সাফ চ্যাম্পিয়ন

পাল্টে যাওয়া দৃশ্যপটের আয়নায় নারীর মুখ

ড. হারুন রশীদ
ড. হারুন রশীদ ড. হারুন রশীদ , ডেপুটি এডিটর (জাগো নিউজ)
প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২

বাঙালির জীবনে আনন্দ উপলক্ষ খুব বেশি নেই। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নারীরা যে অবিস্মরণীয় জয় নিয়ে এলো সেটি বড় আনন্দের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। প্রায় ১৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ছাদখোলা বাস প্রস্তুত করা হয়েছিল তাদের জন্য। এই বাসে চড়ে বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন পর্যন্ত যেতে সময়ে লেগেছে চার ঘণ্টারও বেশি। আবাল বৃদ্ধ বণিতা রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে সাবিনা-সানজিদা-কৃষ্ণাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এই আনন্দ ছড়িয়ে যায় সবখানে। সারাদেশ যেন উচ্ছ্বাসে ভাসে। বলা যায় এদিন থেকে ফুটবল আবার নতুন করে কথা বলা শুরু করেছে। আমরা কেবল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-ইতালি ফ্রান্সের সমর্থক হয়েই থাকবো না। বিশ্ব পরিমণ্ডলে সাবিনাদের হাত ধরে ফুটবল আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেবে।

সাবিনাদের এই জয় হঠাৎ করে আসেনি। তারা দীর্ঘদিন ধরে কঠোর অনুশীলন করে আর বিভিন্ন পর্যায়ে খেলে গোটা টিম একটি পরিবারে রূপ নেয়। দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে তারা বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সাফল্য দেখায়। গত সোমবার নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় বিকেল সোয়া ৫টায় শুরু হয় ফাইনালের শিরোপা লড়াই। প্রথমার্ধেই ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল সাবিনা খাতুনরা। পুরো ম্যাচে উপভোগ্য ফুটবল উপহার দিয়েছে দুই দলই; কিন্তু গোলের খেলায় সাবিনাদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি স্বাগতিক নেপাল। শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলে তাদের হারিয়েই নারী ফুটবলে ইতিহাস গড়লো বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো নারী সাফের শিরোপা জিতলো সাবিনা-কৃষ্ণারা। এই টুর্নামেন্টে তারা ভারতের মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীকেও হারায়। ফেবারিট নেপালকে হারিয়ে হয় অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন। এই জয়ে বদলে যায় সামগ্রিক প্রেক্ষাপট। যারা এক সময় নিন্দা করতো সাবিনা-সানজিদা কৃষ্ণাদের তারাই প্রশংসায় ভাসালো তাদের। এই ইতিবাচক ধারা ছড়িয়ে পড়ুক নারীর সামগ্রিক অগ্রযাত্রায়।

গত সোমবার নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় বিকেল সোয়া ৫টায় শুরু হয় ফাইনালের শিরোপা লড়াই। প্রথমার্ধেই ২-০ গোলে এগিয়ে গিয়েছিল সাবিনা খাতুনরা। পুরো ম্যাচে উপভোগ্য ফুটবল উপহার দিয়েছে দুই দলই; কিন্তু গোলের খেলায় সাবিনাদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি স্বাগতিক নেপাল। শেষ পর্যন্ত ৩-১ গোলে তাদের হারিয়েই নারী ফুটবলে ইতিহাস গড়লো বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো নারী সাফের শিরোপা জিতলো সাবিনা-কৃষ্ণারা। ট্রফি নিয়ে বুধবার দুপুরে দেশে ফিরেছেন চ্যাম্পিয়ন কন্যারা। গোটা দেশ বরণ করে নিয়েছে তাদের।

wom1

সমাজের চোখ রাঙানি, টিপ্পনি, বাঁকা চাহনিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন তারা। দারিদ্র্যের কষাঘাতও দমাতে পারেনি তাদের। কলসিন্দুর গ্রামে ফুটবলের সাথে এদের অনেকেরই ভোর হয়েছে। নারী ফুটবলের সেই আঁতুর ঘর থেকেই জন্ম নিয়েছে এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেশে তাদের ‘বাঘিনী’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে।

