মিয়ানমার
জান্তা সরকারের পায়ের তলার মাটি আলগা হচ্ছে
মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ দিন পার করছে এখন। গোটা মিয়ানমারই এখন যুদ্ধক্ষেত্র। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে লড়াইয়ে প্রতিদিনই শক্তি হারাচ্ছে তাতমাদো বা মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে ব্যাটালিয়নগুলোর যুদ্ধ ক্ষমতা। তীব্র সেনা সংকটে পড়েছে জান্তা সরকারের বাহিনী।
ধারণা করা হচ্ছে, যুদ্ধের জন্য মাত্র ৪৫ হাজারের মতো সেনা রয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে। তাদের এখন সশস্ত্র ডাকাত হিসেবে ডাকা হয়। কারণ বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযানের সময় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় তারা। গণহারে চলে লুটতরাজ। এমনকি মুক্তিপণ আদায়ের জন্য মানুষকে অপহরণ করে তারা, যা পুরো বাহিনীকে একটি বিশৃঙ্খল বাহিনীতে পরিণত করেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, মিয়ানমারের মাত্র ১৭ শতাংশ ভূমিতে এখন নিয়ন্ত্রণ রয়েছে জান্তা সরকারের। অন্যদিকে ৫২ শতাংশ এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে জাতীয় ঐক্যের সরকার। তবে এই তথ্যের যথার্থতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
দেশজুড়ে এমন সংঘাতময় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। পরদিন ছিল নির্বাচিত এমপিদের শপথগ্রহণ। সু চি সরকারের অভাবনীয় বিজয়কে মেনে নিতে না পেরে ১ ফেব্রুয়ারির সকালে সেনা অভ্যুত্থান ঘটান জেনারেল মিং হ্লাইয়িং।
দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন সু চির এনএলডি দলের সমর্থকসহ সাধারণ মানুষ। কিন্তু তাদের এই বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলি চালায় সেনাবাহিনী, যা আধুনিক বিশ্বে নজিরবিহীন ঘটনা। জান্তা সরকারকে শান্তির ভাষা বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নেন নাগরিকরা। প্রথমে জাতীয় ঐক্যের সরকার ও পরে তার অধীনে গঠন করা হয় বিদ্রোহী বাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস।
বহু জাতিসত্তার বৈচিত্র্যপূর্ণ এক দেশ মিয়ানমার। দেশটিতে সরকার স্বীকৃত নৃগোষ্ঠী রয়েছে ১৩৪টি। যার মধ্যে বামাররা হলো প্রধান জনগোষ্ঠী। যারা মোট জনসংখ্যার ৬৮ শতাংশ। তারা বার্মিজ ভাষায় কথা বলে, যা বার্মার দাপ্তরিক ভাষা। এরপর গুরুত্বপূর্ণ ৮টি নৃগোষ্ঠী হলো শ্যান, কারেন, চিন, কাচিন, কায়িন, কায়াহ, মঙ ও রাখাইন। বার্মায় এই আটটিকে বলা হয় ‘প্রধান জাতীয় নৃগোষ্ঠী’। রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত ১৩৪টির বাইরে রোহিঙ্গা ছাড়াও ‘বার্মিজ চাইনিজ’, ‘বার্মিজ ইন্ডিয়ান’, গুর্খা ইত্যাদি বেশকিছু জনগোষ্ঠী রয়েছে।
বার্মিজ চাইনিজ ও ইন্ডিয়ানরা পুরো জনসংখ্যার অন্তত ৪-৫ শতাংশ হবে। এর মধ্যে চাইনিজরা হবে প্রায় ১৬-১৭ লাখ এবং ইন্ডিয়ানরা প্রায় ১০ লাখ। দুই জনগোষ্ঠীই পেশায় মূলত ব্যবসায়ী। বার্মিজ ইন্ডিয়ানরা থাকেন মূলত ইয়াঙ্গুন ও মান্দালেতে। চাইনিজদের প্রভাবশালী অংশের বাসও মান্দালেতে।
সাতটি স্টেইট কাচিন, চিন, রাখাই, কায়াহ, কারেন, মোন ও শানে জান্তা বাহিনীর সাথে বিদ্রোহী বিভিন্ন বাহিনীর সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্যে রাখাইন ও শান স্টেইটে চলছে তীব্র যুদ্ধ। যাতে শীর্ষে রয়েছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস-পিডিএফ ও আরাকান আর্মি। এছাড়া সাতটি রিজিয়নের মধ্যে মান্দালে, সাগাইং ও ইয়াঙ্গুন রিজিয়নে জান্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ চলছে।
চিন স্টেইটে চিন ন্যাশনাল আর্মি ও চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স, কায়াহ স্টেইটে কারেননি আর্মি ও কারেননি ন্যাশনালিটিজ ডিফেন্স ফোর্স, কারেন স্টেইটে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন-কেএনইউ, শান স্টেইটে কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্ট আর্মি-কেআইএ, মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি ও শান স্টেইট প্রোগ্রেস পার্টি-এসএসপিপি মিয়ানমার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। এছাড়া প্রায় সব স্টেইট ও অঞ্চলে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের সদস্যদের সরব উপস্থিতি রয়েছে।
যত দিন যাচ্ছে ততই দুর্বল হচ্ছে তাতমাদো বা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। কয়েকদিন পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে খবর মিলছে তাতমাদো ছেড়ে বিদ্রোহী বিভিন্ন গোষ্ঠীতে নাম লেখানোর। এই ধারা অব্যাহত থাকলে শিগগির পতন হবে জান্তা সরকারের। আবারো গঠিত হবে জনগণের সরকার। তখন মিলিশিয়া বিদ্রোহীদের সবাইকে নিয়ে সরকার এগিয়ে নেয়ার নতুন চ্যালেঞ্জ শুরু। যুদ্ধ বিধ্বস্ত অনেক দেশেই ওই যাত্রা সুখকর হয়নি।
লেখক: নিউজ এডিটর, চ্যানেল 24।
এইচআর/ফারুক/এএসএম