হতাশা
বাড়ছে আত্মহত্যা প্রতিকার কোথায়?
সম্প্রতি গত ২৩ আগস্ট রাজধানীর প্রথম সারির বিদ্যালয় হলিক্রস স্কুলের এক শিক্ষার্থী তেজগাঁয়ের এক বহুতল ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের তরফে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী সেই শিক্ষার্থী দুই বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় তার বাবাকে স্কুল থেকে রিপোর্টের বিষয়টি নিয়ে হতাশা ও আতঙ্কে ভুগছিল। আর তারই ফলাফল স্বরূপ আত্মহত্যার ঘটনা।
শুধু এই হলিক্রসের শিক্ষার্থীই নয়, সারা দেশে বর্তমানে আত্মহত্যার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এবং খুবই আশঙ্কাজনকভাবে উঠতি বয়সী অর্থাৎ কিশোর থেকে তরুণ বয়সীদের মধ্যে এর প্রবণতা বেড়েই চলেছে। কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা এবং তার প্রতিকারে এগিয়ে আসা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
আমি কোন মনোবিজ্ঞানী নই। কিন্তু এটা বলতে পারি সামাজিক ও পারিবারিক অসম্পূর্ণতাই আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী। যে ছোট ছোট বাচ্চারা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে তাদের মানসিকভাবে চিন্তার পরিধি অত্যন্ত ছোট, বিধায় তারা কোনকিছুর ব্যর্থতার দায় এড়াতে আত্মহত্যাকেই সমাধান মনে করছে। এক্ষেত্রে মা-বাবার প্রতিযোগী মনোভাব এবং অন্যদের সাথে নিজের সন্তানকে তুলনার বিষয়টি অনেকাংশে দায়ী।
আমি আমার চারপাশের মায়েদের লক্ষ্য করি। তারা তাদের সন্তানদের কত ভালো স্কুলে পড়াবে, কত ভালো রেজাল্ট করবে সেটা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। মেয়ে শিশুদের স্কুল মানেই ভিকারুননেসা বা হলিক্রস আর ছেলেদের স্কুল মানেই আইডিয়াল বা কোন স্বনামধন্য স্কুলে ভর্তির জন্য মা-বাবারা রীতিমতো ছোট ছোট শিশুদের ওপর অত্যাচার শুরু করে দেয়।
এমন অনেককেও দেখা যায় যারা তাদের সন্তানকে প্রাইমারী বা কোন কিন্ডারগার্টেনে না দিয়ে স্কুলে ভর্তির কোচিং করান। আর সেই শিশুটি যদি শহরের কোনো নামীদামী স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যায় তাহলেতো কথাই নেই। শুরু হয়ে যায় পরবর্তী দশ বা বারো বছরের জন্য কাছা বেঁধে লাগা- কত ভালো রেজাল্ট করবে তার জন্য। সব বিষয়ে এ প্লাস পেতে হবে। নয়তো সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না- এই মনোভাব বেশিরভাগ মা-বাবার।
কিন্তু সেই মা-বাবা কী একবারও ভেবেছেন তার ছোট্ট শিশুটির মনের দিক বা সে কি চায়? মা-বাবার গান ভালো লাগে- তাই গান শেখাতে হবে; মায়ের নাচ ভালো লাগে-তাই বাচ্চাকে নাচ শেখাতে হবে। কিন্তু বাচ্চার কি ভালো লাগে তা জানে কয় জন? আবার এমন অনেক বাবা মা আছেন যারা সন্তানকে কোনো সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই রাখেন না।
দিন-রাত পড়ালেখাই তাদের কাছে সব। পড়ালেখা তখন একজন শিশুর কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফেল বা অকৃতকার্য হওয়া এই সমাজের জন্য বিরাট অপরাধ। যে অপরাধে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয় একজন ছোট্ট কুড়িকে যার কথা ছিল ফুলের মত ফুটে ওঠার।
