বিউটিশিয়ান নারীকে ধর্ষণ
অপরাধীদের কঠোর শাস্তি চাই
অনেক ঘটনার ভিড়ে এই ঘটনাটি হয়তো কিছুই না। কিন্তু আমাকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। তাই লিখতে বাধ্য হচ্ছি। ঘটনাটি ঘটেছে অতি সম্প্রতি। এমন একটি ঘটনা যেখানে কোনো রাজনৈতিক কালার নেই। এ ঘটনা হারিয়ে যাবে দ্রুত। এমন তো কতই হচ্ছে।
অনলাইনে একটি পেজের মাধ্যমে বিউটিশিয়ান একজন নারী কাজের খোঁজ করেন। তিনি বিভিন্ন সময় তার নারী গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়ে সার্ভিস দেন। অনলাইন পেজ থেকে তার ফোন নম্বর সংগ্রহ করে তিন যুবক। তারা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তারা নারী কণ্ঠের মাধ্যমে সেই বিউটিশিয়ানকে কাজ দেওয়ার জন্য ডেকে পাঠায়। সাভার থেকে ঢাকার শুক্রাবাদে আসেন সেই নারী। তিন যুবক তাকে ধর্ষণ করে। সেই নারী ছিলেন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই হলো ঘটনা।
পুলিশ সেই যুবকদের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশের ভাষ্য হলো তারা ফ্যান্টাসি থেকে এই কাজ করেছে। প্রশ্ন হলো ধর্ষণ, খুন ইত্যাদি মারাত্মক অপরাধ। কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখানে ফ্যান্টাসির প্রশ্ন আসে কীভাবে। অপরাধীরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে সে যখন ধর্ষণের মতো অপরাধে লিপ্ত হয় তখন সমাজের মূল্যবোধ যে কোন তলানিতে ঠেকেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নারীরা আজকাল বিভিন্ন ভাবে শ্রম দিচ্ছেন, তারা অনলাইনে অনেক পেজের মাধ্যমে বিভিন্ন রকম কাজে যুক্ত হচ্ছেন, উপার্জন করছেন। এই নারীর মতো আরও অনেক নারী আছেন যারা পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করছেন। এই ধরনের ঘটনায় অন্য অনেকের কাজের সুযোগ হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন অনেক কর্মজীবী নারী ও তার পরিবার। নারীর জন্য যদি নিরাপদ পরিবেশ না দেওয়া যায় তাহলে তারা এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাবে কীভাবে?
নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে আমার কাছে সব উন্নয়নই মূল্যহীন হয়ে যায়। এই নারীর কথা একবার ভাবুন। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কতটা শারীরিক কষ্ট সহ্য করে তিনি সাভার থেকে ঢাকার শুক্রাবাদে এসেছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে। ভেবেছিলেন তার কিছুটা টাকা আয় হবে। এখন দ্রব্যমূল্যের যে লাগামহীন অবস্থা তাতে সংসার চালানো কত কঠিন তা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে।
এই অসহায় নারী একটু উপার্জনের আশায় এত দূর থেকে এসেছিলেন। এই নরপশুদের কারণে তিনি এখন অসুস্থ। আমার কাছে মনে হয়, ধর্ষণকে যতদিন শুধু নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ হিসেবে দেখা হবে ততোদিন এই অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব হবে না। ধর্ষণকে দেখতে হবে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে।
ধর্ষণ শুধু একজন নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ নয়, এটা পুরো সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ। কারণ ধর্ষণের ফলে একজন নারী যেমন আহত হন তেমনি পুরো পরিবারের ওপরও এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ে। এটি এমন এক অপরাধ যেখানে ভিকটিম শারীরিকভাবে আহত হন, মানসিকভাবেও প্রচণ্ড ট্রমার মধ্যে পড়েন। ধর্ষণে একজন নারীর মানবিক সত্তাকে অস্বীকার করে তাকে একটি বস্তু হিসেবে গণ্য করা হয়।
এই ঘটনাটিতে পুলিশ দুজন অপরাধীকে রিমান্ডে নিয়েছে। ভালো কথা। কিন্তু মনে শংকা জাগে ভিকটিম ন্যায়বিচার পাবেন তো? নাকি বছরের পর বছর মামলা ঝুলবে? আর অপরাধীরা জামিনে বেরিয়ে এসে ভিকটিম ও তার পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করবে?
আমাদের দেশে ধর্ষণের মামলায় সাধারণত ভিকটিম থাকে দুর্বল সামাজিক অবস্থানের। ফলে বিচার চাইতে গেলেও সে প্রভাবশালী অপরাধীদের আরেক দফা নির্যাতনের মুখে পড়ে। আর আদালতে বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘোরা, মামলার খরচ জোগাতে না পারা, তার স্বল্প আয়ের ক্ষুদ্র পেশাটিও হুমকির মধ্যে পড়া এসব তো রয়েছেই। আর ঘরে বাইরে সমাজে হেয় হওয়া, শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর সংসারে অবহেলার শিকার হওয়া এগুলোও পাশাপাশি চলতে থাকে। দুর্বিষহ হয়ে পড়ে তার জীবন।
আগেও অসংখ্যবার বলেছি যে, ধর্ষণের ঘটনাগুলো দ্রুত বিচারের আওতায় আনা দরকার। দরকার ভিকটিমকে শারীরিক, মানসিক ও আইনগত সহায়তা দেওয়া। দরকার নারী ডাক্তার দিয়ে তাকে পরীক্ষা করানো, তাকে সব রকম সাপোর্ট দেওয়া।
মামলার বিচারও হওয়া দরকার ক্যামেরা ট্রায়াল পদ্ধতিতে। আসামি পক্ষের উকিলদের অযৌক্তিক ও অপমানকর জেরার হাত থেকে ভিকটিমকে বাঁচানো দরকার। আরেকটি বিষয় দেখা যায় এসব মামলার ক্ষেত্রে তা হলো ভিকটিমকে দুশ্চরিত্র প্রমাণ করার অপচেষ্টা। ভিকটিমকে যৌনকর্মীর তকমা দিতে পারলে অপরাধীদের বাঁচানো অনেকটা সহজ হয়ে যায়। অথচ একথা তো পরিষ্কার যে, ভিকটিম যেই হোক তাতে অপরাধের গুরুত্ব হ্রাস পায় না।
ধর্ষণের জন্য বাংলাদেশ কুখ্যাত হয়ে পড়েছে বিদেশেও। কারণ আজকাল তো সব সংবাদই সব দেশের হাতের নাগালে। আমরা ধর্ষক জাতি হিসেবে পরিচিত হচ্ছি। এ ধরনের নেতিবাচক ইমেজ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে দরকার ধর্ষণ বিষয়ে রাষ্ট্রের জিরো টলারেন্স মনোভাব এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ। আশাকরি সব ধর্ষণের ঘটনার বিচার হবে। সুবিচার পাবেন সব ভিকটিম। এই ঘৃণ্য অপরাধ থেকে মুক্ত হবে বাংলাদেশ।
লেখক: সাংবাদিক।
এইচআর/ফারুক/এমএস