সাফ জয়ে আমরা যে আনন্দে ভাসছি তা যেন বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে না যায়। জয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে। পাইপলাইনে তৈরি করতে হবে আরও খেলোয়াড়। বিশেষ করে স্কুল পর্যায় থেকেই খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। শারীরিক সুস্থতা এবং মানসিক বিকাশের জন্যও তা অত্যন্ত জরুরি। সমাজে দেখা দিচ্ছে অবক্ষয়। মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণী-শিক্ষার্থীরা। কিশোর গ্যাং জড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর সব কর্মকাণ্ডে। এদের রক্ষা করতে হবে।

অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে কিছুই আর মানুষের নাগালেরই বাইরে থাকছে না। পর্নোগ্রাফিসহ সাইবার অপরাধের অনেক কিছুই এখন নাগালে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোন আসক্তি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় খেলাধুলা, নাচগান, ছবি আঁকা, লেখালেখিসহ সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মধ্যে তরুণ প্রজন্মকে ব্যস্ত রাখতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এজন্য সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।

খেলার মাঠেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যে সব মাঠ রয়েছে সেগুলোও দিন দিন বেদখলে চলে যাচ্ছে। খোদ রাজধানীতেই নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য মাঠ থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাঠ না থাকায় অনুশীলনেও বিপত্তি ঘটে। বিশেষ করে নারী দলের জন্য অনুশীলনের পর্যাপ্ত সুযোগ রাখতে হবে। নইলে তাদের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব হবে না।

নারী ফুটবল দল ইতিহাস গড়া জয় পাওয়ার পর নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে। শুধু খেলাধুলা নয়, বাংলাদেশ নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেকটাই এগিয়ে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেতা নারী সে দেশে নারীর অবস্থান কী তা সহজেই অনুমেয়। এছাড়া সমাজের সব পেশার ক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। বিশেষ করে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সশস্ত্রবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী এবং বিভিন্ন কারিগরিতেও নারীরা উচ্চপদে আসীন রয়েছে।

সত্যি বলতে কি বর্তমান বিশ্বে নারী-পুরুষ এভাবে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। কবির ভাষায়, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,/অর্ধেক তার নর’- এই কবিতার মর্মার্থ এই সময় আরও প্রাসঙ্গিক। বর্তমান বাস্তবতায় নারী পুরুষ সমতার বাংলাদেশ গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। যেখানে নারীরা মর্যাদার সঙ্গে এবং সব প্রকার ভয়ভীতি থেকে মুক্ত হয়ে বসবাস করতে পারবে। সমাজ পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে নারীর জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি, শিক্ষাসহ দক্ষ করে গড়ে তোলা এবং তাদের ক্ষমতায়নে একসঙ্গে কাজ করাই হবে কর্তব্য। পাশাপাশি এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে আন্তরিক অঙ্গীকার এবং শক্তিশালী নেতৃত্ব থাকতে হবে। এ ধরনের অঙ্গীকারই পারে নারী-পুরুষের একটি সমতার সমাজ তথা বিশ্ব তৈরি করতে।

wom1

প্রতিটি উপজেলা পরিষদে একজন নির্বাচিত নারী ভাইস চেয়ারম্যানের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে। একজন ইউপি সদস্যও রাখা হয়েছে সংরক্ষিত। এছাড়া সংসদেও সংরক্ষিত আসনে নারীরা নির্বাচিত হচ্ছেন। নারীর স্বাস্থ্য রক্ষায়ও নেওয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে নতুন করে আইন করা হয়েছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমে এসেছে।

