মরিয়ম মান্নানের কান্না এবং রাখাল বালকের গল্প
নিখোঁজ মাকে খুঁজে পেতে খুলনার তরুণী মরিয়ম মান্নানের কান্না-আহাজারি প্রায় একমাস ধরে আবেগের জোয়ার এনেছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই জোয়ারের প্রভাবে প্লাবিত হয়েছিল গণমাধ্যমের কিছু অংশও। মাকে খুঁজে পেতে এক কন্যার কান্না এবং সেই কান্নায় বিপুল সংখ্যক মানুষের আপ্লুত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বরং খুলনার একজন সাধারণ তরুণীর আবেগ গোটা দেশে ছড়িয়ে যাওয়াটা আমাদের মানবিকতারই প্রমাণ দেয়। আর বাংলাদেশে কারও গুম হয়ে যাওয়াটা এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। বরং মায়ের খোঁজ পেতে এক কন্যার দিনের পর দিন চেষ্টা, থানা-পুলিশ-সংবাদ সম্মেলন-মানববন্ধন-ফেসবুকে ঝড় সবই মানবতাকেই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে।
এর আগে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের হারিয়ে যাওয়ার পর বাবাকে ফিরে পেতে তার ছেলের সংগ্রামও আমাদের সাহসী করেছে। এবার যখন মাকে ফিরে পেতে এক কন্যা মাঠে নামলেন, আমাদের সাহস আরও বাড়লো।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে তোলপাড়ে প্রবল চাপ সৃষ্টি হয় প্রশাসনের ওপর। রহিমা বেগমের পরিবারের পক্ষ থেকে জমি সংক্রান্ত ঝামেলার কথাও প্রচার করা হয়। নিখোঁজ নারী রহিমা বেগমের আরেক কন্যা আদুরীর মামলায় পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তারও করে। তারা এখন কারাগারে। কিন্তু পুলিশ কিছুতেই রহিমা বেগমের খোঁজ পাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় পিবিআই।
গত ২৭ আগস্ট রাতে খুলনার দৌলতপুর উপজেলার মহেশ্বরপাশার উত্তর বণিকপাড়া এলাকার বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে গিয়েছিলেন রহিমা বেগম। এরপর আর তার খোঁজ মেলেনি। এর মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার ২৮ দিন পর গত ২৩ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ফুলপুরে বস্তাবন্দি এক বেওয়ারিশ লাশকে নিজের মায়ের বলে শনাক্ত করেন মরিয়াম মান্নান। ময়মনসিংহের ফুলপুরে বেওয়ারিশ লাশ দেখে মরিয়াম মান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সালোয়ার-কামিজ ছাড়াও ছবিতে আমার মায়ের শরীর, কপাল ও হাত দেখে মনে হয়েছে এটাই আমার মা।’
মাকে জীবিত ফিরে না পেলেও মরদেহ পাওয়ার ঘটনায়ও সবাই আবেগাপ্লুত ছিলেন। সরকার ও প্রশাসনের ওপর ঝাল ঝাড়তেও আমরা পিছপা হইনি। তবে ময়মনসিংহের ফুলপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল মোতালেব চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মরিয়মের মায়ের বয়স ৫৫ বছর। আমরা যে গলিত মরদেহটি উদ্ধার করেছি, তার আনুমানিক বয়স ২৮ থেকে ৩২ বছর মনে হচ্ছে। এসব দিক বিবেচনায় মরদেহটি তার মায়ের নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।’
কিন্তু মরদেহটি যে তার মায়ের এটা নিশ্চিত করেই বলছিলেন মরিয়ম মান্নান, ‘মেয়ে হয়ে মাকে আমি চিনবো না?’ তার এই আত্মবিশ্বাস বিভ্রান্তি তৈরি করে। তবে মাকে হারিয়ে শোকে কাতর এক কন্যার ভুল হতেই পারে। তাই অপেক্ষা ছিল ডিএনএ টেস্টের। তবে ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পাওয়ার আগেই ঘটনায় নাটকীয়তা আসে। শনিবার রাতে ফরিদপুর থেকে মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগমকে উদ্ধার করে পুলিশ। জানা গেছে, রহিমা বেগমকে কেউ অপহরণ করেনি। তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেছিলেন।
রহিমা বেগমের আত্মগোপনের রহস্য এখনও উন্মোচিত হয়নি। তবে এটা ঠিক তিনি খুব সুকৌশলে ‘অপহরণের নাটক’ সাজাতে পেরেছিলেন। রহিমা বেগম ফিরে না আসায় খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে তার সন্তানরা নলকূপের পাশে মায়ের জুতা, ওড়না ও পানির পাত্র পড়ে থাকতে দেখেন।
এখন জানা যাচ্ছে, রহিমা বেগম আত্মগোপনে যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় পোশাকও নিয়ে গিয়েছিলেন। আর এই একমাস রহিমা মোবাইল ফোনও ব্যবহার করেননি। তাই তাকে খুঁজে পেতে পুলিশের বেগ পেতে হয়েছে। আসলে কেউ জেগে ঘুমালে তাকে জাগানো কঠিন। তেমনি কেউ পরিকল্পনা করে আত্মগোপনে গেলে তাকে খুঁজে বের করাও সহজ নয়।
রহিমা বেগমের জীবিত ফিরে আসার ঘটনায় এখন অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে আসছে। প্রথম প্রশ্ন, রহিমা বেগম যেহেতু বেঁচে আছেন, তাহলে ময়মনসিংহের বেওয়ারিশ লাশটি কার? এটা খুঁজে বের করা পুলিশের দায়িত্ব। যেহেতু মরিয়ম মান্নানের মা কি না তা নিশ্চিত করতে ডিএনএ টেস্টের উদ্যোগ নেওয়াই হয়েছে, তাই এই টেস্টের মাধ্যমেই যেন সেই নারীর পরিচয়টাও বের করা হয়। তবে আসল প্রশ্ন হলো, কেন রহিমা বেগম আত্মগোপন করেছিলেন?
