লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে উন্নয়ন!
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে অনেক। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বাংলাদেশের ঋতুচক্র ওলটপালট হয়ে গেছে। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ- এটি এখন আর সত্যি নয়। ক্যালেন্ডারের পাতায় ছয়টি ঋতুর নাম লেখা থাকলেও এখন প্রায় পুরোটাই যেন গ্রীষ্মকাল। অল্প একটু বর্ষাকাল, আর অল্প একটু শীতকাল।
এবার ভরা বর্ষায়ও বৃষ্টির দেখা মেলেনি। যেমন এখন ক্যালেন্ডারের পাতায় হেমন্তকাল। কিন্তু প্রকৃতির দিকে তাকালে বোঝার উপায় নেই। কার্তিক মাসেও ভাদ্রের উত্তাপ। প্রকৃতির এন বিরূপ আচরণ বিপাকে ফেলেছে সরকারকে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিদ্যুৎ বিভাগ।
প্রকৃতির উত্তাপ কমে আসবে এ ভরসায় সরকার আশ্বাস দিয়েছিল অক্টোবর নাগাদ বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এখন তারা দিন গুনছে নভেম্বরের। তবে প্রকৃতির যে ওলটপালট আচরণ, তাতে বিদ্যুৎ বিভাগ নিজেদের সামলে নেওয়ার জন্য খুব বেশি সময় পাবে না। যুদ্ধ না থামলে, জ্বালানি পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী বছর বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতি আজ লেজেগোবরে। তবে বর্তমান সরকারের সাফল্যের একটা বড় ক্ষেত্র ছিল বিদ্যুৎ। সেই খাতই এখন সরকারের গলার কাঁটা হয়ে গেছে। এটা মানতেই হবে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২০০১-২০০৬ সময়কালের শাসনামল ছিল আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা অন্ধকার সময়।
বিদ্যুৎ নিয়ে তখন দেশজুড়ে হাহাকার ছিল। লোডশেডিং ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। বিদ্যুৎ কখন আসে সেটাই ছিল গবেষণার বিষয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাই বিদ্যুৎ খাতকে অগ্রাধিকার দেয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। ফল মেলে হাতে হাতে। ৫৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের বাংলাদেশকে বর্তমান সরকার তুলে এনেছে ২২ হাজার মেগাওয়াটে। ক্যাপটিভ পাওয়ার ধরলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আবার লোডশেডিংয়ের ভোগান্তি ফিরিয়ে এনেছে।
শুধু ফিরিয়ে এনেছে বললে ভুল হবে, লোডশেডিং দাপটের সাথেই ফিরে এসেছে। সরকার পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের কথা বললেও সে অবস্থায় থাকতে পারেনি। বেপরোয়া লোডশেডিংয়ে এখন বিপর্যস্ত জনজীবন। বিদ্যুৎ কখন আসে কখন যায়, তা নিয়েই এখন খেলা। শহরের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা বেশি হয় বটে, তবে গ্রামের পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিদ্যুৎ থাকার চেয়ে না থাকার সময়ই বেশি।
বিদ্যুৎ একটা অতি জরুরি পণ্য। বিদ্যুতের সাথে উন্নয়নের ওতপ্রোত সম্পর্ক। লোডশেডিংয়ে আমরা শুধু নিজেদের ভোগান্তির কথাই ভাবি। বিদ্যুৎ না থাকলে গরমে কষ্ট পাই। বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলায় ঘরে ঘরে নষ্ট হচ্ছে ইলেকট্রিক সামগ্রী। চাহিদা বেড়েছে আইপিএস, জেনারেটর, রিচার্জেবল ফ্যান-লাইটের।
তবে ঘরে ঘরে লাইট-ফ্যান-এসির চেয়েও শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজনটা আরও বেশি। বিদ্যুৎ না থাকলে উৎপাদন বিঘ্নিত হয়, উন্নয়ন মন্থর হয়, অর্থনীতির ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। সেচ বিঘ্নিত হলে কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হয়। সব মিলিয়ে এক বিদ্যুৎ সংকট ডেকে আনছে অনেক সংকট, পঙ্গু করে দিচ্ছে দেশের অর্থনীতিকেই।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে উন্নয়নকে মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করে। আর সে কারণেই তাদের প্রথম নজর ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদনে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ায় গতি পায় উন্নয়নের চাকাও। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে সরকার ব্যয়ের দিকে নজর দেয়নি। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সরকার চড়া দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যায়। ক্যাপাসিটি চার্জে চলে যায় হাজার কোটি টাকা। তাই উন্নয়নে গতি এলেও চড়া দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন অর্থনীতিতে উল্টো চাপ তৈরি করে। আমাদের অর্থনীতি এগোচ্ছে। তবে অবস্থা এখনও পা ঢাকলে মাথা উদোম হয়ে যায়, মাথা ঢাকলে পা।
এখন যে বিদ্যুতের জন্য দেশজুড়ে হাহাকার, তার কারণ কী? অনেকে বলছেন, এত সক্ষমতা, এত বিদ্যুৎ গেলো কই। সমস্যাটা আসলে তৈরি হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে। হঠাৎ করে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, ডলারের পাগলা ঘোড়া হয়ে যাওয়া, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি- সব মিলে বিদ্যুৎ খাত এলোমেলো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সক্ষমতা এখনো ক্যাপটিভসহ প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াটেই আছে।
