উৎসব

নির্বিঘ্নে পূজা হোক

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা , প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি।
প্রকাশিত: ১০:০৮ এএম, ০১ অক্টোবর ২০২২

বছর ঘুরে আবার এসেছে দুর্গা পূজা। সনাতন ধর্মের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বলা হলেও এটি সব বাঙালির সর্বজনীন উৎসবের একটি। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ – এই মন্ত্রে উজ্জীবিত বাঙালির জন্য এবার উৎসবের চেয়েও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তা ভাবনা। কারণ হলো গতবারের অভিজ্ঞতা।

গতবারের পূজায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার কারণে এবছর নিরাপত্তার ভাবনাটা সামনে চলে এসেছে বড় হয়ে। সরকারও সতর্ক এবং এ জন্য নানা শর্তের বেড়াজালে হিন্দু সম্প্রদায়কে উৎসবের আয়োজন করতে হচ্ছে।

আজ ১ অক্টোবর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত দুর্গাপূজার মূল উৎসব উদযাপিত হবে। তবে পূজার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে ২৫ সেপ্টেম্বর থেকেই। গত বছরের দুর্গাপূজায় কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপে কোরআন রেখে সহিংসতা সৃষ্টি করেছিল একটি জঙ্গি গোষ্ঠী এবং এর জেরে কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় কমপক্ষে দশজন নিহত হয়েছিল, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল মণ্ডপ।

মানুষের মৃত্যু তো কেবল সংখ্যা নয় আরও অনেক কিছু। গতবারের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি কতটা ঘৃণা ও সহিংস মানসিকতা এদেশের একটি অংশ লালন করে। আরও প্রমাণিত হয়েছে এদের কাছে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দল কতটা অসহায় বা উদাসীন।

গতবারের মতো ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেজন্য আগের যে কোন সময়ের তুলনায় এবার নিরাপত্তা বৃদ্ধি বাড়িয়ে পূজার আয়োজন করতে হচ্ছে প্রশাসনকে। তবে নিরাপত্তার চাদরে পূজা উদযাপন কোনভাবেই স্বতস্ফূর্ত উদযাপন নয়। আশার দিক এই যে, এবছর সারাদেশে ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে এবং আগের বছরের তুলনায় প্রায় এক হাজার পূজামণ্ডপ বেশি হচ্ছে।

যেসব শর্ত দিয়ে উদযাপনের অনুমতি দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো- দেশের প্রতিটি পূজামণ্ডপে সিসি ক্যামেরা লাগানোসহ নিরাপত্তার বিভিন্ন শর্ত বাধ্যতামূলক, প্রতিটি পূজামণ্ডপের জন্য আয়োজকদের সার্বক্ষণিক স্বেচ্ছাসেবক দল রাখতে হবে এবং তাদের গুজবের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে, প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত পূজার আয়োজকদের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি করতে হবে এবং আজানের সময় পূজামণ্ডপে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ সহনীয় রাখতে হবে। পূজামণ্ডপ পাহারায় সরকারও নিরাপত্তার আয়োজন আগের চেয়ে বাড়িয়েছে।

এদেশে এর একটি রাজনীতি আছে এবং সেটা শুধুই ঘৃণার রাজনীতি। সেই ঘৃণার লক্ষ্য একটি হিন্দুরা আর উদার মানসিকতার মানুষেরা। প্রতিবছরই আমরা দেখি, পূজা আসার আগে থেকেই শুরু হয় প্রতিমা ভাঙার উৎসব। আগে বুঝত ঋতু দেখে, এখন প্রতিমা ভাঙার খবর পড়তে পড়তেই বাঙালি বুঝতে পারে দুর্গা পূজা সমাগত। সেই গোষ্ঠী বাংলাদেশে পূজা উদযাপন বন্ধ করতে চায়। এটা বন্ধ করে তারা সেই এই সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার আয়োজন করে। গতবার ছিল তার চূড়ান্ত রূপ।

