সংকটের সময় বাক সংযমী হওয়াও জরুরি
এমনিতেই জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা তৈরি হয়েছে। তার ওপর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দেশজুড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে লোডশেডিং চলছে, তা দ্রুত কমার কোনো আশ্বাস কেউ দিতে পারছে না। দেশের ছোটবড় শিল্পকারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী শিল্পকলকারখানায় গ্যাস সরবরাহের আশ্বাস দিতে না পারলেও গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর পরামর্শ দিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলছেন, দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করে দিলে কিছু গ্যাস শিল্পকারখানায় দেওয়া যাবে। আর এসির ব্যবহার বন্ধ করে দিলে ২-৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।
গত ২৩ অক্টোবর রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত শিল্পে জ্বালানির সংকট সমাধান শীর্ষক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘এমন একটা সময় ছিল যখন অনেক জায়গায় বাতি (বিদ্যুৎ) ছিল না। এমনও দিন ছিল আমরা দিনের আলো দিয়ে কাটিয়েছি। আমরা যদি এখন একটু সাশ্রয়ী হয়ে দিনের বেলায় বিদ্যুতের ব্যবহার বন্ধ করে দিই, তাহলে গ্যাসের কিছু সাশ্রয় হবে।’
তিনি বলেন, ‘শিল্পকলকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর জন্য একটা সহজ সমীকরণ হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া।’ এসির ব্যবহার বন্ধ হলে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে উল্লেখ করে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী আরও বলেন, ‘এত আরাম-আয়েশ না করলেও চলে। এসির ব্যবহার বন্ধ করে দিলে ২-৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।’
সংকটের সময় সাশ্রয়ী হওয়া, মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দেওয়া খুবই জরুরি একটি বিষয়। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়ে জাতির বড় উপকার করেছেন। প্রশ্ন হলো, তিনি কার উদ্দেশ্য এই উপদেশ দিয়েছেন? দেশের কত ভাগ মানুষ এসি ব্যবহার করেন? কারা এসি ব্যবহার করেন? এসি ব্যবহার বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়ার আগে তিনি কি এর ব্যবহারকারী কারা তা একবারও ভেবে দেখেছেন?
বঙ্গভবন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, সেনানিবাস, মন্ত্রীপাড়া, সচিব বা বড় সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবনে কি এসি ব্যবহার বন্ধ করা যাবে? ভিভিআইপি, ভিআইপি, সিআইপিসহ হোমড়াচোমরারা এসি ব্যবহার বন্ধ করলে নিশ্চয়ই অনেক মেগাওয়াট বিদ্যুতের সাশ্রয় হবে। কিন্তু এটা করা কি সম্ভব হবে? তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী নিজের বাসার এসি ব্যবহার বন্ধ না করে অন্যদের সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে উচিত কাজ করেছেন কি না, সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কথায় আছে, আপনি আচরি ধর্ম অপরে শেখাও।
নিজে এসির ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগিয়ে, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে এসি বন্ধের বক্তৃতা দিলে সেটা হাস্যকর না হয়ে যায় না! সংকটের সময় বাহুল্য সবই বর্জন করা উচিত, এমনকি বাক সংযমী হওয়াও জরুরি। সংকটকালেও যে সরকারের মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে তা স্পষ্ট হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী প্রয়োজনে দিনের বেলায় বিদ্যুতের ব্যবহার বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়ার পর দিন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের বক্তব্য থেকে। । এ নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘তৌফিক-ই-ইলাহী সাহেব যেটি বলেছেন, সেটি তাঁর ব্যক্তিগত কথা এবং তিনিই তাঁর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। সরকারের এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেই।’
এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা কোনো ‘ব্যক্তিগত কথা' বলতে পারেন কি না, সেটাও একটি বড় প্রশ্ন। সরকারের সুবিধা হলো, তাদের সত্যি সত্যি কাজকর্মের জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে দায়িত্ব যাদের হাতে তারা তাদের খুশিমতো ব্যাখ্যা দিয়ে বা মনভোলানো কথা বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এতে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে সরকার প্রধানের।
জ্বালানি উপদেষ্টা যে বৈঠকে বক্তৃতা করেছেন, একই বৈঠকে রপ্তানিমুখী শিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পকারখানার মালিকেরা তাঁদের বক্তব্যে গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ৪০-৬০ শতাংশ কমেছে বলে উল্লেখ করেন। তাঁরা রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদনের গতি ঠিক রাখার জন্য স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির অনুরোধ করেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন শিল্পকারখানার চাকা সচল রাখতে ছয় মাসের জন্য স্পট মার্কেট থেকে প্রতি মাসে ২০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে প্রতিদিন ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের পরামর্শ দিয়েছেন।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন নিজের কারখানায় গ্যাসের সংকটের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেছেন, পোশাক কারখানার মালিকেরা গ্যাসের জন্য ফোন করে বলেন, গ্যাসের অভাবে কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। বলা হয়েছিল, তেলের দাম বাড়ালে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন লোডশেডিং আরও বেড়ে গেল।’
