বিজয়া দশমী

দূর হোক অন্ধকার, ছড়িয়ে পড়ুক আলো

দুলাল আচার্য
দুলাল আচার্য দুলাল আচার্য
প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ০৫ অক্টোবর ২০২২

বরাবরের মতো এবারও দুর্গোৎসবকে ঘিরে দেশব্যাপী আনন্দ-উৎসবের ফল্গুধারা বিরাজমান। শরতের শুভ্র আকাশ, কাশফুলে হাওয়ার নাচন আর আগমনী ঢাক-শাঁখের আওয়াজ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে আবহমান বাংলা। গ্রাম-নগরে ধনী-গরিব ছোট-বড় সবাই মিলিত হন শরতের এই বাঙালির উৎসবে। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত এই শারদীয় দুর্গোৎসব, যা বাঙালি সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচাইতে বড় উৎসব হলেও এখন সেটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।

এ বছর দেবীর গজে আগমন ও নৌকায় গমন। এবার সারাদেশে প্রায় ৩২ হাজারের মতো স্থায়ী ও অস্থায়ী পূজামণ্ডপে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছে ভক্তরা। সামনের বছরটি যাতে সুখ-সমৃদ্ধি কাটাতে পারে মায়ের সন্তানরা সেই প্রার্থনা সবার। দেবী বোধনের মাধ্যমে মহাষষ্ঠী, মহাসপ্তমী, মহাঅষ্টমী এবং মহা নবমী পেরিয়ে আজ মহাদশমী। দেবী বিসর্জন। প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসবের।

আজ বিজয়া দশমী, অশ্রুসজল নয়নে ভক্তকুল দুর্গতিনাশিনী দেবীদুর্গাকে বিদায় জানাবেন। সনাতন ধর্ম মতে, দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে। মহালয়ার মধ্য দিয়ে যে দেবীপক্ষের সূচনা হয়েছিল বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তার সমাপ্তি ঘটছে। এই ফিরে যাওয়ার মধ্য দিয়েই জগৎজননী প্রকৃতি ও মানবকুলকে আলোকিত করে যাবেন। আগামী শরতে মা আবার ফিরে আসবেন- এমন প্রত্যাশা নিয়েই মাকে বিদায় জানাবেন তার ভক্তরা।

হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। শরৎকাল মানেই দেবীদুর্গার আগমনীবার্তা। প্রতিবারের মতো দেবীবরণে এবারও প্রস্তুত ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। অসুর নাশকারী দেবীর পৃথিবী স্পর্শে পূর্ণতা পায় ঋতুরাণী শরৎ। দেবীর সন্তুষ্টি লাভে পাঁচ দিনব্যাপী পূজার্চনায় মেতে ছিল সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী মানুষজন।

উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। বিশ্বব্যাপী নির্মল সম্প্রীতি থেকে উৎসারিত উৎসবের ফল্গুধারা বইছে। সাড়ম্বরে এই উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও কল্যাণময় অবস্থানের বিকাশ আরও বিস্মৃত এবং বিকশিত হয়। অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে মঙ্গলদায়ক, শুভশক্তি ও ইতিবাচক চেতনার সম্প্রসারণ ঘটে। সামাজিক সহিষ্ণুতা ও উদারতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারি এক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখে।