যারা এমনটা করে তারা এখন নারীর কপালের টিপ নিয়ে কথা বলে, পোশাক নিয়ে কথা বলে, নারী শরীরের উপর হামলেও পড়ে। সেক্যুলার রাজনীতির ব্যর্থতায় রাষ্ট্রকাঠামোই সেদিকে ধাবিত হচ্ছে এবং সেটা এমন এক সংস্কৃতির জাগরণ ঘটাচ্ছে যা আসলে সংখ্যাগুরুর ধর্ম ও সামাজিকতা আধিপত্য কায়েম করছে। সে এখন চায় এদের নীতিকেই জাতীয় রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে।

রাজনীতি ও সমাজের নীতিপুলিশি এখন নিয়মিত নজরদারি করে সংখ্যালঘুর উপর। এই রাষ্ট্রে সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় অনুষঙ্গগুলি ক্রমে সংস্কৃতির উপাদান হয়ে উঠছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ, নারী হলে আরও বেশি করে শারীরিক ও মানসিক ভাবে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে।

সমাজের সব স্তরে সংখ্যাগুরুর ধর্ম, সংস্কৃতির অভিব্যক্তি প্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত রয়েছে, উদযাপিত হচ্ছে। রাষ্ট্রের বর্তমান নিয়ন্ত্রকরা তাকে অগ্রাধিকার দেওয়াকেই স্বাভাবিক বলে দেখান। আর সেই সংস্কৃতির দাপটে সংখ্যালঘুর অধিকার ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। গতবারের কুমিল্লার ঘটনায় বোঝা গেল যেটুকু বা অধিকার সুরক্ষিত আছে, আজ তা লুণ্ঠিত হওয়ার পথে।

সংখ্যাগুরুর ধর্মাচরণে, সংস্কৃতিতে কেউ বিপন্ন বোধ করে না। কিন্তু সংখ্যালঘুদের বেলায় গল্প আলাদা। এটাই এখন আদর্শ। সমস্যাটা শুধু সংখ্যালঘুর নয়, সাধারণ মুসলমানদেরও যারা লোক দেখানো ধর্ম পালন করেনা, যারা মনমানসিকতায় জিহাদি নয় তারাও বিপদে। সমাজের সামনে সে তার পরিচয় বা বিশ্বাসের কথা প্রকাশ করতে ভয় পায় এখন।

তার ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক বা ব্যক্তিগত পছন্দের পরিধেয় প্রকাশ করাও এখন কোন কোন জনপদে, গণপরিবহনে বিপদ বয়ে আনছে। এগুলো ভাল লক্ষণ নয়। এতে সঙ্কটে পড়ে দেশ। কারণ পোশাকের কারণে, ধর্মীয় চিহ্নের কারণে বা বিশ্বাস প্রকাশের কারণে তার উপর নির্মমতা নেমে আসলে তা মানুষের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি কেড়ে নেয়ার শাসন কায়েম করে। রাষ্ট্রের পরিচালকদের সেটা বুঝতে হবে। তারা যত আপোস করবে সংখ্যালঘু ও উদারমনাদের বিপদ তত বাড়বে।

ভবিষ্যতে যে আরও প্রান্তিক, সংখ্যালঘু স্বরের উপরেও একই আঘাত নেমে আসবে না, সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তি নাগরিকের স্বাধীন আত্মপ্রকাশের অধিকারের প্রশ্নে বৈষম্য হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দায়িত্ব সবার এবং বড় দায়িত্ব সরকারের।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

এইচআর/এমএস

এদেশে এর একটি রাজনীতি আছে এবং সেটা শুধুই ঘৃণার রাজনীতি। সেই ঘৃণার লক্ষ্য একটি হিন্দুরা আর উদার মানসিকতার মানুষেরা। প্রতিবছরই আমরা দেখি, পূজা আসার আগে থেকেই শুরু হয় প্রতিমা ভাঙার উৎসব। আগে বুঝত ঋতু দেখে, এখন প্রতিমা ভাঙার খবর পড়তে পড়তেই বাঙালি বুঝতে পারে দুর্গা পূজা সমাগত। সেই গোষ্ঠী বাংলাদেশে পূজা উদযাপন বন্ধ করতে চায়। এটা বন্ধ করে তারা সেই এই সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করার আয়োজন করে। গতবার ছিল তার চূড়ান্ত রূপ।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।