চীনে যখন ‘শীতের শুরু’
গ্রিক পুরাণে দেবরাজ ছিলেন আকাশ ও বজ্রের দেবতা জিউস (Zeus) এবং পাতাল তথা নরকের দেবতা ছিলেন জিউসের ভাই হেইডিস (Hades)। ডিমিটার (Demeter) ছিলেন পৃথিবীর ফসল ও কৃষির দেবী। এই ডিমিটারের গর্ভেই জন্ম জিউসের কন্যা পার্সেফোনির (Persephone)।
একবার হেইডিস কিডন্যাপ করেন নিজের আপন ভাতিজি পার্সেফোনিকে। উদ্দেশ্য, তাকে বিয়ে করা। এতে জিউস ভীষণ চটে গেলেন, হেইডিসকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে মেয়েকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে। দুষ্টু হেইডিস কৌশল খাটালেন, কায়দা করে পার্সেফোনিকে খাইয়ে দিলেন পাতাল বা নরকের খাদ্য।
এতে ধর্ম-সংকটে পড়লেন জিউস। নিয়ম অনুসারে, তাকে আগের নির্দেশ বদলাতে হলো। তিনি নতুন নির্দেশ দিলেন: পার্সেফোনিকে বছরে ছয় মাস পাতালে হেইডিসের স্ত্রী তথা রানি হিসেবে থাকতে হবে এবং পরের ছয় মাস সে মর্তে মা ডিমিটারের কাছে থাকবে। খবর শুনে ডিমিটারের মন ভেঙে গেল। মনের দুঃখে তিনি পৃথিবীতে শীত নামালেন।
শীতের শুরু
ওয়েলস (Welsh) পুরাণেও একজন নারীকে কিডন্যাপ করার সঙ্গে দুই গ্রুপের যুদ্ধের ও শীতকাল সৃষ্টির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তবে, আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা জানি, আসলে রূপকথার সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বাস্তবে, শীত আসে পৃথিবীর দুই গোলার্ধের সঙ্গে সূর্যের অবস্থানের কারণে। যখন পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে শীতকাল, তখন দক্ষিণ গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল। উল্টোভাবেও এ কথা সত্যি।
শীত বাংলা পঞ্জিকার পঞ্চম ঋতু। পৌষ ও মাঘ—এই দুই মাস মিলে হয় শীতকাল। শীতকাল মূলত শুষ্ক; দিনের তুলনায় রাত হয় দীর্ঘ। বাঙালি শীতের সময় খেজুরের রস আর হেমন্তের নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা-পায়েস তৈরি করে খায়। শীতকালে বাংলাদেশে অনেক ফুলও ফোটে: গাঁদা, অশোক, ইউক্যালিপটাস, কুরচি, ক্যামেলিয়া, বাগানবিলাস, গোলাপ, সরিষা, ইত্যাদি। এ সময় ঘন কুয়াশা হয়, পাতা ও ঘাসে শিশিরবিন্দু দেখা যায়।
প্রাচীন চীনে শীতকে স্বাগত জানাতেন সম্রাটরা
বাংলাদেশে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত শীতকাল হলেও, বাস্তবে নভেম্বর থেকেই হালকা শীত অনুভূত হতে থাকে। জানুয়ারি মাসে গড় তাপমাত্রা দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ১১° সেলসিয়াস থেকে শুরু করে উপকূলীয় অঞ্চলে ২০° থেকে ২১° সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়। এ সময় বৃষ্টিপাত হয় খুবই কম। কখনও বাংলাদেশে তুষারপাত হয়েছে বলে শুনিনি।
চীনে বাংলাদেশের মতো ঋতু ছয়টি নয়, বরং চারটি: বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীত। আর এদেশের চান্দ্রপঞ্জিকার শেষ ৬টি সৌরপদ মিলে শীতকাল। চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে বছরকে ভাগ করা হয় ২৪টি সৌরপদ (solar terms)-এ। প্রতিটি সৌরপদের আছে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য। প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা সৌরপদ অনুসারে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে কৃষিকাজ আঞ্জাম দিয়ে আসছে।
