কাগজের দাম আর প্রকাশনার অবস্থা
এ বছর আমার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশ পাওয়ার কথা। পান্ডুলিপিগুলো অনেক আগেই হস্তান্তর করেছিলাম। কিন্তু এখন কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় মনে হচ্ছে আমার বই কি বেরুবে?
বই বেরুবে কি বেরুবে না, তা কিন্তু অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায়। কতোটা দাম বেড়েছে সে তথ্য দিয়েছেন মিলন কান্ত দাস। তিনি এবং তার পাশে থাকা সময় প্রকাশনীর প্রধান নির্বাহী ফরিদ আহমেদ, অনন্যা’র মালিক মনিরুল হক, কাকলি’র মালিক এ কে নাছির আহমেদ, আবিষ্কার প্রকাশনীর মালিক দেলোয়ার হাসান, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনীর কমল কান্তি দাস, সমগ্র প্রকাশনীর শওকত আলী, মুক্তচিন্তার কর্ণধার শিহাব বাহাদুর।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অনুপম প্রকাশনীর মালিক মিলন কান্তি দাস। উল্লেখ করতে চাই আমার বেশ কয়েকজন প্রকাশক আছেন, তারা কিন্তু এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না। তার মানে এটা নয় যে তারা কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় শঙ্কিত নয়। ব্যক্তিগতভাবে বেশ কয়েকজনই এই শঙ্কা আমাকে জানিয়েছেন যে এবার আর বই প্রকাশ করা যাবে না। কাগজের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
গত বছর যে কাগজ (কতো গ্রামের কোন শ্রেণির কাগজ উল্লেখ না করলেও আমরা জানি তারা বলেছেন ৮০/৯০/১০০ গ্রামের অফসেট ডবল ডিমাইয়ের দাম) কিনেছেন ১৬-১৮শ টাকায় প্রতি রিম, সেই কাগজ এবার ৩৫শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লিখলাম বটে বিক্রি হচ্ছে, আসলে বিকোচ্ছে কি না, সেই সত্য টালি/চেক করে দেখিনি। তবে যেভাবে দেশের অভ্যন্তরের বাজার পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত ও মুনাফার বাতাসে ভাসছে, তাতে করে এই সত্যকে অস্বীকার করবো কেমন করে?
চাল-ডাল/নুন-মরিচের দামই কেবল বাড়েনি, জীবনযাপনের সব উপাদানেরই দাম বেড়ে প্রায় আকাশছোঁয়ার জোগাড়। আমরা যারা নগরের বাসিন্দা এবং নানান সুযোগের অধিকারী, তারা না হয় ৮০/৮৫/৯০ টাকা দরে চাল কিনে খেতে সক্ষম, কিন্তু যাদের দিন এনে দিন খেতে হয়, তারা কি দিয়ে চাল কিনবে? তাদের আয় তো ৩০-৪০ টাকা দরে চাল কেনার মতো। সরকার অবশ্য ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) দিয়ে গরিবদের মুখে অন্ন জোগাড়ের কাজ করছেন, কিন্তু সেই সব খেটে খাওয়া লোকগুলো আয়-রোজগারে না গিয়ে ওএমএসের লাইনে সারাদিন ব্যয় করে কি কম দামের চাল সংগ্রহ করতে পারবে?
আমরা কি ধরে নেবো সরকার বই ছাপানোর পণ্য কাগজও ওএমএসর মতো ব্যবস্থায় আমাদের প্রকাশকদের দুয়ারে পৌঁছে দেবেন? বই প্রকাশকরা এমন আয় বা লাভ করেন না যে এক মৌসুমের বিক্রির টাকায় গাড়ি কিনে ফেলবেন। আমার যে কয়জন প্রকাশক আছেন তাদের কাউকে বাড়ি কিনতে দেখিনি বা তাদের বাড়ি দেখিনি। তাই বলে প্রকাশকরা যে লাভ করেন না, তা তো নয়।
মিলন কান্তি দাস জানিয়েছেন, একটি বই পাঠকের হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত ১৬টি পেশাদার হাত ঘুরে আসে। এই ১৬টি পেশার লোকদের পেশার মান অনুযায়ী শ্রমের দাম বেড়েছে। আসলে বইয়ের সৃজনশীল লেখকের মানও বাড়েনি প্রকাশকের কাছে, দামও বাড়েনি। বই ছাপিয়ে দিয়ে প্রকাশকরা লেখককে ধন্য করে দেন। ফলে তার রয়্যালটি নিয়ে তারা কোনো কথা বলেন না। কোনো লেখক যদি রয়্যালটির প্রশ্ন তোলেন, তখন তারা বলেন, বই তো বিক্রি হয় না স্যার, কি দেবো আপনাকে?