নিঃসন্দেহে এটি এক স্বস্তিদায়ক অবস্থা। তবে বাংলাদেশ তো বটেই বিশ্বব্যাপী এখনো নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত নয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই রয়েছে নানা বৈষম্য। এ বৈষম্য কমিয়ে এনে নারী-পুরুষের সমতার বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন নারী-পুরুষের সমতার বিশ্ব ছাড়া কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন, শান্তি, সমৃদ্ধি অসম্ভব। এছাড়া বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়াও অলীক স্বপ্ন থেকে যাবে। এজন্য সবার আগে পরিবর্তন আনতে হবে মানসিকতায়।

বাল্যবিয়ে নারীর অগ্রযাত্রার পথে বিরাট অন্তরায়। এটা খুবই দুঃখজনক যে, সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগের পরও বাল্যবিয়ে বন্ধ হচ্ছে না। গণমাধ্যমে প্রায়ই বাল্যবিয়ের খবর আসে। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে জেল-জরিমানারও বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাল্যবিয়ে থেমে নেই। বাল্যবিয়ে সমাজের জন্য অভিশাপ। কাজেই যে কোনো মূল্যে এটা বন্ধ করতে হবে।

আইন অনুযায়ী পুরুষের বিয়ের বয়স ২১ ও নারীর ১৮। ব্যতিক্রম হলে বিয়ের সঙ্গে জড়িত বর-কনের অভিভাবক, আত্মীয়, স্থানীয় কাজিসহ সবার শাস্তির বিধান রয়েছে। জড়িত পুরুষদের একমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। বর ও কনে দুজন নাবালক হলে তাদের কোনো শাস্তি হবে না। বর সাবালক ও কনে নাবালিকা হলে ছেলের একমাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

কন্যাশিশুরাই বাল্যবিয়ের শিকার হয় বেশি। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, যৌন হয়রানি ও কন্যাশিশুর প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণে কন্যাশিশুদের বিয়ে হচ্ছে বেশি। পাশাপাশি ভুয়া জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে বয়স বাড়ানোর ঘটনাও ঘটছে। দেখা যায়, সন্তান জন্ম দেওয়া ও লালন-পালন করা অল্প বয়সী মায়েদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ছে।

নানা ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে- এমন স্বপ্ন দেখছি আমরা। কিন্তু বাল্যবিয়ে এর মধ্যে বিরাট এক বাধা। এ সমস্যা সমাধানে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে সবচেয়ে বেশি। বিয়ে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো- এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া আর্থসামাজিক নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। এজন্য বাল্যবিয়ে বন্ধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা ও মানসিকতার পরিবর্তনও অত্যন্ত জরুরি।

প্রতি বছর নারী দিবসে তাদের অধিকার নিয়ে সভা-সেমিনারে নানা কথা উচ্চারিত হয়। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত নারীর শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা না যাবে ততক্ষণ নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে না। উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হলেও লিঙ্গ সমতা অত্যন্ত জরুরি। দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে পশ্চাতে রেখে কোনোভাবেই দেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষে এগিয়ে যেতে পারে না।

সংবিধানে পুরুষ-নারী সমান অধিকার। কাউকে ছোট বা কাউকে বড় করে দেখা হয়নি। সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। প্রতিটি ক্ষেত্রে সংবিধান প্রদত্ত অধিকার নিশ্চিত করা গেলে নারীর অধিকারও প্রতিষ্ঠা পাবে। তখন আর আলাদা করে নারী অধিকারের কথা বলতে হবে না। আমাদের যাত্রা হোক সেই আলোকিত পথে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট। ডেপুটি এডিটর, জাগো নিউজ।
[email protected]

এইচআর/ফারুক/এমএস

অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে কিছুই আর মানুষের নাগালের বাইরে থাকছে না। পর্নোগ্রাফিসহ সাইবার অপরাধের অনেক কিছুই এখন নাগালে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মোবাইল ফোন আসক্তি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় খেলাধুলা, নাচগান, ছবি আঁকা, লেখালেখিসহ সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মধ্যে তরুণ প্রজন্মকে ব্যস্ত রাখতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। এজন্য সবাইকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।