ইফান উৎসব
বলছিলাম, চীনা চান্দ্রপঞ্জিকার শেষ ৬টি সৌরপদ মিলে শীতকাল। এই ৬ সৌরপদ হচ্ছে: লি তুং (শীতের শুরু), সিয়াও সুয়ে (ছোট তুষার), তা সুয়ে (বড় তুষার), তুং চি (দক্ষিণায়ন), সিয়াও হান (ছোট শীত), এবং তা হান (বড় শীত)। চীনা ভাষায় ‘লি’ মানে ‘শুরু’ এবং ‘তুং’ মানে ‘শীতকাল’। চান্দ্রপঞ্জিকার ঊনবিংশ সৌরপদ হচ্ছে ‘লিতুং’ বা ‘শীতের শুরু’। চলতি বছর লিতুং-এর শুরু ৭ নভেম্বর এবং শেষ ২১ নভেম্বর।
প্রাচীনকাল থেকেই চীনারা লিতুং সৌরপদকেই শীতের শুরু হিসেবে গণ্য করে আসছে। প্রায় প্রতি বছরই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। তাই কখনও কখনও এ সৌরপদে শীতের প্রকৃত শুরু না-ও হতে পারে। আবার, বিশাল চীনের সব অঞ্চলে একই সঙ্গে শীতের আগমন ঘটেও না। কিন্তু তারপরও শীত পড়ুক বা না-ই পড়ুক, লিতুং এলো মানেই চীনে শীত শুরু হলো। এবারও এর ব্যতিক্রম নেই।
পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা
আগেই বলেছি, চীনে ঋতু চারটি। প্রতিটি ঋতুর শুরুর দিনটি চীনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেই প্রাচীনকাল থেকেই। এই চারটি দিনে চীনজুড়ে বিভিন্ন উৎসব পালিত হয়। কোনো কোনো উৎসব চলে সপ্তাহব্যাপী। প্রাচীনকালে চীনের সম্রাট লিতুংয়ের প্রথম দিন গোসল করতেন। তারপর তিনি পরিষদবর্গ নিয়ে পূজামণ্ডপে যেতেন, পূজা দিতেন ও শীতকালকে স্বাগত জানাতেন। লিতুংয়ের প্রথম দিনে সম্রাট মাংস খাওয়া থেকেও বিরত থাকতেন।
এখন আর প্রাচীনকাল নেই, সম্রাটও নেই। তবে, চীনের কোনো কোনো অঞ্চলে উৎসব ও পূজার্বণ ঠিকই হয়। তেমনি একটি উৎসবের নাম ‘ই ফান উৎসব’ (Yifan Festival)। এটি কুয়াংসি চুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মুলান সংখ্যালঘু জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফি বছর অবশ্য এ উৎসব পালিত হয় না। প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছরে একবার, লিতুং সৌরপদে, বেশ ধুমধাম করে এ উৎসব পালন করে মুলানরা। উৎসব স্থায়ী হয় এক থেকে তিনদিন। উৎসবে তাঁরা দেবতাদের উদ্দেশ্যে পূজা দেয়, তাদের প্রশংসা করে গানবাদ্য করে। এ সময় মুলান জাতির মানুষ মুরগির রক্ত মেশানো ওয়াইন পান করে। এ সবই তাঁরা করে দেবতাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য।
শীতের শুরুতে চীনারা উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার খায়
লিতুং সৌরপদের আগেই, আসন্ন শীতের জন্য, বিভিন্ন খাদ্যশস্য সংরক্ষণ করার কাজ শেষ হয়ে যায়। লিয়াওনিং প্রদেশের পেনসি (Benxi) এলাকার মানুষের কাছে সময়টা উৎসবের। তাঁরা এ সময় পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে, তাদের উদ্দেশ্যে পূজা দেয়। পূজার অংশ হিসেবে তাঁরা ধূপ জ্বালায় ও বলিদান করে।