চাইলেই সরকার ঘরে ঘরে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমাদের অন্য অনেক জরুরি কাজে অর্থের টান পড়বে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় কমাতেই সরকার ইচ্ছা করে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। বর্তমান বিদ্যুৎ সংকটটি তাই ইচ্ছাকৃত, অনুমিত এবং পরিকল্পিত। তবে পরিকল্পিত সংকট হলেও সেটাকে সরকার দক্ষতার সাথে সামাল দিতে পারেনি। আসলে দীর্ঘদিন লোডশেডিং করতে হয়নি বলে, সরকার হয়তো লোড ম্যানেজমেন্টের বিষয়টাই ভুলে গেছে।
বিদ্যুৎ সংকটটা দারুণ একটা চক্রে আবদ্ধ। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গেলে রিজার্ভে টান পড়ে, আবার কমালে সার্বিক উৎপাদনে টান পড়ে। তবে আমরা এখন নগদ অর্থ বাঁচাতে গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে লাগাম টেনে ধরেছি। কিন্তু সেই লাগাম যদি শিল্প ও খাদ্য উৎপাদনেও টান লাগায় তখন দীর্ঘমেয়াদে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। ডিজেল কেনার টাকা নেই বলে আমরা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখছি বটে, কিন্তু লোডশেডিংয়ে জেনারেটর চালাতে ডিজেলের চাহিদা বেড়েছে। আসলেই এই লাভক্ষতির ভারসাম্য বজায় রাখা সত্যি কঠিন।
এটা ঠিক যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে, বৈশ্বিক অর্থনীতি টালমাটাল থাকলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি উন্নতির সম্ভাবনা নেই। সরকারকে গাল দিয়েও পরিস্থিতির বদল হবে না। আমাদের সবাইকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে মনোযোগ দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী অনেকদিন ধরেই কৃচ্ছসাধনের কথা বলছেন। গত সপ্তাহে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় উইনিটের পারমাণবিক চুল্লি বসানোর কাজ উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতির কারণে আমাদের একটু সাশ্রয়ী হতে হচ্ছে। তার মানে এই নয়, দেশের মানুষ বিদ্যুৎ পাবে না। মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে, পাবে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের মিতব্যয়ী হতে হচ্ছে।’
তবে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী অতটা কৌশলী নন। তিনি আরও সরাসরি সমস্যার কথা বলেছেন, ‘আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কি হবে। এলএনজি এখন আমরা আনছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ছয় মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কি না- জানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে।’
রোববার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘আজ যদি আমরা গ্যাস বাঁচাতে চাই, তাহলে লোডশেডিং বাড়বে, তখন আপনারাই সমালোচনা করবেন। অথচ একসময় সব জায়গায় বিদ্যুৎ ছিল না। আমরা চাইলে এসি বন্ধ রাখতে পারি। বিদ্যুৎ ব্যবহার কমাতে পারি। সারাদেশে যে পরিমাণ এসি চলে, তাতেই ৫ থেকে ৬ হাজার মেগাওয়াট চাহিদা আছে। আমরা এসি বন্ধ রাখবো বা কম চালাবো। এতে দু-তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। গ্যাস সাশ্রয় হবে। সবাই মিলে যদি রাজি হই লোড কমাবো তাহলে কিছু গ্যাস রিলিজ হবে।’
সমস্যাটার আসল চিত্রটা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, ‘আমরা কৃষি ও ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যুৎ বেশি দেওয়ার চেষ্টা করবো। প্রয়োজনে অন্যরা বিদ্যুৎ ব্যবহার কম করবো। প্রয়োজনে দিনেরবেলা ব্যবহারই করবো না। বিদ্যুৎ যদি আমরা শিল্পে দেই, তাহলে আবাসিকে সাপ্লাই কমাতে হবে। সেটা করলেই আবার মিডিয়ায় অনেকেই অনেক কথা বলবেন।’
তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান নন। তাই তিনি অকপটে সত্যি কথা বলেছেন, বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। সত্য যত তেতোই হোক, সেটা মানতেই হবে। কিন্তু ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, হাজার হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন আর উন্নয়নের গল্প শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া মানুষ এই সত্য শুনতে, মানতে রাজি হবে না। বিশ্ব একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি পার করছে। কিন্তু তার পরও মানুষ তৌফিক-ই-ইলাহীর কথামতো দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার কথায় রাজি হবে না। প্রকৃতি সহায় থাকলে মাঝখানে মাস চারেকের একটা সময় পাবে সরকার। এই সময়ের মধ্যে সংবট মোকাবিলায় কোনো না কোনো উপায় বের করতেই হবে। নইলে সরকারের অনেক অর্জন হারিয়ে যাবে লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে।
২৩ অক্টোবর, ২০২২
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/এমএস