কম্পিউটারইজ বিল হয় না। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তর- ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইজ (ইএফডি) পদ্ধতির ব্যবহৃত সফটওয়্যার ক্রেতার নামে করা নেই। অনেক সুপার শপে ব্র্যান্ড আইটেমের পণ্যে ইএফডি পদ্ধতিতে মূসক আদায় করা হচ্ছে অবৈধভাবে!
যে জিনিসটি সাধারণ দোকানে সব ধরনের কর সংযোজন করে বিক্রি হচ্ছে ধরুন ৩৫ টাকায়, সুপার শপে তা সাড়ে ৭ শতাংশ মূসক যোগ করে ভোক্তাকে ঠকানো হচ্ছে। অর্থাৎ দ্বৈত মূসক দিচ্ছেন ভোক্তা। মাঠ পর্যায়ে ভ্যাট কর্মকর্তার বিষয়টি মনে হয় না দেখছেন। সরকারের নিয়োজিত কর্তাব্যক্তিদের কাজ যেন লক্ষ্যমাত্রার বেশি কর আদায়, সেটা ন্যায় না অন্যায়সংগত তা তারা যাচাই করেন না। পুরস্কার ও পদোন্নতি তাদের মাথায় কাজ করে।
মূসক ভোক্তা বা জনবান্ধব কি না তা এক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ! আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে ভোক্তা বা করদাতা কর বা মূসক দেন তার নামেই চালান বা রশিদ (ভাউচার) থাকা উচিত। অনেকদিন থেকেই লক্ষ্য করেছি যারা বিল প্রদান করে থাকেন -রেস্টুরেন্ট ও বিপণিগুলোতে থেকে ভোক্তার কাছ থেকে বিলের সঙ্গে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ মূসক কেটে রাখলেও আয়করদাতা বনে যান বিল সংগ্রাহক। কী বিস্ময়! ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে আপনি আমি দিচ্ছি কর বা মূসক, কিন্তু আয়করদাতা বনে যাচ্ছেন বিল গ্রহীতা! এ বৈষম্য দূর করা জরুরি। এতে করে দীর্ঘমেয়াদে ক্রেতা বা ভোক্তার মনে অসহযোগিতার মনোভাব তৈরি হতে পারে!
আগস্ট মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটি সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, সারাদেশে আড়াই লাখের বেশি মূসক বা ভ্যাট নিবন্ধিত দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট মেশিন বসেছে মাত্র ৩ হাজার ৩৯৩টি দোকানে। অর্থাৎ ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ দোকানেই ভ্যাট মেশিন নেই। দোকানিরা অনেকেই এর কারণ হিসেবে বলেছেন, প্রথমদিকে মেশিনগুলো বিনে পয়সায় পাওয়া যেতো।
এখন তা নিতে হলে ২০ হাজার টাকার ওপর খরচ লাগে। সম্প্রতি সম্প্রচারে যাওয়া বেসরকারি স্যাটেলাইট একটি টিভি চ্যানেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (মূসক নীতি) আবদুল মান্নান শিকদার এ বিষয়ে বলেছেন, ভ্যাট বেশ জনবান্ধব। বিনে পয়সায় কিছু পাওয়া গেলে সেবা গ্রহণকারীর কাছে এর গুরুত্ব থাকে না। তাই কিস্তিতে হলেও ভ্যাট মেশিন দোকানিকে কিনতে হবে।
অর্থকাগজ নামে আমি একটি পাক্ষিক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। সরকারের ঘোষণাপত্র লাভ করে ২১ বছর ধরে কাগজটি ব্যক্তিগতভাবে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে প্রকাশ করে যাচ্ছি। দেশের মূলধারার বেশ ক’টি জাতীয় দৈনিকে কাজ করেছি। অর্থনীতি বিষয়ে দীর্ঘদিনের সে অভিজ্ঞতায় ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচিতি রয়েছে আমার। এর সুবাদে পত্রিকা প্রকাশনায় আয় আমার প্রদর্শনী বিজ্ঞাপন এবং স্বল্প পরিসরে পত্রিকা বিক্রয়। সচেতন নাগরিক হিসেবে প্রচলিত আইন ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শৃঙ্খলা ও নিয়মের মধ্যেই জীবনের আত্মসন্তুষ্টি খুঁজি। কিন্তু অন্যায়কে অশ্রদ্ধা করি বলেই জোর গলায় প্রতিবাদ করি আমার লেখনি কর্মে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব হিসেবে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে অর্থমন্ত্রী জুন মাসে জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করেন। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংগ্রহ করবে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহ করা হবে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। উচ্চাবিলাসী জাতীয় বাজেট প্রণয়ন আমাদের বহু বছরের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি কোনো বছরই রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না! এর কারণও আছে! কর পরিসর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে জরিপ কার্যক্রমে পদ্ধতিগত সমন্বয়হীনতা ও দীর্ঘসূত্রতা, আয়কর ব্যবস্থাপনার তথ্য বিনিময়ের অভাব, দক্ষ জনবলের স্বল্পতা এবং আদায় কার্যক্রমে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘ম্যানেজ’ হয়ে যাওয়া।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে দেখা যায়, শুল্ক ও কর আদায়ে ঘাটতি ছিল সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। এ তিন মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বেশি আদায় হলেও এ খাতে ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। ডিসেম্বর অবধি বর্ধিত সময়কালে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মূসক অর্জিত হবে কি না তা জানা যাবে পরে।
মূল্য সংযোজন করের মধ্যে বৈষম্যমূলক চিত্র লক্ষণীয়। অনেকদিন ধরেই তা লক্ষ্য করছি। সংবাদপত্রের যুগের অবসান হতে চলেছে মনে হয়। অতিমারি করোনা সংক্রমণের পর পাঠক সংবাদপত্রের ছাপা সংস্করণের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন! তাই এক্ষেত্রে দেশে প্রকাশনা শিল্পের বড় সংকটকাল চলছে। বিজ্ঞাপন আয় নেই বলেই চলে।
হাতেগোনা দৈনিক সংবাদপত্র ছাড়া বিজ্ঞাপন দেখি না। গড়ে প্রতি সংখ্যায় মাত্র তিনটি বিজ্ঞাপন পায় অর্থকাগজ। ৩০ হাজার টাকার প্রদর্শনী বিজ্ঞাপনের মধ্যে ৪ শতাংশ উৎস কর, ১৫ শতাংশ মূসক এবং ২ শতাংশ সরকারের সেবা চার্জ মোট ২১ শতাংশ প্রতি বিজ্ঞাপন বাবদ কেটে নেওয়া হয়। হিসাব ও জনসংযোগ বিভাগ থেকে এ আয় সংগ্রহ করতে মাসের পর পর মাস চলে যায়। কর ও মূসক চালান দিতে চান না বিজ্ঞাপনদাতা। যারা দেন তাদের কাছ থেকে চালান পেতে বেশ দেরি হয়। অনেকেই দেনও না। ফলে অর্থকাগজ এর রিটার্ন জমা দিতে প্রতি বছরই বিলম্ব হয়।
মূসক ও কর আদায়ে একেক বিজ্ঞাপনদাতা একেক রকম চার্জ কেটে বাকি অংকের টাকা পরিশোধ করেন। বারবার তাগাদা সত্ত্বেও যখন মূসক চালান পাই না তখন ভাবি এর পেছনে রহস্য আছে! সংবাদপত্রে প্রদর্শনী বিজ্ঞাপন আগে বিজ্ঞাপনদাতা তার তালিকাভুক্ত বিজ্ঞাপনী সংস্থার মাধ্যমে দিতেন। সে ক্ষেত্রে কর আরোপযোগ্য ছিল। সরাসরি প্রাপ্ত প্রদর্শনী বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে মূসক কর্তনের বিধান নেই। অথচ না জেনে অনেকেই কাটছে।
সরকারি কোষাগারে কেউ চালানের মাধ্যমে তা জমা দিচ্ছে। কেউ দিচ্ছে না। কিন্তু ভোক্তা বা বিজ্ঞাপন প্রচার কার্যক্রমে যুক্ত সংবাদপত্র উপযুক্ত মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রদর্শনী বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় সেবা খরচ নামে মূল্যের ২ শতাংশ চার্জ কেন কেটে নেয়, তার উত্তর আজও পাইনি। এ জন্য কোনো চালানপত্রও পাওয়া যায় না।
যিনি সেবা পান তিনিই মূসক দেবেন এমনটিই বলা হয়। বিজ্ঞাপনের প্রচারের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছে সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান অথচ তাকেই দিতে হচ্ছে মূসক বা আয়কর! হিসাববিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে ব্যবস্থাপনা, ব্যয়, নিরীক্ষা, কোম্পানি আইন, ব্যবসায় প্রশাসন ও করাধার নিয়ে হালনাগাদ শিক্ষা, গবেষণা ও বিশ্লেষণ কাজে এখনও যুক্ত। সুতরাং যুক্তি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূসক জনবান্ধব কি না সে প্রতিপাদ্যটি তখনই সত্য বলে আমরা গ্রহণ করবো, যখন উল্লেখিত বিষয়গুলোর ন্যায্য সমাধান ভোক্তা বা প্রকাশক পাবেন। মূল্য সংযোজন কর তাই জনবান্ধব হোক।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও অর্থকাগজ সম্পাদক।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জেআইএম