যারা বই কেনেন, তারা গরিব ঘরের ছেলেমেয়ে। কেউ কেউ আছেন মধ্যবিত্ত নামক এক ‘ফানুস বিত্তে’ শ্রেণি, এদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিপুল, কিন্তু আঙুলে গুনলে ২৪ হাজারও হবে না। সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ের প্রকাশক বাংলা একাডেমির মেলায় কতো বই বিক্রি করেছেন, সেই সত্য তথ্য জানান বলে মনে হয় না। হয় তারা বাড়িয়ে বলেন, কিংবা কমিয়ে বলেন।
যেহেতু বিক্রির পরিমাণ বলার পর তাকে তার ট্যাক্স দিতে হবে না বা কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় না, তাই তথ্য বিকৃত করতে তারা ভালোবাসেন। এবার ওই ফানুস শ্রেণির ও গরিব মানুষরা বই কিনতে পারবে না। কারণ বইয়ের দাম এমন হবে যে পাঠক ওই টাকা ব্যয় করে বই কিনতে চাইবে না।
এই পাঠকরা বই কিনতে পারবেন না কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায়। তারা মিথ্যা বলেননি। বইয়ের পাঠক তারাই যারা অর্থবিত্ত করার রাজনৈতিক লাইন আয়ত্ব করতে পারেননি।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে মনে হচ্ছে এবার বোধহয় পুরোনো বইয়েরই নতুন মেলা হবে। যারা গত মেলায় বই কিনতে পারেননি, তারা এবার সেই সুযোগ পাবেন বলেই মনে হচ্ছে। কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রকৃত লেখকদেরই বই না বেরুলেও নতুন ও অলেখকের বই বেরুতে কোনো বাধা নেই। কারণ তারা নিজের টাকায় প্রকাশকের মাধ্যমে বই করবে।
এভাবে আমাদের সমাজে এতোটাই অলেখকের ভিড় বেড়েছে যে ওই আবর্জনা থেকে প্রকৃত ভালো মানের বই খুঁজে নেওয়া অনেকটাই দুঃসাধ্য। যান্ত্রিক নগর জীবনের ঘানি টানতে টানতে প্রকৃত পাঠকের জীবন এতোটাই ত্যক্ত যে, সে প্রকৃত ভালো মানের শিল্পসাহিত্যের খোঁজ নিতে পারেন না। তাকে শত শত কিংবা হাজারেরও বেশি আবর্জনা চেক করে প্রকৃত সত্যে পৌঁছাতে হয়। সেই শ্রম ও টাইম সে বা তারা কেমন করে দেবে?
কাগজের দাম যে বেড়ে গেলো, এর সমাধান কি?
বইয়ের কাগজ খাদ্যপণ্যের মতো জিনিস নয় যে সরকার বাহাদুর তা সুলভমূল্যে বাজারে বিক্রির ব্যবস্থা করবেন। গরিব মানুষের খাদ্যের সংকট মেটাতে সরকার ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) দিয়ে সামাল দিচ্ছেন। কিন্তু কাগজের বিষয়টি তো ওভাবে করা যাবে না। কিন্তু সরকারকে একটি পথ খুঁজে নিতে হবেই। কেননা সরকার তো জনগণের যেমন অভিভাবক, তেমনি প্রকাশক-পাঠকদেরও।
পাঠকের ক্ষুধা সৃজনশীল, এটা মনে রাখতে হবে। আর সৃজনশীল ক্ষুধা এমন এক পণ্য যা দিয়ে কেবল জ্ঞানার্জন সম্ভব। আর তা দিয়ে নিজেদের প্রজ্ঞার শান দেওয়াই শ্রেয়, যা শেষ পর্ন্ত তার সারাজীবনের কর্ম ফসলের রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অর্জন। ওই জ্ঞান ও বিদ্যার জোড়েই তারা সরকারি ও বেসরকারি অফিস আদালতের কর্ণধার হয়ে যান বা হয়ে ওঠেন দক্ষ কর্মবীর। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাপগুলোতে যে বুকিশ জ্ঞান অর্জিত হয় শিক্ষার্থীদের, তার প্রাকটিক্যাল ইভেন্ট শুরু হয় সৃজনশীল পুস্তকের ভেতর দিয়ে। এ কারণে সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনায় বিশেষ সহায়তা করা সরকারের রাজনৈতিক অভীপ্সার জন্যও জরুরি।
তাহলে কি করা যেতে পারে কাগজ সংকট নিরসনের লক্ষ্যে? এটা ঠিক যে কাগজই হোক বা খাদ্য পণ্য, কোনো সেক্টরেই সরকার ঠিক মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। তাদের রাজনৈতিক ব্যবসায়ী অ্যালিডদের জন্যই সরকার তা পারছেন না।
আমি বহু বছর আগেই একবার এবং পরেও বেশ কয়েকবারই প্রকাশনা শিল্পের ব্যাপারে লিখেছিলাম যে, এই খাতটি শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা জরুরি। তাহলে তারা শিল্প সেক্টরের সুযোগ সুবিধা পেতো। সেই সব সুবিধার সঙ্গে পেতে পারতো কাগজ সম্পর্কিত সংকটের সহায়তাও। সাশ্রয়ী মূল্যে কাগজ কেনার সুযোগসহ আরও নানাবিধ সুবিধা। তারা বইয়ের দামও কম রাখতে পারতো, যাতে পাঠক বই কিনতে দুর্ভাবনায় না পড়ে। কিন্তু আমি শুনিনি যে তারা শিল্প হিসেবে বরিত হয়েছে কি না।
আজ যখন প্রকাশকদের কয়েকজন সংবাদ সম্মেলন করে সরকারকে জানাচ্ছেন যে তারা এবং তাদের শিল্প খাতটি দুর্বৃত্ত শ্রেণির কাগজ ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়েছে, সেই খপ্পর থেকে তারা মুক্তি পাবেন কীভাবে? এ নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। কার্যকর পদক্ষেপও নিতে হবে সরকারকে। কারণ দায়টি তারই ওপর।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/ফারুক/এমএস