ডিজিটাইলেজশনের যুগে পৃথিবী যত হাতের মুঠোয় এসেছে, আমরা তত অবাস্তব পৃথিবীতে ঢুকে পড়ছি। টিকটক, লাইফস্টাইল ব্লগ, ফেসবুক আমাদের সমাজের বাস্তবচিত্রকে অনেকটাই হালকা করে দিচ্ছে। আমরা আমাদের সন্তানদের হাতে সহজেই তুলে দিচ্ছি স্মার্টফোন- হয়তো অনেক সময় প্রয়োজনেই। কিন্তু আমরা খেয়াল রাখছি না তার অন্তর্জালের দুনিয়া সম্পর্কে। কারণ আমরা নিজেরাও সেই রঙিন দুনিয়ায় টিকটকে বা লাইফস্টাই ব্লগে ব্যস্ত। পারস্পারিক বোঝাপড়া, পরিবারের সাথে সময় কাটানো, শারিরিক পরিশ্রম – এগুলোকে দিন দিন দূরে সরিয়ে, মেকআপের আস্তরণকে আপন করে নিচ্ছি। এসবের চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
আজ থেকে বিশ বছর আগের কৈশোর আর এখনের কৈশোরের মধ্যে বহু তফাৎ। বিশ বা পঁচিশ বছর আগে আমরা যখন কিশোরকাল কাটিয়েছি, আমাদের সঙ্গী ছিলো বই, গাছপালা আর ছুটির দিনে বা পরীক্ষা শেষে মা-বাবার সাথে ঘুরতে যাওয়া। আর একালের কৈশোর কাটে অনলাইনে লাইক, লাভ বা শেয়ারে অথবা রেস্তোরাঁর আলো-আঁধারিতে। গঠনমূলক কিছুর সাথে আমরা আমাদের সন্তানদের জুড়ে দিতে পারছি না। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা।
এবার একটা পরিসংখ্যান দেখি-
বিবিএস-এর জরিপ বলছে বাংলাদেশে বছরে আত্মহত্যা করছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ৷ গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন ৩৫ জন৷ পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন৷ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যমতে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ২,১৬৬টি৷
বিবিএস বলছে, করোনার প্রথম বছর আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ৷ মোট আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪ হাজার ৪৩৬টি৷ করোনার সময় নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বে আট লাখ লোক আত্মহত্যা করেন। দৈনিক আত্মহত্যা করেন ২,১৯১ জন। প্রতি লাখে ১৬ জন। গত ৫০ বছরে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ।
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে এক অশনি সংকেত দিচ্ছে এই পরিসংখ্যান। এর প্রতিকার একমাত্র হতে পারে একে অপরের প্রতি যত্নশীল হওয়া। মায়ের প্রতি বাবার, বাবার প্রতি মায়ের এবং সন্তানের প্রতি মা-বাবা উভয়ের যত্নশীল হতে হবে। প্রতিযোগিতা মূলক আচরণ থেকে বেরিয়ে এসে সন্তানকে বোঝাতে হবে ফেল করলে বা খারাপ নাম্বার পেলেই কেউ খারাপ হয়ে যায় না, বরং সেখান থেকেই ভালো কিছু হতে পারে। যে ছাত্রটি ইংরেজিতে ফেল করলো সেই হয়তো বিজ্ঞানী হয়ে যেতে পারে। রাগী বা নাছোড়বান্দা অভিভাবকের চেয়ে বন্ধুবৎসল অভিভাবকের প্রয়োজন এখন অনেক বেশি। সন্তানের মনের কাছাকাছি থাকাটা এখন খুব বেশি প্রয়োজন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ পাল্টেও কোমলমতি শিশুদের মনের চাপ অনেকাংশে কমানো যায়। সেক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা জরুরি। কোন শিক্ষার্থীকেই ছোট করে কথা বলা উচিৎ নয়। পাস-ফেল, পরীক্ষায় প্রথম-দ্বিতীয় মেধাতালিকা- এই বিষয়গুলো যদি শিক্ষার্থীদের কাছে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা যায় তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যেত।
সরকারিভাবে স্কুল-কলেজগুলোতে আত্মহত্যার বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ এবং তাতে সরাসরি শিক্ষার্থীদের সংযোগ করা যেতে পারে। যাই করা হোক না কেন এখন সময় এসেছে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যাপক ভাবে সমাজে সচেতনতা তৈরির। সমাজের প্রতিটি মানুষের এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আলোর দিকে এগিয়ে দিতে পারব।
লেখক: সাংবাদিক
এইচআর/জেআইএম