হিন্দু আইন সংস্কার

ন্যায় প্রতিষ্ঠায় এক হিন্দু নারীর একক লড়াই

পুলক ঘটক
পুলক ঘটক পুলক ঘটক
প্রকাশিত: ০৯:৫৫ এএম, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২

বাংলাদেশে হিন্দু আইন সংশোধন হতে যাচ্ছে। এজন্য সময় কতটা লাগবে তা আমি বলতে পারব না। তবে খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে হয় না। কারণ এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে যাচ্ছে যা উপেক্ষা করা সমাজ, সভ্যতা এবং রাষ্ট্রের জন্য অসম্ভব।

আমরা সমাজের মানুষ যখন পাশে দাঁড়াতে পারিনি, তখনো কিছু সাহসী মানুষ পরিবর্তনের জন্য নিরবে একাকি লড়েছেন এবং লড়ছেন। তাদের সবার লড়াই ধীরে ধীরে একমঞ্চে একীভূত হচ্ছে। এ লড়াই পুরো রাষ্ট্র এবং সমাজকে নাড়িয়ে দেবে এবং শতবর্ষের অন্যায় ও জুলুমের আইনগত ভিত্তি শিগগিরই ভেঙে দেবে।

আজ এমনই একজন লড়াকু নারীর কথা বলব। তিনি শিখা দত্ত (ছদ্মনাম) বয়স ৩৬, লড়ছেন একাকি। ২০১৩ সালের অক্টোবরে ওর বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে শুরু হয় অশান্তি, সেই অশান্তি এবং যন্ত্রণাগুলোর বর্ণনা এখানে দিচ্ছি না। চরম বিষময় দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে রেহাই পেতে ২০১৫ সালে তিনি স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে থাকতে শুরু করেন। তখন থেকে একা আছেন।

শিখা একজন কলেজ শিক্ষক। তিনি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারে মাস্টার্স করেছেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল করছেন। পাশাপাশি তিনি এলএলবি পাস। হিন্দু আইনের ভিকটিম হওয়ায় তিনি এই আইনের উপর গবেষণা শুরু করেছেন এবং এর উপর তিনি পিএইচডি করতে চান। সামাজিক হেনস্তা থেকে রক্ষার জন্য শুধু তার প্রকৃত নাম-ঠিকানা প্রকাশ করছি না। বাকি সব তথ্য বাস্তব এবং আদালতে নথিভুক্ত। শিখার বর্ণনা অনুযায়ী তার কথাগুলো এখানে গুছিয়ে লিখছি। তিনি বলেছেন:

দুই বছর পর ২০১৭ সালে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে আমি তার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার একপাক্ষিক ঘোষণা দেই। এটা পাওয়ার পর তিনি কোনো সাড়া দেননি। আমি আইনগতভাবে তার কাছে কোনো খোরপোষও চাইনি। আমাকে ভরণপোষণ দেওয়ার মতো সামর্থ্য তার নেই; বিয়ের পর থেকে আমি বরং তার খোরপোষ চালিয়েছি।

একজন আইনের ছাত্র হিসেবে আমি জানি, নোটারি পাবলিকের এই কাগজের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। হিন্দু আইনে ডিভোর্সের কোনো অধিকার নেই। একারণে অমি আইনি পন্থায় এর প্রতিকারের উপায় নিয়ে ভাবতে থাকি।

১৯৪৬ সালের The Hindu Married Women's Right to Separate Residence and Maintenance Act এর আওতায় আলাদা বসবাসের অধিকার পাওয়া যায়। কিন্তু সেই আইনে সেপারেশন চাইলে আমাকে চিরকাল তাকেই পতি স্বীকার করে একাকি বেঁচে থাকতে হবে। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না; তিনি চাইলে যতগুলো ইচ্ছে বিয়ে করতে পারবেন। আমি যদি হিন্দু আইনের বিধানকে পাস কাটিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করি তাহলে তিনি আমাকে ব্যভিচারিণী সাব্যস্ত করতে পারবেন এবং আমার নতুন স্বামীকে ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত করে ৭ বছর কারাবাসের দণ্ড চাইতে পারবেন।