যেহেতু তার হারিয়ে যাওয়ার পর জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের কথা সামনে এসেছিল এবং পুলিশ এরই মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তারও করেছে। তাই ধারণা করা যায়, প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতেই রহিমা বেগম অপহরণের নাটক সাজিয়েছিলেন। এর আগে নারায়ণগঞ্জে এক অপহরণ মামলায় পুলিশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। পুলিশ রিমান্ডে গ্রেপ্তারকৃতরা ভিকটিমকে অপহরণ ও হত্যার দায় স্বীকারও করেছিল। কিন্তু পরে সেই অপহৃত ব্যক্তি ফিরে এসেছিলেন।
পুলিশ চাইলে এই মামলায়ও স্বীকারোক্তি আদায় করে ফেলতে পারতো। এখন প্রশ্ন হলো, বিনা অপরাধে যে ছয়জন প্রায় এক মাস কারাভোগ করছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে? তবে আমার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এই নাটকটি কি রহিমা বেগম একাই সাজিয়েছেন, নাকি তার সাথে আরও সহযোগী ছিল? কোনো কোনো গণমাধ্যমে এমন খবরও এসেছে, রহিমা বেগমের অপহরণ নাটকের সাথে তার মেয়েরাও জড়িত। এই খবরটি আমি বিশ্বাস করতে চাই না। তাহলে মানুষের ওপর থেকে মানুষের বিশ্বাসই উঠে যাবে।
এতদিন যারা মরিয়ম মান্নানের পাশে ছিলেন, তারাও এখন তাকে ভিলেন বানাচ্ছেন, নিজেদের প্রতারিত ভাবছেন। মরিয়ম মান্নান তার মায়ের আত্মগোপনে থাকার বিষয়টি জানতেন কি না, এখনও নিশ্চিত নয়। তবে যারা তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের নিজেদের বোকা বা প্রতারিত ভাবার কারণ নেই। তারা সবাই ভালো মানুষ, মানবিক মানুষ।
মরিয়ম মান্নান সাহসী কন্যা নাকি প্রতারক, সেটা এখনও প্রমাণিত নয়। তবে মাকে ফিরে পেতে তার চেষ্টায় ওভারপ্লে ছিল। ময়মনসিংহে বেওয়ারিশ লাশকে নিজের মায়ের বলে প্রমাণের চেষ্টাও সন্দেহ জাগায়। মনে হতে পারে, জীবিত মা নয়, তার লাশ পেতেই তাদের আগ্রহ বেশি। অনেকে মরিয়ম মান্নানের অভিনয় প্রতিভায় বিস্মিত। তবে আমি মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানোর পাপটি এখনই করতে চাই না।
তবে রহিমা বেগমের আত্মগোপনে থাকার বিষয়টি বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতায় একটি বড় সংকট তৈরি করবে। বাংলাদেশে মানুষের হারিয়ে যাওয়াটা, গুম হয়ে যাওয়াটা এখন সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। হারিয়ে যাওয়া বা গুম হওয়ার ঘটনা যেভাবেই ঘটুক, যেই দায়ী হোক; তাকে উদ্ধার করার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না।
রহিমা বেগমের আত্মগোপনের ঘটনা এখন পুলিশের কাজটা আরও সহজ করে দেবে। তারা সত্যিকারের গুমের ঘটনাকেও আত্মগোপন বলে চালিয়ে দিতে চাইবে। সত্যিকারের গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনদের কান্নাও আমরা অবিশ্বাসের চোখে দেখবো। মরিয়ম মান্নানের আহাজারি আমাদের সেই মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের গল্প মনে করিয়ে দিল। মিথ্যাবাদী রাখালবালকের গল্পের মতো আমরা সত্যিকারের গুমের ঘটনায়ও নির্বিকার হয়ে যাই, তাহলে তা ভয়ংকর পরিস্থিতি ডেকে আনবে।
তাই মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে রহিমা বেগমের আত্মগোপনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত জরুরি। মরিয়ম মান্নানের পাশে যেমন আমরা দাঁড়িয়েছি, সব গুম বা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায়ও যেন আমরা সোচ্চার থাকি। মরিয়ম মান্নানের মায়ের মতো সব হারানো মানুষ যেন তার স্বজনের কাছে ফিরে আসে।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম