ছাত্ররাজনীতি
মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন আছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই!
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত এদেশের ছাত্র এবং ছাত্ররাজনীতি। দেশের লাখ লাখ ছাত্রের রাজনীতি সচেতনতাই আজকের বাংলাদেশ সৃষ্টিতে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন জোরপূর্বক বাঙালির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিতে কালো থাবা বসানোর চেষ্টা করলো, ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ যখন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা করার ঘোষণা দিল, তখন প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠে ফুঁসে উঠেছিল তৎকালীন ছাত্ররাই।
এরপর ’৫২’র ভাষা আন্দোলন, ’৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬’র ৬ দফা, ‘৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ; প্রতিটি ঘটনায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন এদেশের ছাত্রনেতারা। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে এদেশের ছাত্ররাজনীতি।
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির মতো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বিশ্বের কোনো দেশের নেই। জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির আঁতুড়ঘর বলা যায় ছাত্ররাজনীতিকে। তাই কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক রাজনীতির চর্চা অব্যাহত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সম্প্রতি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কমিটি গঠন প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। যে দেশের সূচনালগ্নের সাথে ছাত্র রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ চরম হতাশার বার্তা বহন করে।
বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলেও, গত ৩০ বছরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতির চর্চা একপ্রকার স্থবিরই ছিল বলা চলে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ১৯৯২ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং ২০১০ সালের সংস্কার আইনের কোনোটিতেই ছাত্ররাজনীতিতে বাধা নেই, সেখানে নোটিশ প্রদানের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধচারণ এবং শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা স্বাধীন দেশের একজন নাগরিকের মৌলিক এবং সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করার শামিল। এতে করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেশের জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার পথকেও সংকীর্ণ করা হচ্ছে।
ছাত্ররাজনীতি যেকোনো অব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতার জায়গাকে শক্ত করে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির সুযোগ না থাকলে সেখানকার অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কথা বলবে কারা? ছাত্ররাজনীতির এই অনুপস্থিতি অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন নিষিদ্ধ সংগঠনের মাধ্যমে মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিতেও ভূমিকা রেখেছে। যেখানেই স্বাভাবিক ধারার রাজনীতি অনুপস্থিত সেখানেই মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক শক্তির দৌরাত্ম্য দেখা গেছে। ভুলে গেলে চলবে না চাঞ্চল্যকর হলি আর্টিসান হামলায় অভিযুক্ত এবং আক্রমণকারীদের অনেকেই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছিল।
একথা সত্য স্বাধীনতা-পরবর্তী ছাত্ররাজনীতি অনেকটাই পথভ্রষ্ট। রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সুযোগ সন্ধানী রাজনৈতিক নেতাদের প্ররোচণায় অপরাজনীতির চর্চাসহ নানাবিধ অভিযোগে ছাত্ররাজনীতি আজ অভিযুক্ত। বর্তমানে ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরে বেশ কিছু ছাত্র সংগঠনের নেতারা ছাত্র রাজনীতিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টায় অব্যাহত রয়েছে।
তাছাড়া গণমাধ্যমগুলোতে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডগুলো যেভাবে স্থান পেয়েছে ইতিবাচক কর্মগুলো সেভাবে ফলাও করে প্রচার হয় না। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকরা চান না তার সন্তান রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হোক। আবার সহিংসতা, হানাহানি, রক্তপাত, হিংস্রতার বেড়াজালে জড়ানো বর্তমান ছাত্ররাজনীতির চিত্র অনেক শিক্ষার্থীর মনেই রাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করেছে। ফলে দেশে একশ্রেণির রাজনীতি অসচেতন, রাজনীতিতে অনাগ্রহী প্রজন্ম গড়ে উঠেছে।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত এই ধারা থেকে বের হয়ে একট সুষ্ঠু ইতিবাচক রাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা। শিক্ষার্থীদের জন্য একটি শক্তিশালী প্লাটফর্ম তৈরি করা যার মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেও জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি হতে পারে। ক্লাসের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্রটিকে যদি সঠিক শিক্ষা আর ইতিবাচক রাজনীতির দিক্ষা দিয়ে জাতীয় রাজনীতির অংশ করে তোলা যায়, তবে আখেরে তা হবে দেশের জন্যই মঙ্গলকর।
মাথা ব্যথার সমাধান কখনও মাথা কেটে ফেলা নয়। ছাত্ররাজনীতির ভুল ব্যাখা দিয়ে, শিক্ষার্থীদের রাজনীতির সুযোগ হরণ করে, নিরুৎসাহিত করে দেশের মেধা বিদেশে পাচার করা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হতে পারে না। তেমনিভাবে পথভ্রষ্ট ছাত্ররাজনীতিকে বর্জন নয় বরং সঠিক পথে পরিচালিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দায় অনেক বেশি। তারাই পারে শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক ধারার রাজনীতি সচেতন করে তুলতে।
যার মাধ্যমে ছাত্র নেতারা সাদা কালোর পার্থক্যগুলো সর্বসমক্ষে আনার সৎ সাহস সঞ্চার করতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সন্ত্রাস-সহিংসতা মুক্ত শিক্ষাঙ্গন চায়। সে লক্ষ্যে তারা রাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। যদি সেটিই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হয় তাহলে এমন শিক্ষাঙ্গন তৈরি করা উচিত যেখানে রাজনীতির সংস্পর্শে শিক্ষা কলঙ্কজনক নয়, শিক্ষার সংস্পর্শে ছাত্ররাজনীতি কলঙ্গমুক্ত হবে।
যারা ছাত্ররাজনীতিকে বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে এর আওতামুক্ত রাখতে চাচ্ছেন, তাদের কতজন ছাত্ররাজনীতির সংস্কার নিয়ে কথা বলেছেন? ছাত্ররাজনীতি যদি পথভ্রষ্ট হয়েই থাকে তাহলে সবার আগে আওয়াজ তোলা উচিত তার সংস্কার ব্যবস্থা নিয়ে। আলোচনা হওয়া উচিত কীভাবে ছাত্ররাজনীতির গৌরবান্বিত অতীতকে ফিরিয়ে এনে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইতিবাচক রাজনীতির ধারা অব্যাহত রাখা যায়।
দিনশেষে একজন রাজনীতিবিদের হাতেই দেশের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত থাকে। তাই রাজনীতিকে গালমন্দ করে, মেধাবীদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রেখে উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখা হবে আকাশ কুসুম কল্পনা। দেশের প্রতিটি আগ্রহী প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের ইতিবাচক রাজনীতিতে উৎসাহিত করতে হবে। জাতির মেধাবী সন্তানরা রাজনীতি করলে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। আর সেই প্রক্রিয়ার সূচনা হবে একজন শিক্ষার্থীর রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে।
লেখক: সংবাদকর্মী।
এইচআর/ফারুক/এএসএম