লিতুংয়ের প্রথম দিনে চীনের ফুচিয়ান, কুয়াংতুং ও তাইওয়ানে ‘শীতের পুষ্টিবিধান’ শীর্ষক একটি আচার পালিত হয়। শীতের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে, এসব অঞ্চলের বাসিন্দারা মুরগি, হাঁস, গরু, ও ভেড়ার মাংস এবং মাছের মতো উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার খায়। তাঁরা চার ধরনের বিশেষ চীনা হার্বাল ওষুধের সঙ্গে এসব মাছ-মাংস মিশিয়ে স্যুপ বানিয়েও খায়। এতে শরীর শীত মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট পুষ্ট হয় বলে তাঁরা বিশ্বাস করে।
থুয়ানজি
লিতুংয়ের প্রথম দিন চীনের চিয়াংসু প্রদেশের উসি (Wuxi) শহরের বাসিন্দারা থুয়ানজি (tuanzi) খায়। এটি একটি প্রথা, যা বহুকাল ধরে চলে আসছে। থুয়ানজি তৈরি হয় চাল থেকে। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি থুয়ানজি খেতে মজা। গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই থুয়ানজি তৈরি করে। তবে, শহুরে বাবুরা বাজার থেকে তৈরি থুয়ানজি কিনে খান। থুয়ানজির মধ্যে পুর হিসেবে সাধারণত শিমের মিষ্টি পেস্ট ব্যবহার করা হয়।
বেইজিং থেকে দ্রুতগতির ট্রেনে মাত্র ২৫ মিনিট লাগে থিয়েনচিন যেতে। কেন্দ্রশাসিত এই ঐতিহ্যবাহী শহরের বাসিন্দারা লিতুংয়ের প্রথম দিন চীনা কুমড়ার পুর দেওয়া ডাম্পলিং খেয়ে থাকে। এই কুমড়া সাধারণত গরমকালে ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়। সেই সংরক্ষিত কুমড়াই লিতুং সৌরপদের প্রথম দিনের ডাম্পলিংয়ে ব্যবহার করে স্থানীয় বাসিন্দারা।
চীনা কুমড়া
শুধু থিয়েনচিনের বাসিন্দারা না, লিতুং সৌরপদের প্রথম দিন চীনের বিভিন্ন স্থানের মানুষ ডাম্পলিং খেয়ে থাকে। তবে, এক্ষেত্রে ডাম্পলিংয়ের পুর হিসেবে শুধু কুমড়া ব্যবহার করতে হবে—এমন কোনো নিয়ম নেই। ডাম্পলিংকে চীনা ভাষায় ‘চিয়াও জি’ বা ‘শুই চিয়াও’ ডাকা হয়। উত্তর চীনের এই খাবারটি সারা চীনেই জনপ্রিয়। প্রায় ১৮০০ বছর ধরে চীনারা চিয়াও জি খাচ্ছে। তবে, শুরুর দিকে চিয়াওজি ছিল এক ধরনের ওষুধ, যা ঠান্ডায় জমে যাওয়া থেকে মানুষের কান রক্ষা করতো। চীনে একটি কথা প্রচলিত আছে আজও: লিতুং সৌরপদের প্রথম দিন ডাম্পলিং খাও/ঠান্ডায় জমে যাওয়া থেকে কান বাঁচাও।
ডাম্পলিং
ডাম্পলিং খাওয়ার সঙ্গে কান রক্ষা পাওয়ার সম্পর্ক কী? জানতে চাইলে প্রাচীনকালের একটি গল্প শুনতে হবে। প্রাচীন চীনে চাং চোং চিং নামের একজন বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। একবার শীতকালে চীনে ভীষণ ঠান্ডা পড়ে। অনেক মানুষ হয়ে পড়ে ক্ষুধায় ও ঠান্ডায় কাতর। অনেকের কান ঠান্ডায় জমে পচে যেতে থাকে। কিন্তু এ রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না। ডাক্তার চাং চোং চিং তখন অনেক ভেবেচিন্তে একটি ওষুধ আবিষ্কার করেন। এই ওষুধই আজকের ডাম্পলিং বা চিয়াও জি।
ডাক্তার সাহেব খাসির মাংস, মরিচ ও ওষুধ মিশিয়ে এক ধরনের অর্ধচন্দ্রাকৃতির পুলি পিঠা তৈরি করেন এবং সেগুলো পানিতে সিদ্ধ করে রোগীদের খেতে দেন। প্রত্যেক রোগী প্রতিদিন দুটি করে চিয়াওজি খেতে থাকে। একসময় তাঁরা সুস্থও হয়ে ওঠে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত চীনারা চিয়াওজি খাওয়া বন্ধ করেনি।
লেখক: বার্তাসম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি), বেইজিং।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/জেআইএম