ভক্তকুলের আশ্রয় মা দুর্গা। সুখে-দুঃখে সব কিছুতেই মা, তাই তার রূপ মাতৃরূপ। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, মায়ের ওপর সন্তানের জোর বেশি খাটে, তাই মাতৃরূপে তার আরাধনাই হিন্দুদের কাছে অধিক প্রাধান্য। তাই মায়ের দশ হাত সর্বব্যাপিত্বের প্রতিনিধি। সন্তানের কল্যাণ কামনায় সব সময় মন্দের সাথে মা যেমন যুদ্ধরত, এখানে মন্দের রূপ অসুরের সঙ্গে মায়ের শক্তি আলাদা করে বর্ণনায় দেখা যায়। ১. শ্রীলক্ষ্মী ধনশক্তি মা- জগৎ পালিনা মা বিষ্ণু শক্তি, ২. শ্রীশ্রী সরস্বতী- মায়ের জ্ঞানের বা সাত্ত্বিকতার প্রতীক, ৩. শ্রীশ্রী গণেশ-গণদেবতা বা জনশক্তির রূপ/শূদ্র বর্ণ, ৪. শ্রীশ্রী কার্তিক-মায়ের ক্ষাত্রশক্তি পরাক্রমশালী চির তারুণ্য যুবশক্তি, ৫. সিংহ- হিংস্রতা, পশুত্ব এবং রজোগুণের প্রতীক, ৬. অসুর- অহঙ্কার, কাম ও তমোগুণের প্রতীক।

আসলে সব শক্তির আধার মা। তাই অশুভ (অসুর) শক্তিকে মা রেখেছেন পদতলে অর্থাৎ জগতে কোন ভালো কাজ করতে হলে মাকে যেমন প্রয়োজন দৈব ও কল্যাণ শক্তিরূপে, তেমনি প্রয়োজন ইস্টলাভের জন্য হিংস্র পশুশক্তি ও অশুভ (কাম) ক্রোধ দম্ভ দর্প অজ্ঞানতাকে পদদলিত করা।

হিন্দু ধর্মে দেবীদুর্গা পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী এবং কালীর অন্যরূপ। দেবীদুর্গার পুরো কাঠামোতে থাকে ৮টি মূর্তি। এটি তার সংহতি শক্তি বা সব শক্তির ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখানো এক রূপের স্থিতি। যেমন- গীতায় শ্রীকৃষ্ণ তার এক অঙ্গে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন। তেমনি সর্বশক্তি মায়েরও সেইরূপ এক কাঠামোতে পরিস্ফুটন করা হয়েছে।

প্রত্যেক জাতি, দেশ, রাষ্ট্র চারটি শক্তির মাধ্যমে গঠিত হয় এবং প্রসার ও স্থিতি লাভ করে। এই চারটি শক্তি হচ্ছে জ্ঞান, ক্ষেত্র, ধন ও জনশক্তি। গীতায় বলা হয়েছে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র বর্ণরূপে। মূলত এ ভাগ কোন ভেদ বা পৃথকীকরণ নয়, একের মধ্যেই যে এ চারের অবস্থান তাতেই দেখানো হয়েছে। দেবী দুর্গা কাঠামোতে জাতি ভেদ নয়, প্রকৃত প্রস্তাবে একই দেহে চারগুণের এক দেহে অবস্থিত চার শক্তির কথাই গীতায় বলা হয়েছে। কাঠামোতে প্রধান রূপ মায়ের। মা দুর্গার আধ্যাত্মিক রূপ হলো দুঃখ। তবে দুর্গতিনাশিনী সর্বকল্যাণ কাম্য দশভুজা মা এক কিন্তু অনন্ত অসীম।

দুর্গাপূজার প্রধান আবেদন হলো ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’। সব অশুভ শক্তি নির্মূল করার জন্য পৃথিবীতে প্রতি বছর দুবার দেবীদুর্গার আগমন হয়। প্রাচীনকাল থেকেই বছরের চৈত্র মাসে বসন্তকালে বাসন্তী নামে পৃথিবীতে মা দুর্গা আবির্ভূত হন, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসন্তী পূজা- এটা দুর্গার আরেক রূপ। শরৎকালে শারদীয়া নামে। দুই পর্বেই অসুরের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন দুর্গতিনাশিনী। সেই থেকে বিজয় ঘটে শুভশক্তির। দেবীর আগমন ঘটে অন্যায়ের বিনাশ ঘটিয়ে সজ্জনদের প্রতিপালনের অঙ্গীকার নিয়ে, মানুষের মধ্যে নৈতিক আদর্শ জাগ্রত করার জন্য। মানুষের চিত্ত থেকে যাবতীয় দীনতা ও কলুষতা দূরীভূত করার জন্য। এ জন্য দুর্গোৎসব ধর্মীয় উৎসব হলেও তা সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। সম্প্রদায়গত বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে এক পরম আনন্দের সোপানে দাঁড় করাচ্ছে। শারদীয় দুর্গোৎসব সবার জন্য থাকে উন্মুক্ত। দেবীদুর্গার আগমনী আনন্দকে সবাই ভাগাভাগি করে নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাঙালি জাতি নিরন্তর উন্মুক্ত উৎসবমুখর পথে চলতে পছন্দ করে। এই পছন্দের স্রোতধারায় এই ক’দিন ভিন্ন আমেজ ও ভিন্নতর সুবাতাস বয়ে ছিল দেশজুড়ে।