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেছেন, একদিকে রেমিট্যান্স কমছে অন্যদিকে পোশাক রপ্তানি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ কমে গেছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে আমদানি এলসি খোলা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু জুন থেকে দেখছি আমদানি এলসি ক্রমাগতভাবে কমছে।
হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, ‘গ্যাসের অভাবে আমার স্পিনিং মিলগুলো সন্ধ্যার পর বন্ধ করে রাখতে হচ্ছে। কারখানার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, দিনে যেহেতু গ্যাসের অভাবে কোনো কাজ হয় না, তাহলে দিনের শিফটে যারা কাজ করে, তাদের চাকরি থেকে ছাঁটাই করে দিই।’কারখানা সচল রাখতে না পারলে মালিকের সামনে ছাঁটাইয়ের কোনো বিকল্প থাকবে না।
কিন্তু শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের বৈঠকে যেসব সমস্যার কথা বলা হয়েছে এবং একই সঙ্গে যেসব পরামর্শ দিয়েছেন সে ব্যাপারে কোনো আশাবাদী বক্তব্য উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহি চৌধুরীর মুখে শোনা যায়নি বরং তিনি বলেছেন, ‘প্রতি মাসে স্পট মার্কেট থেকে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি কিনতে ২০০ মিলিয়ন ডলার লাগবে। ছয় মাস এলএনজি কিনলে ব্যয় করতে হবে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, সেই জন্য আমরা এখন স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করার মতো রিস্ক নিতে পারব না।’
সরকারকে তো সংকট কিংবা যে কোনো জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য কখনো কখনো কিছু ‘রিস্ক’ বা ঝুঁকি নিতে হয়, নিতে হবে। রিজার্ভ কমে আসার জন্য ডলার ব্যবহারে নিশ্চয়ই সতর্ক হতে হবে। আমরা নাগরিকদের বেড়ানোর জন্য বিদেশ যাওয়া বন্ধ করতে পারছি না। এমন কি কেনাকাটার জন্যও অনেকে দেশের বাইরে যাচ্ছেন এবং দেদারসে ডলার খরচ করে আসছেন। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না, কারণ সরকারের লোকজনও অকারণে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেন না। ছাগল পালন শেখার জন্যও লাখ লাখ ডলার ব্যয় করে বিদেশ যাচ্ছেন সরকারি প্রতিনিধি দল। কেন এই বিদেশ যাওয়ায় রাশ টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না? সরকার সাধারণ মানুষকে কৃচ্ছ্র সাধনের কথা বলবে, আর নিজেদের লোকদের ডলার ব্যয়ে উদারতা দেখাবে, তাহলে তো হবে না। আইন বা নিয়ম সবার ক্ষেত্রে একভাবে প্রযোজ্য না হলে সেই আইন বা নিয়ম অর্থহীন।
ওদিকে সরকারের প্রতিপক্ষ বা সমালোচকরা বসে নেই। তারা সত্য মিথ্যা মিলিয়ে এমন সব প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে যা মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। বিএনপি সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিদ্যুৎ খাতে বিপর্যয়ের পেছনে সরকারের দুর্নীতি, লুটপাট ও চুরিকে দায়ী করছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গত ২৪ অক্টোবর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘যেদিকে তাকান শুধু চুরি আর চুরি। চুরি ছাড়া কিচ্ছু হয় না এখানে। যত মেগা প্রকল্প দেখেন, সবকিছুর মূলে আছে চুরি।
তৌফিক-ই-ইলাহীর বক্তব্যের প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘তাদের (সরকার) উপদেষ্টা খুব কষ্ট করে বলেছেন, পয়সাই নাই, বিদ্যুৎ দেব কোত্থেকে? এই হচ্ছে তাদের উন্নয়ন। এই হচ্ছে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। সরকারের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘কিছুদিন আগে তো বললেন পয়সার কোনো অভাব নাই, পর্যাপ্ত ডলার রিজার্ভ আছে। সেই রিজার্ভ গেল কোথায়? এখন আবার উপদেষ্টা বলছেন, বিদ্যুৎ আর দিনে দিতে পারব না, রাতে দিতে পারব।’
বিরোধীদের এইসব সমালোচনার যুৎসই জবাব সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া জরুরি। পরিস্থিতি জটিল। সহজ কথায় মানুষকে বোঝানো যাবে না। বিদ্যুতের উৎপাদন তো ঠিকই এই সরকারের আমলে বেড়েছিল। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কথা তো গল্প নয়, সত্যি। কিন্তু এখন কেন সেটা মুখ থুবড়ে পড়লো? রিজার্ভ যে এই সরকারের আমলেই রেকর্ড পরিমাণ হয়েছিল, এটাও তো মিথ্যা নয়। এখন রিজার্ভ কেন কমছে?
এই প্রশ্নগুলোর যুক্তিসংগত জবাব সরকার ও সরকারি দলের নেতাদেরই দিতে হবে। অন্য দেশের তুলনায় আমরা ভালো আছি-এটা বললে মানুষ বিরক্ত হবে। সাধারণ মানুষ অন্য দেশের খবর রাখে না। মানুষ চোখের সামনে কিছু মানুষ অঢেল টাকাপয়সা হওয়ার ঘটনা দেখছে এবং যাদের টাকাপয়সা হচ্ছে তারা কেউ বিরোধী দলের মানুষ নয়। এই অল্পসংখ্যক মানুষ আলাদিনের চেরাগ কোথায় পেলো, তা তো অন্যদের বুঝতে হবে। এটা বোঝাতে না পারলে মানুষের ক্ষোভ তো বাড়তেই থাকবে। আর এর সুযোগ নেবে তারা, যারা ধোঁয়া দেখলেই আলু পোড়া দিতে উৎসাহী হয়ে ওঠে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক. কলামিস্ট।
এইচআর/জেআইএম