যদি তিনি ব্যভিচারের মামলা নাও করেন, তবুও আমার নতুন বিয়েটা আইনের চোখে অবৈধ থাকবে। নতুন স্বামীর সংসারে আমার সন্তান হলে তারাও আইনের চোখে অবৈধ সন্তান হিসেবে পরিগণিত হবে। হিন্দু আইনে বৈধ সন্তানের যে অধিকার আছে, অবৈধ সন্তানের তা নেই। এই আইনে বিয়ের ধরনের উপর সম্পত্তিতে সন্তানদের উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয়। প্রজাপত্য বিবাহের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সন্তানের যেমন অধিকার, আসুর বিবাহের (পণ নিয়ে বিবাহ) সন্তানের সে সমান অধিকার নেই। হিন্দু আইনে বাসায় রক্ষিতা রাখা বৈধ। কিন্তু রক্ষিতার সন্তান সমান উত্তরাধিকার পাবে না। তেমনিভাবে দাসীর সন্তান এবং অবৈধ গোপন প্রণয়ের মাধ্যমে প্রাপ্ত সন্তানও (আইনের ভাষায় জারজ সন্তান) বৈধ সন্তানের মতো সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার পায় না। ঐ শিশুদের কোনো দোষ না থাকলেও হিন্দু আইন তাদেরকে এই দণ্ড দিয়ে রেখেছে। ঐ শিশুদের পৃথিবীতে আনার দায় কার?

শুধু আমার জন্য নয়, হিন্দু আইনের এই নিষ্ঠুরতা থেকে নারী, শিশুসহ সকল ভিকটিমকে কিভাবে উদ্ধার করা যায় তার উপায় সন্ধান করছিলাম। এক পর্যায়ে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেই।

আমি আইনের চোখে তার স্ত্রী হিসেবে থেকে অবৈধভাবে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাই না এবং আইনের চোখে অবৈধ কোনো সন্তান পৃথিবীতে আনতে চাই না। তাই আমি ১৯৪৬ সালে ইংরেজদের বানানো ঐ আইনের আওতায় আলাদাভাবে বাস করার অধিকার না চেয়ে সরাসরি ডিভোর্সের (বিবাহ বিচ্ছেদের) জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করেছি।

প্রশ্ন হল, বিদ্যমান হিন্দু আইনে কি ডিভোর্সের অধিকার আছে? আমি পরাশর সংহিতা পড়েছি; বিদ্যাসাগর সমগ্র পড়েছি। বিদ্যাসাগর যে ধর্মীয় বিধান দেখিয়ে বিধবা বিবাহের আইন প্রণয়ন করিয়ে নেন, সেই বিধানেই বিবাহ বিচ্ছেদ এবং নারীর পুনরায় বিবাহের অধিকার আছে। ইংরেজরা আইনটি আংশিকভাবে সংবিধিবদ্ধ (codify) করেছিল। ঐ ধর্মীয় বিধানের পুরোটা সংবিধিবদ্ধ হলে তখনই বিবাহ বিচ্ছেদ এবং পুনঃবিবাহের বিধান একসঙ্গে সংবিধিবদ্ধ আইন হিসেবে স্বীকৃতি পেত। তার অর্থ এই নয়, ধর্মীয় বিধানের বাকি অংশগুলো যেহেতু সংবিধিবদ্ধ হয়নি তাই তার আইনি গুরুত্ব বিলুপ্ত হয়েছে। বরং বিধবা বিবাহের সংবিধিবদ্ধ আইনটিই পরাশর সংহিতার বিধানের আইনি গুরুত্ব প্রতিপাদন করছে।