বাংলাদেশ বরাবরই ধর্মীয় সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির এক মেলবন্ধ। সবাই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করছেন। ধর্ম যার যার উৎসব সবার- এই অধিকার নিশ্চিত হয়েছে এদেশের মানুষের। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবার পূজাকে সীমিতকরণে করা হলেও আনন্দঘন আবহের সৃষ্টিতে কোথাও কমতি ছিল না। পূজায় এবার দেশের কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সামাজিক সহিষ্ণুতা ও উদারতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারি এক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে।

মায়ের কাছে প্রার্থনা কলুষমুক্ত সমাজ, সুন্দর দেশ ও সুস্থ পৃথিবী গড়া। মানব-ধরা আজ নানা অপশক্তির কোপানলে। বলা যায়, মহামারি করোনা পরবর্তী সমগ্র বিশ্ব আজ মহাসংকটের মধ্য দিয়ে পথ অতিক্রম করছে। এই বৈশ্বয়িক এই সংকটে জগৎমাতা দেবীদুর্গার সুদৃষ্টি সর্বাগ্রে প্রয়োজন। মায়ের আশীর্বাদ পর্যবসিত হোক এই বসুন্ধরায়। দূর হোক অন্ধকার, ছড়িয়ে পড়ুক আলো। মানুষের মাঝে উদয় হোক শুভবুদ্ধি। বিরাজ করুক শান্তির সুবাতাস।

মায়ের কাছে এই মুহূর্তের প্রার্থনা। মা তার ভক্তকুলকে সব অশক্তির হাত থেকে রক্ষা করবেন অতীতের মতো। ধর্ম মানুষে মানুষে প্রীতি, প্রেম, সহিষ্ণুতা, ঐক্য ও শান্তির ডাক দিয়ে যায়। তারপরও অসুরের আকস্মিক উন্মত্ততা নষ্ট করে দেয় আবহমানকালের প্রীতিধন্য পারস্পরিক অবস্থানকে, ধ্বংস করে দেয় দীর্ঘকালীন হৃদ্যতাকে। সৃষ্টি হয় বৈষম্য, বিভেদ, হিংসা, অন্যায় ও অকল্যাণ আর এজন্যই মঙ্গলদাত্রী দেবীদুর্গার আগমন ঘটে কল্যাণ ও শান্তিকে সংস্থাপন করার জন্য। বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ থাকবে, দূর হয়ে যাবে সব সঙ্কীর্ণতা ও বিভেদ। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি রক্ষা হোক- এমন প্রার্থনাই করুণাময়ীর কাছে।

লেখক: সাংবাদিক।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। বিশ্বব্যাপী নির্মল সম্প্রীতি থেকে উৎসারিত উৎসবের ফল্গুধারা বইছে। সাড়ম্বরে এই উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও কল্যাণময় অবস্থানের বিকাশ আরও বিস্মৃত এবং বিকশিত হয়। অশুভ শক্তির পরাজয় ঘটিয়ে মঙ্গলদায়ক, শুভশক্তি ও ইতিবাচক চেতনার সম্প্রসারণ ঘটে। সামাজিক সহিষ্ণুতা ও উদারতা এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারি এক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।