নির্বাচন

মাঠ দখলের রাজনীতি: কার প্রস্তুতি কতটা

বিভুরঞ্জন সরকার
বিভুরঞ্জন সরকার বিভুরঞ্জন সরকার
প্রকাশিত: ০৯:১১ এএম, ০৪ অক্টোবর ২০২২

রাজনীতির মাঠ গরমের চেষ্টা চলছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকি, হুংকার দিয়ে চলেছে। বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের ঘোষণা দিয়েও এখন পর্যন্ত তা গড়ে তুলতে পারেনি। আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাল্টা যেসব উদ্যোগের কথা শোনা যায়, তারও তেমন কিছু এখনও দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। তবে উভয় পক্ষ যে তৎপর রয়েছে, অন্তত পরস্পরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিয়ে তা প্রতিদিনের খবরের কাগজের পাঠকদের জানা।

দেশের রাজনীতি নিয়ে ভবিষ্যৎদ্বাণী করা সহজ নয়। কারণ রাজনীতি যেমন কোনো নিয়ম মেনে চলছে না, তেমনি রাজনৈতিক দলের নেতারাও যা বলেন, সেটা তাদের মনের কথা বা বিশ্বাসের কথা নয়। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে, আবার টানা ক্ষমতায় থাকার যন্ত্রণায় ভুগছে আওয়ামী লীগও।

পরিস্থিতি কোন দলের অনুকূলে তা এক কথায় বলাও কঠিন। রাস্তাঘাটে যদি কাউকে ধরে জিজ্ঞেস করা হয়, দেশে সুষ্ঠু ভোট হলে কোন দল জিতবে, জবাব সম্ভবত আওয়ামী লীগের পক্ষে পাওয়া যাবে না। কারণ কি? মানুষের সমর্থন যে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেই তা তো বিএনপির অবস্থা দেখে বোঝা যায় না। বিএনপির সভা-সমাবেশে জমায়েত বাড়ছে কিন্তু সেটা কি সরকারের জন্য ভীতিকর?

এই প্রশ্নের জবাবে বিএনপি সমর্থকরা বলবেন, সরকার টিকে আছে বিভিন্ন বাহিনীর জোরে। পুলিশকে মাঠে না নামালে সরকার নিরাপদ থাকতে পারবে না। যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই তো দেশ উন্নয়নের পথে চলছে। বিএনপি শাসনে কি এখনকার চেয়ে মানুষ সুখে-শান্তিতে ছিল? তুলনামূলক আলোচনা এলে মানুষ আমতা আমতা করবে, নির্দিষ্ট করে কিছু বলবে না। মানুষের বক্তব্য যেহেতু স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট নয়, সেহেতু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্দিষ্ট বা স্পষ্ট কথা বলবেন কেমন করে?

কিন্তু একটি বিষয় অনেকের কাছেই স্পষ্ট যে, আগামী দিনগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুব শান্ত থাকবে না। দুই পক্ষের যখন যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে, তখন ছোট হোক বড় হোক যুদ্ধ একটি হবেই। কে জিতবে, কে হারবে তা এখনই না বলা ভালো। দেশ যেহেতু রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সেহেতু বিভক্ত মতামত থাকাই স্বাভাবিক। যারা বিএনপিকে ক্ষমতায় দেখতে চান, তারা বলবেন, আগামী যুদ্ধে বিএনপি জিতবে।

আবার যারা ক্ষমতায় আরও এক মেয়াদে আওয়ামী লীগকেই দেখতে চান, তারা মনে করছেন আওয়ামী লীগকে হারায় এমন শক্তি কার! তবে এটাও ঠিক যে, বিএনপি সম্ভবত আগাম শক্তিক্ষয়ের ভুল পথে হাঁটছে। রাজনৈতিক কৌশলে আওয়ামী লীগের তুলনায় বিএনপি যে কাঁচা তা বহু প্রমাণ তারা দিয়েছে। এটা কোনো বানানো গল্প নয় যে, আওয়ামী লীগের মুখোমুখি হয়ে জেতার অভিজ্ঞতা বিএনপির নেই।

হয়তো বলা হবে, দিন কি সব সময় সবার একরকম হয় বা যায়? না চিরদিন আওয়ামী লীগ অনুকূল পরিবেশ পাবে আর বিএনপি প্রতিকূলে দাঁড় টানবে তা হতে পারে না। আগামী দিনের আন্দোলনের করণীয় নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় আনুষ্ঠানিক সংলাপ শুরু করেছে বিএনপি। রোববার এমন একটি বৈঠক হয়েছে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির সঙ্গে। আলোচনা শেষে দুই দলের নেতারা বলেছেন, আগামী দিনে আন্দোলনে বড় চমক আসছে।

রাজনীতিটা কি আসলে কোনো ‘চমক’র বিষয়? কল্যাণ পার্টি তো বহু বছর ধরে বিএনপির সঙ্গেই আছে। এই পার্টির বদৌলতে বিএনপির যদি কিছু কল্যাণ হতো তাহলে এত বছরে কেন হলো না? কল্যাণ পার্টির শক্তি বা জনসমর্থনই বা কতটা? সৈয়দ ইবরাহিম সাহেবের ব্যক্তিগত ক্যারিশমাই বা কতটুকু? সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের অভ্যুত্থানের সময় তিনি যে ‘চমক' দেখিয়েছিলেন তা সংশ্লিষ্টদের নিশ্চয়ই মনে আছে। তারপর রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে দল গঠন করে কতটুকু সফল হয়েছেন, যার জোরে বিএনপি এখন চমক দেখানোর কথা বলছে? এ ধরনের অযথা কথা বলে বিএনপি কি তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছেও হাস্যকর হয়ে উঠছে না?