সম্পত্তির অধিকারসহ সমগ্র হিন্দু আইনের অতি সামান্য অংশই ইংরেজদের আমলে সংবিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। বাকি সবটাই চলছে প্রথার ভিত্তিতে। অনেক ক্ষেত্রে পুরাতন কিছু শাস্ত্র বিধান দেখিয়ে চালানো হচ্ছে। শাস্ত্রীয় বিধানগুলো ভারতবর্ষের যে অঞ্চলে বা যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেভাবে প্রচলিত ছিল, সেটাই সেই জনগোষ্ঠীর জন্য হিন্দু আইন। সুতরাং সংবিধিবদ্ধ আইনের বাইরে যা কিছু রয়ে গেছে, সেসব প্রথা এবং ধর্মীয় বিধান অবৈধ হয়ে যায়নি। সেগুলো হিন্দু আইনেরই অংশ।

উল্লেখ্য, বৈদিক যুগ থেকে পুরাণ ও সংহিতার যুগ এবং তা থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত ধর্মীয়, সামাজিক ও পারিবারিক বিধিবিধানগুলো অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। সেই সকল বিধিবিধান এবং সামাজিক ও পারিবারিক প্রথার সমষ্টি হল হিন্দু আইন। হিন্দু আইন সেই আদিম কাল থেকেই পরিবর্তনশীল। শাস্ত্রে অনেক জায়গায় পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, সত্যযুগে যা প্রযোজ্য, কলিযুগে তা প্রযোজ্য নয়। বৈদিক যুগেও নারীদের পুনঃবিবাহ চালু ছিল। তবে পরাশর সংহিতার ৪/২৭ শ্লোকটি কলিযুগের জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। এতে বলা হয়েছে,

“নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চ পতিতে পতৌ।
পঞ্চস্বাপৎসু নারীণাং পতিরণ্যো বিধিয়তে।”

এই শ্লোকে নারীর পুনঃবিবাহের বিধান দেওয়া আছে এবং কোন কোন অবস্থায় তা করা যাবে সেকথা বলা হয়েছে। শ্লোকটির অর্থ হল, “স্বামী যদি নিরুদ্দেশ হয়, মারা যায়, প্রব্রজ্যা অবলম্বন করে (অর্থাৎ সন্ন্যাসী হয়ে যায়), ক্লীব (পুরুষত্বহীন) হয় অথবা পতিত (ধর্ম বা সমাজ থেকে বিচ্যুত) হয় - এই পাঁচ প্রকার বিপদের ক্ষেত্রে নারীকে অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া বিধেয়।”

 

শিখা বলেছেন, আমি সেপারেশন চাইনি; ডিভোর্স চেয়েছি। কারণ পরাশর সংহিতার উপরোক্ত বিধানটিও হিন্দু আইন, যা এখনো বহাল আছে। আমি ঐ আইনের আলোকে ২০২০ সালে পারিবারিক আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করেছি। আদালত আমার আবেদন গ্রহণ করেছেন; এখন শুনানি চলছে। আদালত বিবাদীকে ডেকেছিল। সমন জারির পরও সে আসেনি। ফলে শুনানি একপাক্ষিক হচ্ছে।

আদালত যদি আমার পক্ষে রায় দেয় অর্থাৎ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়, তাহলে একটি নজির তৈরি হবে এবং অন্যরাও একইভাবে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারবে। যদি এই আদালতে আমার আবেদন খারিজ হয়, তবে জেলা জজের কাছে আপিল করব। সেখানেও ব্যর্থ হলে হাইকোর্টে যাব এবং বৈধভাবে বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার চাব। অধিকার হরণকারী আইন অসাংবিধানিক ঘোষণার জন্য উচ্চ আদালতে আবেদন করব।

আমি থামব না। এ লড়াই আমার একান্ত ব্যক্তিগত হলেও এটা সবার জন্য। কারণ আমি বহু হিন্দু মেয়ের দুর্দশা দেখেছি। আমার চেয়েও কম বয়সী একটি মেয়ের অবস্থা দেখেছি, যার স্বামীধন তার সারা শরীরে ব্লেড দিয়ে এঁকে দিয়েছে। ঐ মেয়েটিকে সারাজীবন সেই স্বামীর সঙ্গেই ঘর করতে হবে! এ কেমন আইন? আমার কলেজের একজন শিক্ষক আছে যার সঙ্গে তার এক ছাত্রীর অস্বাভাবিক সম্পর্ক। ঘটনাটি এলাকায় সবাই জানে। ঐ শিক্ষকের স্ত্রীর এবং স্ত্রীর বাবার কান্না দেখেছি। অল্প বয়সী মেয়ে; ওর বাবা এসে নিয়ে গেছে। ঐ মেয়েটার বাকি জীবন কি এভাবেই কাটবে?

