পাসপোর্ট
জনভোগান্তি, পুলিশি তদন্ত
সাধারণ মানুষ এমনিতেই নানান ভোগান্তির শিকার। রাস্তাঘাটে, বাসে-মিনিবাসে ভাড়া নিয়ে ক্যাচাল তো নিত্যদিনের। কাঁচাবাজারে শাকসবজির দাম বাড়া নিয়ে মানুষের তালুতে এমনিতেই রক্ত উঠে আসছে, সেখানে আবার সরকারি অফিসের সাহেবদের হাতে নাকাল হওয়া, তাদের চোখ রাঙানি, ধমক ও কাজ না করে দেবার কায়দার মধ্যে পড়ে তারা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মানুষ। সেবা দেবার বিপরীতে ঘুস খাওয়ার ওপেন সিক্রেট রেওয়াজ গণমানুষকে ক্লান্তিকর জীবনের নিগড়ে ফেলে রেখেছে।
এসবের পর যদি কোনো নাগরিক পাসপোর্ট করার চেষ্টা করে তাহলে তাকে নাকাল করতে ছুটে আসে মাননীয় দালালচক্র। এদের অদৃশ্য পালকেরা প্রায় নিঃশব্দে থাকেন তাদের পাসপোর্ট অফিসের বিভিন্ন পজিশনে। এদেরই নানান কৌশলের মধ্যে বিভ্রান্ত পাসপোর্ট করতে আসা মানুষগুলো দালালকেই আপন ভাবতে বাধ্য হয়। দালালেরা পাসপোর্ট অফিসের নানান প্যাঁচ ও সুযোগের পথ চেনে। স্মার্টলি তারা কাজ করে দিতে পারে। সেকারণে দালালই জিন্দাবাদ দেয় তারা। হ্যা, তাতে তার বাড়তি টাকা খরচ হয় বটে, কিন্তু ভোগান্তির যে সরস ঘোরপ্যাঁচ, আপাতত তা থেকে মুক্তি মেলে।
এই যে বর্ণনা দিলাম তা পাসপোর্ট ডিজিটাল আমলে ঢুকে যাওয়ার আগের দৃশ্যকল্প। আজ কিন্তু পরিস্থিতি তেমন নেই। এখন নিজের এলাকায় বসেই পাসপোর্টের ফরম পূরণ করে দেয়া যায়। সেটা ইলেকট্রনিক্যালি পদ্ধতিতেই গিয়ে জমা হয় পাসপোর্ট অফিসের সার্ভারে। অফিস সেখান থেকেই তথ্যাদি নিয়ে যাবতীয় অফিসিয়াল কাজ সম্পন্ন করেন। কিন্তু এর বাইরে আছে যে সফটওয়ারের সমস্যা। যে সফটওয়্যারটি ২০২১-এর ডেভেলপ্ট করে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটি কোনো কাজ করছে না। কাজ করছে না বলাই ভালো। সমস্যাটির জটিলতা বের করেছে পুলিশের বিশেষ শাখার একটি টিম। কি বলেছে সেটা দেখা যাক।
অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদনের ঠিকানা লেখার জায়গায় ৯৬ ক্যারেক্টারের (অক্ষর, বিরামচিহ্ন ও দুই শব্দের মধ্যের ফাঁকা জায়গাসহ) বেশি ব্যবহারের সুযোগ নেই। এতে অনেকেই সংক্ষিপ্ত আকারে ঠিকানা লিখতে বাধ্য হন। তবে বিপত্তি বাধে আবেদনকারীর দেওয়া তথ্য যাচাইয়ের সময়। পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না পেয়ে পুলিশ অনেক সময়ই ‘নেতিবাচক’ প্রতিবেদন দিচ্ছে। ফলে ওই সব আবেদনকারীর পাসপোর্ট আটকে যাচ্ছে।
সরকারের ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সফটওয়্যারের এমন সীমাবদ্ধতা এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির চিত্র উঠে এসেছে পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিটের প্রতিবেদনে। সম্প্রতি ওই প্রতিবেদন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
পাসপোর্ট অধিদফতর যখন এই সফটওয়্যার তৈরি করে তখন কেন তারা এটা বোঝেননি? আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের সামাজিক প্যাটার্ন কেমন, নগর ও গ্রামের ক্ষেত্রে যে বিভিন্নতা আছে সেটা কি তারা জানতেন না। যিনি বা যারা, যে কোম্পানি ওই সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে তারা কি আমাদের নগর-মহানগরের বাসাবাড়ির নম্বরের এলোমেলোমি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না বা নেই। আমাদের মহানগরেও বাড়ির নম্বর সিরিয়ালি নেই।
এই সামাজিক বিষয় নিয়ে যে তারা ভাবিত নন, তারা যে ব্রিটিশ আমলে ভূমির বিন্যাসের মতোই সব কিছু জটিল করে তৈরি করেছে, তাদের বিদ্যায় ও বুদ্ধিতে তা কি একবারও আসেনি? ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার আমাদের ভূমি ব্যবস্থায় এমন নোংরা জটিলতা সৃষ্টি করেছে যাতে আমাদের সামাজিক জীবন সব সময় তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত থাকে।
মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। খুনোখুনিতে লিপ্ত থেকে জনজীবনকে নাকাল করে তোলে। এটা মানতেই হবে তারা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলো তাদের স্বার্থ রক্ষায়। দীর্ঘমেয়াদে আমরা যাতে ব্রিটিশদের সাংস্কৃতিক অধিপত্যের চাকর হিসেবে থাকতে বাধ্য হই, সেটাই তারা করে গেছে। পুলিশি ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এটা সমানভাবে খাটে। পুলিশবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিলো ১৮৬১/৬২ সালে ব্রিটিশ অফিসারদের রক্ষার জন্য, লাঠিয়াল হিসেবে।
আপনাদের অনেকেরই মনে থাকবার কথা তখন হাফপ্যান্ট পরা খাকি পোশাকের পুলিশ হাতে লাঠি নিয়েই যেতো। সেই পোশাকটাই ছিলো তাদের শক্তির প্রতীক। ওই পুলিশ দেখে গায়ের মানুষেরা কাঁপতো। ঠিক আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাঙালি পুলিশের দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখে সাধারণ মানুষের আত্মার পানি শুকিয়ে যায়। তারা সুদূর অতীতের মতোই একই রাজনৈতিক ও সামাজিক ইমেজ নিয়ে চলছে। এটা ঠিক না। স্বাধীনতার পর পুলিশকে অবশ্যই জনগণের প্রকৃত সেবক করে গড়ে তোলা উচিত ছিলো। তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছে এই ভাবে যে, জনগণ সবাই কোনো না কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত। শাসকরাই একমাত্র সৎ ও অপরাধমুক্ত ভালো মানুষ।
ভালো মানুষেরাই যে মানিলন্ডারিং, নদীদখল, সরকারি জমি দখল, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা গাপ করে দিচ্ছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে লুটে নিয়ে বিদেশে পাচার করছে, পণ্য বাজারে দ্রব্যমূল্যের আগুন লাগাচ্ছে এবং আরো অনেক কুকর্মের হোতা, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের কিছুই করার নেই। কেন না, তারা সরকারের অধীন। সরকার ওই সব লুটেরাদেরই পৃষ্ঠপোষক। তারা তাদেরই লোক।
দ্বিতীয়ত, সফটওয়্যারটি যখন চেক করা হলো তখন কেন এর সীমাবদ্ধতা ধরা পড়লো না। নিশ্চয়ই তাড়াহুড়ো করে এই প্রোডাক্ট ব্যবহারের জন্য আনা হয়েছে। ফলে যে সব ত্রুটি ও বিচ্যুতি রয়ে গেছে, সেগুলোকে পাত্তা দেননি তারা। ভেবেছেন, ঠিকই হয়ে যাবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে-`বিপত্তিবাধে আবেদনকারীর তথ্য যাচাইয়ের সময়। পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা না পেয়ে পুলিশ অনেক সময়ই নেতিবাচক প্রতিবেদন দিচ্ছে। ফলে ওই সব আবেদনকারীর পাসপোর্ট আটকে যাচ্ছে।’ কিন্তু পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটের প্রতিবেদনে একটি বিষয় লুকানো হয়েছে বা তারা ওই বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি। সেটি হলো, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য পুলিশের যে সদস্য বাসায়, ফ্লাটে কিংবা গ্রামাঞ্চলের বাড়িতে যান, তিনি কিছু না পেলে (মানে ঘুস) নেতিবাচক প্রতিবেদন দেন। এই ঢাকা শহরেও এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে।
আর পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিগণ যে শিক্ষায় প্রশিক্ষিত তারা কি সেই বহমান ধারার বাইরে যেতে পারেন? মেইন স্ট্রিম ( সরকারের প্রশাসন) যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্ট্রিমের (স্রোত বা ধারার)অধীন, পাসপোর্ট অফিস কি তার বাইরে যেতে পারবে। মাঝখানের কোনো অফিষকে আধুনিক ও ডিজিটাল করলেই যদি সেবা নির্বিঘ্ন হতো তাহলে আলাদা আলাদাভাবে তা করলেই সব অন্যায় অপকর্মের অবসান হতো।
এই যে পাসপোর্টের সফটওয়্যার সমস্যা এটা যিনি করেছেন তারা ঠিকানার ওই সব সীমাবদ্ধতাও ঠিকই চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু তা করতে দেয়া হয়নি। কারণ ওই ব্রিটিশ লিগেসি। ঘুস-দুর্নীতির পথ খোলা না রাখলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা যাবে না, আবার সেবাগ্রহিতাকেও উত্যক্ত করা যাবে না। এই মনমানসিকতাই আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতার প্রধান কারণ। আমাদেরকে এই মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস