অর্থনীতি
মূল্যস্ফীতির বিপদ
তথ্য সরকারি, তাই এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নেই। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে এবং ক্রমেই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাচ্ছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
পরের মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে। ওই দুই মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে আছে। আগস্ট মাসে গত ১১ বছর ৩ মাসের (১৩৫ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। ২০১১ সালের মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি আরও কখনোই ৯ শতাংশের বেশি হয়নি।
আগুন লেগেছে বাজারে। মূল্যস্ফীতির আগুন। চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং আবার বিদ্যুতের দামও চড়া। ডলারের তুলনায় টাকার দাম নিম্নমুখী। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিও সামগ্রিক মূল্যস্তরকে ঠেলে তুলছে। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে সাধারণ মানুষের।
এতদিন পর সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া গেল। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কী হারে বেড়েছে, তা সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে বহু আগে থেকেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, জাহাজ ভাড়া বেড়েছে, এলসি (ঋণপত্র) খরচ বেড়েছে। তাই, জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিন্তু মানুষ দেখছে ভিন্ন চিত্র। আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যস্তর দেশীয় বাজারের সাথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে দাম বাড়ে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে তার কোনো সুফল আমরা পাই না। বিশেষ করে ভোজ্য তেল ও জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা একেবারে স্বচ্ছ।
মূল্যস্ফীতির চাকা এক বার গড়াতে শুরু করলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা অতি কঠিন। আমরা কী সেদিকেই যাচ্ছি? কিছু পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়াতে পারে, যেটা করছে ভারতসহ অনেক দেশ। কিন্তু আমরা একটা ৯/৬ ছয়ের খেলায় আটকে আছি তো আছিই।
ডলার সঙ্কট নিরসনে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বিলাসপণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করেছে, টাকার অবমূল্যায়ন করেছে। কিন্তু এগুলোর প্রভাব মুদ্রাবাজার ও মূল্যস্ফীতির ওপর পড়েনি। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, টাকার দরপতনও অব্যাহত রয়েছে।
সুদের হার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গটিকে স্মরণে রাখতে হয়। আর্থিক বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখবার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। অন্যদিকে, জ্বালানি তেলের দাম বিপুল পরিমাণে বেড়েছে যার প্রভাব পড়ছে কৃষি পণ্য উৎপাদন বিপণনে, এবং অন্যান্য দ্রব্যের পরিবহনে। অতিমারি-জনিত আর্থিক ধাক্কা হতে আমাদের অর্থব্যবস্থা যখন ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল, তখন মূল্যস্ফীতি ফের তাকে বিধ্বস্ত করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বটি সরকারেই ছিল।
মূল্যস্ফীতির হারের এই ঊর্ধ্বগতি কিন্তু পুরোপুরি যুদ্ধের কারণে নয়। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের রাজস্ব ও মুদ্রানীতি যে পথে হেঁটেছে, এটা তারও ফল। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল আর্থিক বৃদ্ধি। তার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদ না বাড়িয়ে অর্থনীতিতে টাকার জোগান বজায় রেখেছিল। সেটা কতটা কাজে লেগেছে তার মূল্যায়ন প্রয়োজন। অন্যদিকে রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে বড় ব্যয়ের পথে চলেছে অবারিতভাবে, এখন এসে কৃচ্ছ্রতা সাধনের কথা বলছে। এই নীতিসমূহই এখন পণ্যমূল্য এবং মূল্যস্ফীতির উপরে চাপ সৃষ্টি করছে।
ঋণের সুদ কম হলেই বিনিয়োগ বাড়ে এমন কোন প্রমাণ কোথাও নেই। বরং এতে করে ঋণ প্রবাহ অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যায় এবং ঋণ খেলাপিও বাড়ে। তাই যারা বলছেন ৯ শতাংশের বেশি ঋণের সুদ হলে উদ্যোক্তারা ঋণ নিবেন না, তারা ভুল বলছেন। পণ্য বা সেবার চাহিদা থাকলে, বিনিয়োগের পরিবেশ থাকলে অবশ্যই নিবে। ক্ষুদ্রঋণে সুদের হার প্রায় ২৫ শতাংশ। সেটি নিয়েও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা লাভ করছে। এই ৯ শতাংশ সুদ প্রকৃতপক্ষে কিছু বড় ব্যবসায়ী ও ঋণখেলাপির কাছে ব্যাংকের টাকাকে সস্তা করে তুলেছে।
সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে, সুদের হার বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবেনা। কোন যুক্তিতে এটি বলা হচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়, কারণ অর্থনীতির সূত্রের সাথে তা যায় না। সুদের হার বাড়ালে অর্থের প্রবাহ কমে আসবে, যা মূল্যস্ফীতি কমাতে সাহায্য করবে। বিষয়টি খুবই অদ্ভুত যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক একদিকে অর্থ প্রবাহ কমাতে চাচ্ছে, আরেকদিকে অর্থ সস্তা করে রেখেছে।
দরিদ্র মানুষেরা এই মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি ভোগ করছেন। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে, এবং স্বাভাবিকভাবেই খাবারের দাম বাড়লে গরিব মানুষের কষ্ট বাড়ে। চারদিকে তাকালেই সেটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে, মধ্য ও নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়াচ্ছে, ভোক্তাদের জীবনমানকে দুর্বিষহ করে তুলছে। মানুষের ভেতর হতাশা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এই হতাশা থেকে সামাজিক অস্থিরতা চলে আসে কিনা সেটা ভেবে দেখবার বিষয়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।
এইচআর/এমএস