মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্রদের মৈত্রী দিবস
আজ ৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ-ভারত ‘মৈত্রী দিবস’। ১৯৭১-এ এই দিনে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশকে। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আনুষ্ঠানিকভাবে সেদিনই এই স্বীকৃতির কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দিন আহমদকে। এর আগে ভারতের সংসদে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টপটের সৃষ্টি হয়েছিল, যখন শতভাগ সংসদ সদস্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবের সম্মতি জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়তার হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল একদম শুরুতেই। শুরু থেকেই বাঙালি শরণার্থীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল ভারতের সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলো। ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাহিনী বিএসএফ মুক্তিযুদ্ধের একদম শুরুর দিক থেকেই মুক্তিবাহিনীকে সব রকম সামরিক সহায়তা জুগিয়ে আসছিল। আর এই মুক্তি বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল ভারতেই।
একাত্তরের ৯টি মাসে বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করার জন্য বিশ্বময় ছুটে বেড়িয়েছেন শ্রীমতি গান্ধি এবং তার মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা। মুক্তিযুদ্ধের বাঁকে বাঁকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের এমন অসংখ্য সহযোগিতা ভারত বাংলাদেশ মৈত্রীকে একটি অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরও, যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারতবর্ষ। বাংলাদেশকে বিনামূল্যে জ্বালানি সহায়তা থেকে শুরু করে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ও অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে ভারতীয় সহায়তার কথা সব সময় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। তবে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাত্র কয়েক মাসের মাথায় এদেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্ণ প্রত্যাহার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান, জার্মানি বা দক্ষিণ কোরিয়ায় যে মার্কিন সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল, তারা আজও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এত বছর পরও এসব দেশে মোতায়েন রয়েছে। এমনকি এসব দেশে রয়েছে মার্কিন ঘাঁটিও। অথচ ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ, যেখানে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে উপহার হিসেবে তার সেনাদের তড়িঘড়ি নিজ সীমান্তের অভ্যন্তরে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
আজও যখন উন্নয়নের মহাসড়কে ধাবমান বাংলাদেশ, তখন পরস্পরের উন্নয়ন যাত্রায় সহযোগী বাংলাদেশ ও ভারত। একটা সময় যখন এদেশের ক্ষমতায় ছিল ক্যান্টনমেন্ট থেকে জন্ম নেওয়া দলগুলো, তখন বাংলাদেশ আর ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহৃত হয়েছে একে অপরের বিরুদ্ধে জঙ্গি গোষ্ঠেীকে প্রশিক্ষণ আর একে অপরের দেশকে অস্থিতিশীল করার কাজে। এদেশে যেমন ছিল ভারতের সেভেন সিস্টার্সে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর সরব উপস্থিতি তেমনি ভারতেও আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়েছে শান্তি বাহিনী।
আমাদের বহুল আলোচিত দশ ট্রাক অস্ত্রের গন্তব্য ভারতই। সেই জায়গা থেকে আজ দুজন গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুই দেশের সম্পর্ক আজ বিশ্বের বিস্ময়। কারণ বাংলাদেশ আর ভারত যে শুধু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একে অপরের উন্নয়নেই সহযোগিতা করছে তাই নয়, তারা পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে একে অপরের দুঃসময়েও। এর উদাহরণ আমরা দেখেছি কোভিডকালীন সময়ে যখন ভারতীয় ভ্যাকসিন যেমন একদিকে বাঙালির জীবন রক্ষা করেছে অন্যদিকে বাংলাদেশের র্যামডিসেভিরে বেচেছে ভারতীয় প্রাণও।
বাংলাদেশ ভারতে মুক্তিযুদ্ধকালীন এমন সহযোগিতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল হলেও একেবারেই বিরল নয়। মিত্রের প্রতি মিত্রের যুদ্ধকালীন সময়ে এমন সহায়তার নমুনা আমরা হালের রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ও দেখেছি, কিন্তু একটি দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়েছে অন্য দেশের মানুষ, এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই বললেই চলে। আর সেই কাজটি করেছিলেন ভারতের সামরিক, নৌ ও বিমানবাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছিলেন।
বছর দু’য়েক আগে ভারতের সদ্য সাবেক হাইকমিশনার চট্টগ্রামের উপকণ্ঠে একটি ভাস্কর্যের উদ্বোধন করেছিলেন। ‘মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র’ নামের ওই ভাস্কর্যটি স্থাপিত হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে। যেখানে ১৮ ডিসেম্বর একাত্তরে পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের কাপুরুষচিত আকস্মিক আক্রমণে শহীদ হয়েছিলেন অসংখ্য ভারতীয় সেনা আর আমাদের মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা।
বাঙালি আর ভারতীয় শহীদদের মিলিত স্রোতধারায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্মারক হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্র। মৃত্যুঞ্জয়ী মিত্রদের এই মৈত্রী দিবস তাই বিশ্বের ইতিহাসে মৈত্রী আর সহযোগিতার এক অনন্য দিবস হিসেবে বছরের পর বছর ক্যালেন্ডারের শেষ পাতায় জ্বল জ্বল করবে।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
এইচআর/এমএস/ফারুক