রম্য
আমি মমতাজ...
নাম শুনেই লোকে আমাকে চিনে ফেলবে, এমন কামেল আদমী আমি নই। তাই ফাস্ট চান্সেই, মার্জনা করবেন, নিজের ঢোল নিজেকেই বাজাতে হচ্ছে। আমার নাম ইফতেখার উদ্দিন আকাশ, স্বাস্থ্য ভালো, উচ্চতা মানানসই, মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল, বয়স পঁচিশের কোঠায়, পড়ছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, থাকি মুহসীন হলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশাল একটা প্রাঙ্গণে কোনো শিক্ষার্থী সাধারণত নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণায় দগ্ধ হয় না। কিন্তু আমি হচ্ছিলাম। আমার ছিল আকাশ সমান নিঃসঙ্গতা। আকাশজোড়া নিঃসঙ্গতা নিয়ে একজন ধার্মিক কিংবা দার্শনিক সুখী হতে পারে, পারে স্বরূপ অন্বেষণের দুরূহ পথ পাড়ি দিতে।
কিন্তু ধার্মিক অথবা দার্শনিক হওয়ার কোনো বাসনা আপাতত আমার নেই আর সেজন্যই মুহসীন হল থেকে রোকেয়া-শামসুন্নাহার হলের মাঝখানের সামান্য এই মসৃণ পথটুকু অতিক্রম করতে গিয়ে বার বার আমি হোঁচট খাই আর আশা করতে থাকি এই বুঝি কেউ উদ্বেগ-আকুল কণ্ঠে বলে উঠল-
: লেগেছে? ব্যথা পেয়েছেন? আহা, কোথায় দেখি দেখি।
কিন্তু হায়, আমার এই অন্তহীন আশা কেবল সীমাহীন বেদনারই জন্ম দেয়; বেদনা উপশমের কোনো পথ বাতলে দেয় না। এই অবস্থায় উপনীত হওয়ার পর আমার বয়সী সুহৃদদের কেউ নেশা রাজ্যের রাজন রূপে অধিষ্ঠিত হয়, কেউ মানবী হৃদয়ের নিষ্ঠুরতা পরিমাপের জন্য কাব্যরথে সওয়ার হয়, আবার কেউ কাকরাইল মসজিদে গিয়ে তিন চিল্লায় নাম লেখায়।
নেশা আমার শরীরে সয় না আর কবিতা আমি লিখতে পারি না। তাই শেষোক্ত পন্থা অবলম্বন করে নাম আমিও নাম লেখালাম। তবে সেটা তিন চিল্লার খাতায় নয়, পত্রিকার পাতায়। মাসিক দেশপ্রেম পত্রিকায় নাম লিখিয়ে বক্ষপিঞ্জরে পুঞ্জীভূত বেদনাকে শব্দের আকারে বিন্যাস করে বললাম- মিতা হতে চাই। যে কোনো বয়সের ছেলে-মেয়েরা, ভাবি-খালা-ফুপুরা লিখুন। উত্তরের একশ’ ভাগ নিশ্চয়তা ইত্যাদি ইত্যাদি।
সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই তিনটা চিঠি আমার হাতে এসে পৌঁছলো, যার সবগুলোই কচি কোমল হাতের নন্দিনী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে লেখা। বাইরের জেলা থেকে আসা দুটো চিঠির আমি কোনো উত্তর দিলাম না। ঢাকার কল্যাণপুর থেকে টিসা যে গালিভার সাইজের চিঠিটি আমাকে লিখেছে, তার উত্তর আমি লিখলাম আবেগের পঙ্খীরাজে ভেসে বেড়াতে বেড়াতে। চিঠির উত্তর এলো কয়েকদিনের মধ্যেই এবং সুখের জ্যোৎস্নায় গোসল করতে করতে আমি তার প্রতি-উত্তর লিখলাম। এভাবে কয়েক পক্ষকাল চিঠি চালাচালি করার পর এক চিঠিতে আমি টিসাকে লিখলাম-
: প্রথমে চক্ষের মায়া, তারপর অন্তরের মায়া। তোমারে না দেইখ্যা তো আমি আমার অন্তরে মায়ার আবাদ করবার পারতাছি না।
উত্তরে টিসা লিখল-
: বেশ, তুমি তাহলে সতেরো তারিখ রোববার আমার কলেজের সামনে আসো।
আমি টিসার এই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়ে লিখলাম-