বিএনপির মধ্যে নানামুখী টানাপোড়েন আছে। দলটি ঐক্যবদ্ধ ও সংহত নয়। দলের প্রধান দুই শীর্ষ নেতা রাজনীতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারছেন না। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী হতে পারবেন না। সরকার আবার মামলা হামলা বাড়িয়ে দিলে দলের অনেকেই আবার গর্তে লুকাবে। বিদেশি মিত্রদের ওপর ভর করে বিএনপি যতই আস্ফালন করুক তা যে কাজের মুহূর্তে নিষ্ফল হয়, তা-ও দলের ভুক্তভোগীদের অজানা নয়।

আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক, সেটা অনেকেই চাইছেন। কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থাকা কোনো দল যদি নিজেদের মতো করে মাঠ সাজাতে না পারলে নির্বাচন থেকে দূরে থাকে তাহলে কি হবে? আওয়ামী লীগের সামনে যেমন সমস্যা আছে, তেমনি বিএনপির সামনেও আছে। আওয়ামী লীগের বড় সম্পদ দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা আওয়ামী লীগের জন্য বড় মুস্কিল আসানের ভূমিকা পালন করে। বিএনপির দলে বা মিত্রদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার ওপর মানুষের ভরসা আছে। তাহলে কীভাবে বা কীসের জোরে বিএনপি আগামী নির্বাচনের আগে রাজনীতির মাঠ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার আশা করছে?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেই জানা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলের নানা প্রস্তুতির কথা। সরকার বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সামনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে সচেতন নেই, সেরকম ভাবারও কোনো কারণ নেই। বর্তমান অর্থনৈতিক টালমাটাল বিশ্বে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, কর্মসংস্থান নিরাপদ রাখা, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে জনমনে স্বস্তি সমুন্নত রাখাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে পারলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমস্যা হবে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ নেতারা।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় লাঠির মাথায় পতাকা বেঁধে মিছিল সমাবেশ বা দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি রাজধানীর হাজারীবাগে এমন একটি মিছিলে বিএনপি-আওয়ামী লীগ এবং পুলিশের ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হন। সমাবেশ থেকে ‘বিএনপি যুদ্ধে নেমেছে’ বলে সরকারকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন দলটির নেতারা।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আগের বছরই রাজনীতি সংঘাতের দিকে এগোচ্ছে- এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে ‘বিএনপির এসব হুমকি-ধমকিসহ সব ষড়যন্ত্র’ খতিয়ে দেখে এবার আটঘাট বেঁধেই মাঠে নামছে ক্ষমতাসীনরা। বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে চলতি মাসেই রাজনীতির মাঠ দখলের পরিকল্পনা করেছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি কেন্দ্র থেকে তৃণমূলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগও নিয়েছে দলটি। সেই সঙ্গে সারাদেশে সরকারের উন্নয়ন সাফল্য তুলে ধরে বিএনপির অপপ্রচারের জবাব দিতে নেতাকর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সামনে বড় সমস্যা দলটি ক্ষমতায় থেকে গত ১৩ বছরে অনেকটাই এলেমেলো হয়ে পড়েছে। সম্মেলনের মাধ্যমে দল গোছানোর কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। রাজনীতি ঘনিষ্ঠ অনেকেই মনে করেন, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। জেলা-উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না হওয়ায় নতুন নেতৃত্ব আসার পথ বন্ধ।

এমপি ও স্থানীয় আওয়ামী লীগে দ্বন্দ্ব চরমে। ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে ঠাঁই দেওয়া হচ্ছে অনুপ্রবেশকারীদের। এভাবে বিশেষ ব্যক্তির বলয় তৈরি করাসহ নানা কারণে তৃণমূলনির্ভর দলটির সাংগঠনিক অবস্থা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তৃণমূলের অনেক অভিযোগ জমা হচ্ছে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে। অভিযোগের ভিত্তিতে নেওয়া হচ্ছে ব্যবস্থাও।

বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। এটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই যে, তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই আওয়ামী লীগের শক্তি। তৃণমূলকে গুছিয়ে এবং নির্বাচন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে বিএনপি বড় চাপ তৈরি করতে পারবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন না।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম

বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা করে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ করার কোনো বিকল্প নেই। এটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই যে, তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই আওয়ামী লীগের শক্তি। তৃণমূলকে গুছিয়ে এবং নির্বাচন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে আস্থার ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে বিএনপি বড় চাপ তৈরি করতে পারবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন না।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।