হিন্দু আইন সংস্কারের বিরোধী হাইকোর্টের একজন সুপরিচিত আইনজীবীর নাম উল্লেখ করে শিখা বলেছেন, তিনি আমাকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিয়েছেন। আমি তাকে বলেছি, আমার একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের অধিকার আছে। আমি কি ডিভোর্সের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে ধর্মান্তরিত হব? আমি ধর্মান্তরিত হলে আপনি কি আমার কিছু করতে পারবেন?

ইংরেজদের বানানো হিন্দু আইন অনুযায়ী ধর্মান্তরিত হওয়া অথবা যৌনকর্মীর খাতায় নাম লেখানো ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার নেই। দুঃখজনক সত্য হল, হিন্দু মেয়েদের বিবাহিত জীবন ছেড়ে বেশ্যাবৃত্তিতে প্রবেশের অধিকার এবং সুযোগ দেওয়া আছে। ধর্মান্তরিত হলে অথবা বেশ্যাবৃত্তিতে প্রবেশ করলে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ সম্ভব। কিন্তু পুনরায় বিয়ে করে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচার অধিকার আইনে নেই। আজ রাষ্ট্র এবং হিন্দু সমাজকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোনটা চায়?

হিন্দু আইন সংস্কার আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে শিখার এই মামলাটি আমাকে বাড়তি সাহস যুগিয়েছে। আমার জানামতে হিন্দু আইনের আওতায় বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি প্রথম মামলা, যেখানে পরাশর সংহিতার বিধানের আলোকে সরাসরি ডিভোর্স চাওয়া হয়েছে। আবেদনটি জোড়ালো এবং শক্ত। এটি হিন্দু আইন চর্চার ক্ষেত্রে এক নতুন সংযোজন এবং আমার বিশ্বাস নতুন ইতিহাস রচিত হতে চলেছে। কারণ সরকার সস্তা জনপ্রিয়তাবাদী হতে পারে।

আইন সংশোধন করলে রাজনৈতিকভাবে লাভ বা ক্ষতি কি হবে- সেই অংক নিয়ে রাজনৈতিক দল কষতে পারে। কিন্তু আদালতের জনতুষ্টিবাদী হওয়ার সুযোগ নেই; আদালতকে ন্যায় দিতে হবে। উচ্চ আদালতের কাছে এমন অনেক আবেদন যাচ্ছে, যেগুলো উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বিশ্বাস করি, আদালত ন্যায়বিচার দেবে। অধিকার হরণকারী বর্বর আইনগুলো আজকের যুগে টিকে থাকতে পারবে না।

লেখক: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ হিন্দু আইন সংস্কার পরিষদ। [email protected]

এইচআর/এমএস

ইংরেজদের বানানো হিন্দু আইন অনুযায়ী ধর্মান্তরিত হওয়া অথবা যৌনকর্মীর খাতায় নাম লেখানো ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার নেই। দুঃখজনক সত্য হল, হিন্দু মেয়েদের বিবাহিত জীবন ছেড়ে বেশ্যাবৃত্তিতে প্রবেশের অধিকার এবং সুযোগ দেওয়া আছে। ধর্মান্তরিত হলে অথবা বেশ্যাবৃত্তিতে প্রবেশ করলে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ সম্ভব। কিন্তু পুনরায় বিয়ে করে স্বামী-সন্তান নিয়ে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচার অধিকার আইনে নেই। আজ রাষ্ট্র এবং হিন্দু সমাজকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোনটা চায়?

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।