: কলেজ হইলো জ্ঞান অর্জনের জায়গা। ওইখানে মায়া-দর্শনের জাল বুনাটা ঠিক না। তার চেয়ে তুমি বাইশ তারিখ শুক্রবার বোটানিক্যাল গার্ডেনে চইল্যা আসো।
বোটানিক্যাল গার্ডেনে আমি কোথায় থাকবো, আমার হাতে-পায়ে-গায়ে কী থাকবে-তার বিস্তারিত বিবরণ টিসাকে লিখে দিলাম। নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে পূর্বনির্দিষ্ট সেই স্থানে একটা লাল গোলাপ হাতে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। টিসা এলো আধঘন্টা বিলম্বে। সে যে আট ঘণ্টা দেরি করেনি, সেজন্য আল্লাহ মেহেরবানের নিকট শুকরিয়া আদায় করে গোলাপসহ মোটামুটি দামি একটা উপহার টিসার হাতে তুলে দিলাম।
উপহার পেয়ে টিসা দারুণ খুশি। খুশির আমেজে, খোশ মেজাজে আমরা সারা বাগান হেঁটে বেড়ালাম, হাসলাম, গান গাইলাম। দুপুরবেলা মিরপুর-১ নম্বরে এসে একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খাবার সেরে ফের বাগানে প্রবেশ করলাম এবং আকাশে জমাট মেঘ দেখে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে থাকলাম। বৃষ্টি হলো না; তবে সৃষ্টি হলো। চার লাইনের একটা সঙ্গীত সৃষ্টি করে টিসাকে উৎসর্গ করার পর সেই গীতের ভাবার্থ অনুযায়ী কিছুটা ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা চালাতেই টিসা বাধা দিয়ে বলল-
: থামেন।
: দোহাই দেবী, অসময়ে থামাইয়া দিও না ট্রেন। ইস্টিশন অহনও অনেক দূর।
: আপনের আর ইস্টিশনে পৌঁছা হবে না।
: ক্যান?
: এজন্য যে, আমি টিসা না।
: তুমি টিসা না, কী কও!
: ঠিকই কই।
: ইয়ে আপনি, মানে তুমি তাইলে কেডা?
: আমি মমতাজ।
: মমতাজ? অসুবিধা নাই। আমি এফিডেফিট করমু। নিজেরে শাহজাহান হিসেবে ঘোষণা দিমু।
: লাভ নাই। আমার শাহজাহান আছে!
: ধুর! তুমি আমার লগে মশকরা করতেছ।
: মোটেই না।
: এই কথা তুমি আগে কও নাই ক্যান?
: বলি নাই তার কারণ আছে।
: কী কারণ?
: কারণ হইল- আপনে যখন কলেজের সামনে দেখা করার প্রস্তাব বাতিল কইরা টিসাকে এইখানে আসতে বললেন, তখন টিসার সন্দেহ হইল হয় আপনি নারী অপহরণকারী, নয়তো অন্য কোনো বদ-মতলব হাসিলকারী। কিন্তু আমি আপনের পাঠানো পাসপোর্ট সাইজের গোল আলু মার্কা ছবি দেইখ্যা মত দিলাম- এই মিয়া নিতান্তই ভদ্রলোক। তখন টিসা দুই হাজার টাকা বাজি ধইরা বলল- আজকের দিনটা আমি যদি আপনের সঙ্গে কাটাইতে পারি, তাহলে দুই হাজার টাকা আমার।
: টাকাটা তুমি পাইয়া গেলা মমতাজ।
: তাই তো মনে হইতেছে।
মমতাজের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে আর্তনাদের সুরে বললাম-
: কিন্তু আমি কী পাইলাম?
আমার এ হাহাকার মমতাজের মধ্যে কোনো ভাবান্তর নিয়ে এলো না; তবে প্রকৃতি সহমর্মিতা জানাল প্রকাশ্যে। যে বৃষ্টির জন্য আকুল ছিলাম এতক্ষণ, হঠাৎ আকাশ থেকে তা নেমে এলো করুণার জলধারা হয়ে; আমার অশ্রুধারার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হতে...
লেখক: সাংবাদিক, রম্যলেখক।
[email protected]
এইচআর/ফারুক/এমএস